রসম সর্বস্ব বাংলা ভাষা

রসম সর্বস্ব বাংলা ভাষা

  • শেখ নাঈমুল ইসলাম

এই যে একুশ আসলেই সবার ভাষাপ্রেম উতলে ওঠে, উদ্বাহু হয়ে নাচা শুরু হয়, নানারকম রসম রেওয়াজ পালন করা হয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে সকল মিডিয়ার মাসব্যাপী আয়োজন এগুলা স্রেফ ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছুই না। এই রাষ্ট্র গঠনের পিছনে ভাষাগত জাতিয়তাবাদের চেতনা অনেক বড় কাজ করলেও স্বাধীনতার পরে এই ভাষাটি আদতে দ্বিতীয় শ্রেণির ভাষা হিসাবে যায়গা পেয়েছে । আর একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করাটা স্রেফ রসম এবং উৎসবে পরিনত হয়েছে।

আমাদের ভাষা নিয়ে দুইটা প্রধান সংকট সবথেকে বড় মনে হয়—

প্রথমত পূর্ব বাংলার জনগণের মুখের ভাষাকে বিবেচনায় রেখে একটা প্রমিত বা মানভাষা ঠিক করতে না পারা এবং সেই অনুযায়ী ব্যকরণ ও বানানরীতি প্রণয়ন করতে ব্যর্থ হওয়া।

দ্বিতীয়ত এবং সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো বাংলার জন্য জীবন দেয়া থেকে নিয়ে শুরু করে স্বাধীনতা অর্জনের পঞ্চাশ বছর পার হয়ে গেলেও বাংলাকে সর্বস্তরে চালু করতে না পারা।

একটি ভাষার টিকে থাকা এবং সমৃদ্ধ হবার অন্যতম কারণ হচ্ছে ভাষার সর্বব্যাপী ব্যবহার এবং অর্থনৈতিক মূল্য। শুধুমাত্র সাহিত্য দিয়ে কখনো একটি ভাষা জীবন্ত থাকে না। সাহিত্য হলো ভাষার সবথেকে নগন্য ব্যবহার। মাতৃভাষার কার্যকরী ব্যবহারগুলো হচ্ছে শিক্ষার মাধ্যম, প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা অবদি সকল জ্ঞান বিজ্ঞান এবং সে সংক্রান্ত গবেষণাগুলো মাতৃভাষায় হওয়া, অফিস আদালত সর্বত্র মাতৃভাষার ব্যবহার হওয়া। এই ব্যবহারগুলি শক্তিশালী হলেই সেই ভাষা জীবন্ত এবং আবেদনময়ী হয়ে ওঠে।

একটি ভাষার টিকে থাকা এবং সমৃদ্ধ হবার অন্যতম কারণ হচ্ছে ভাষার সর্বব্যাপী ব্যবহার এবং অর্থনৈতিক মূল্য। শুধুমাত্র সাহিত্য দিয়ে কখনো একটি ভাষা জীবন্ত থাকে না।

এখন প্রশ্ন হলো স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পার হয়ে গেলেও বাংলা ভাষার সর্বব্যাপী ব্যবহার কেন চালু করা গেল না? কেন এখনো উচ্চ আদালতের ভাষা বাংলা না? কেন এখনো উচ্চশিক্ষার মাধ্যম বাংলা না? এর জন্য দায়ি কারা? উত্তর একদম সোজা, এই দুই সংকটের মূলেই আছে আমাদের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিক, সুশীল সমাজ এবং আমাদের মহান রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, এ দেশের অধিকাংশ সুশিল বুদ্ধিজীবিরা স্বাধীন দেশে বসবাস করলেও মানসিকভাবে এক একজন পাকা বেনিয়া।

এই সবুজ শ্যামল বাংলায় জন্ম নিয়েও তারা  ফোর্টউইলিয়ামের পা চাটা উত্তরাধিকার বহন করে চলছে যুগের পর যুগ ধরে পরম্পরাসূত্রে। এ দেশের মাটি ও মানুষ এবং সংস্কৃতির সাথে এদের আসলে কোন যোগসূত্র নেই বললেই চলে। এক একজনের কাছে উচ্চশিক্ষিত হওয়া মানে কে কতটা ভিক্টোরিয়ান মোরালিটি জব্দ করতে পেরে সাহেব বেনিয়া হতে পারলো সেই ইঁদুর দৌড়ে অংশ নেয়া। এরা হলো সবথেকে সুবিধাবাদী নৈতিকতা বিরোধী এবং লুটেরা জনগোষ্ঠী।

এই সাংস্কৃতিক দেউলিয়া এবং লুটেরা শ্রেণিই স্বাধীনতার পর দিয়ে এ দেশ গড়ার দায়িত্ব পায়। পঞ্চাশ বছর পার হয়ে গেলেও এরা শিক্ষায়, প্রশাসনে, বিচারবিভাগে বাংলার প্রচলন করে নি বাংলা নিয়ে হীনমন্যতা এবং নিজেদের বেনিয়া হিসেবে প্রকাশ করতে ও বেনিয়াদের কাছ থেকে উচ্ছিষ্ট পাওয়ার লোভে।

এই গাড়লের দলেরা বুঝলো না যে, একটা জাতির ভাষা টিকে থাকে তার অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অবস্থার উপর নির্ভর করে।

একটা জাতির ভাষা টিকে থাকে তার অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অবস্থার উপর নির্ভর করে।

আর একটা সংস্কৃতি শক্ত ও উন্নত হয় তার শিক্ষা, প্রশাসন, অফিস আদালত এবং সর্বস্তরে মাতৃভাষা প্রচলণের মধ্য দিয়ে, গড় পারের বাবু আর বেনিয়াদের পা চেটে নয়। সংস্কৃতি যখন উন্নত হয় একটা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ যখন গড়ে ওঠে তখন তার হাত ধরেই সেখানে অর্থনৈতিক অবস্থারও উন্নতি হয়।

সুতরাং ফেব্রুয়ারি মাস আসলে ভাষা নিয়ে মেকি আহা উহু না করে এবং এটাকে ভণ্ড চেতনাবাজি রসম উৎসব না বানিয়ে সর্বস্তরে মাতৃভাষা প্রচলন করা হোক। রাষ্ট্র করতে বাধ্য যদি আমরা জনসাধারণ এই ব্যাপারে আগ্রহী হই। মনে রাখা দরকার সন্তানকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ালে, আর ‘ফটর ফটর’ করে ইংরেজিতে কথা বলতে পারলেই উন্নত সভ্য সংস্কৃতিবান মানুষ বানানো যায়না  বড়জোর একটা ভোগবাদী উটপাখি হতে পারে।

লেখক, সমাজ বিশ্লেষক

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *