মাহবুবুর রহমান তুহিন : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ এ বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব পর্যটন দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘Tourism and the Digital Transformation’ অর্থাৎ ‘পর্যটন শিল্পের বিকাশে তথ্যপ্রযুক্তি’ যা বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে খুবই প্রাসঙ্গিক। প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি মানুষের জীবনযাপন প্রণালী পূর্বের তুলনায় সহজতর ও স্বাচ্ছন্দ্যময় হয়েছে। পর্যটন শিল্পও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। ভ্রমণসংশ্লিষ্ট সকল সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে পর্যটকরা অতি সহজেই তাদের ভ্রমণ গন্তব্য নির্বাচন করতে পারছে। বিমান টিকেট, রেলের টিকেট, হোটেল, মিউজিয়ামের টিকেটসহ ভ্রমণ সংক্রান্ত বিভিন্ন সেবাসমূহ পর্যটকরা এখন অতিদ্রুত ও সহজেই গ্রহণ করতে পারছে। এটি সম্ভব হচ্ছে শুধু তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে।
ইতোমধ্যে পর্যটন বিশ্বব্যাপী একক বৃহত্তম শিল্প হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। পর্যটন শিল্পের নতুন নতুন পর্যটন গন্তব্য চিহ্নিত হওয়ার পাশাপাশি সেসকল স্থানে বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যর প্রসার, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, অবকাঠামোগত উন্নয়ণ ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সংক্রান্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। রপ্তানিযোগ্য শিল্পপণ্য হিসেবে জ্বালানি ও রাসায়নিক শিল্পপণ্যের পরেই তৃতীয় সারিতে উঠে এসেছে পর্যটন। পৃথিবীর অনেক দেশে প্রধান রপ্তানিযোগ্য পণ্য হিসেবে এবং মোট জাতীয় আয়ে অবদানের ক্ষেত্রে এ শিল্পের অবস্থান প্রথম কাতারে উন্নীত হয়েছে। অনেক দেশ শুধু অভ্যন্তরীণ পর্যটনশিল্পের উন্নয়ন ঘটিয়ে জাতীয় অর্থনীতি সুদৃঢ় করতে সক্ষম হয়েছে।
পর্যটন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সম্ভাবনাময় একটি দেশ।
আমাদের রয়েছে অফুরন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, হাজার বছরের প্রাচীন পুরাকৃর্তি, ঐতিহ্য, ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, জাতিগত বৈচিত্রতা, সমৃদ্ধ হস্ত ও কুটির শিল্প আরো রয়েছে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনবিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন, জীব-বৈচিত্র্য, বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত-কক্সবাজার, সবুজ পাহাড় ঘেরা পার্বত্য অঞ্চল, বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় জীবনযাত্রা। বাংলাদেশ তার উষ্ণ আতিথেয়তা, শিল্পকলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির জন্য বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত। সর্বোপরি, বাংলাদেশ বিশ্বখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসভূমি। এ সব পর্যটন সম্ভাবনাকে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলে ধরার জন্য প্রয়োজন তথ্য প্রযুক্তিভিত্তিক প্রচার ব্যবস্থা। পর্যটনের প্রচারে ডিজিটাল প্লাটফর্ম ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি অন্যতম পর্যটন গন্তব্য হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।
দক্ষিণ এশিয়ায় পর্যটন শিল্পে দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। World Travel and Tourism Council (ডব্লিউ টিটিসি) এর ২০১৮ সালের বাৎসরিক হিসাব অনুযায়ী ২০১৭ অর্থবছরে দেশের জাতীয় আয়ে ভ্রমণ ও পর্যটন খাতের প্রত্যক্ষ অবদান ছিল ৪২৭.৫ বিলিয়ন টাকা যা জিডিপির ২.২ শতাংশ এবং মোট আয় ছিল ৮৫০.৭ বিলিয়ন টাকা যা জিডিপির ৪.৩ শতাংশ। এই সেক্টর থেকে প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান ছিল ১,১৭৮টি যা দেশের মোট কর্মসংস্থানের ১.৮ শতাংশ। ২০১৭ সালে পরোক্ষ কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে মোট কর্মসংস্থানের ৩.৮ শতাংশ অবদান পর্যটন খাত থেকে এসেছে।
পর্যটন শিল্পের টেকসই ও দায়িত্বশীল (sustainable and responsible) উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গতিশীল করার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার বেশ কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। জাতীয় শিল্পনীতি ২০১০ এ পর্যটন শিল্পকে অগ্রাধিকারমূলক খাত হিসেবে চিহ্নিতকরণ, জাতীয় পর্যটন নীতিমালা ২০১০ প্রণয়ন, জাতীয় পর্যটন সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রতিষ্ঠা, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পর্যটন মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ, প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশনগুলোর উন্নয়ন, পর্যটন আকর্ষণ অবকাঠামো উন্নয়ন, সড়ক, রেল ও বিমান পরিবহণ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন, কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীতকরণের কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, মেরিন ড্রাইভের সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন, কক্সবাজারের টেকনাফে Exclusive Tourist Zone (ইটিজেড) গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ, পর্যটন শিল্পে এ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম এবং আন্তর্জাতিক µzজ শিপের সংযোজন, community based tourism (CBT) উন্নয়ন, ইকো ট্যুরিজম, বুদ্ধিষ্ট হেরিটেজ সার্কিট ট্যুরিজম উন্নয়ন, নদীকেন্দ্রিক পর্যটন বিকাশের কর্ম-পরিকল্পনা প্রণয়ন; আন্তর্দেশীয় যোগাযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ভারতের সঙ্গে নৌ-প্রটোকল স্বাক্ষর, বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল (BBIN) সড়ক যোগাযোগ স্থাপন ও উন্নয়ন সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম।
গৃহীত কার্যক্রমসমূহের সফল বাস্তবায়ন পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখ্যযোগ্য অবদান রাখবে এবং বাংলাদেশকে নিকট ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম পর্যটন গন্তব্য হিসেবে রূপান্তরে সহায়তা করবে। দেশের পর্যটনসংশ্লিষ্ট সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টায় দেশি-বিদেশি সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য পর্যটন সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে দেশে পর্যটক আগমনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং এ খাত থেকে অধিক রাজস্ব আয় অর্জন সম্ভব হবে।
পর্যটন এখন শুধু একটি দেশ ভ্রমণের মাঝে সীমাবদ্ধ নেই। সময়ের পরিবর্তিত চাহিদানুসারে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে পর্যটন ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। এখন হেলথ ট্যুরিজম, কালচারাল ট্যুরিজম, আর্কিওলজিক্যাল ট্যুরিজম, এডভেঞ্চার ট্যুরিজম, এডুকেশন ট্যুরিজম, মেডিকেল ট্যুরিজম, রিলিজিয়াস ট্যুরিজম পর্যটনকে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা দিয়েছে। তাই টেকসই উন্নয়নে পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন ও বিকাশ অপরিহার্য।
জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়নের লক্ষমাত্রার (এসডিজি) ৮,১২ এবং ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকল্পে পর্যটনের উন্নয়ন ও বিকাশের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ’পর্যটন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের মধ্যে চিন্তা ও ভাবের ঐক্য স্থাপনের মাধ্যমে শান্তি ও সম্প্র্রীতি বজায় রাখতে পারে যা টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত। পর্যটন স্থানীয় সংস্কৃতি, পণ্যকে পরিচিত ও জনপ্রিয় করার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।’
ডব্লিউটিটিসির গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে এ মুহূর্তে ১১ লাখ ৩৮ হাজার ৫০০ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পর্যটন খাতের সাথে সম্পৃক্ত। ২০২৬ সালে বাংলাদেশে শুধু এ খাতে প্রত্যক্ষভাবেই ১২ লাখ ৫৭ হাজার লোক কাজ করবে। সংস্থাটির মতে, বিশ্বের ১৮৪টি পর্যটন সমৃদ্ধ দেশের মধ্যে র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৬০ নম্বরে। দশ বছর পর বাংলাদেশ ১৮তম অবস্থানে চলে আসবে। ফলে জাতীয় আয়ে বড়ো অবদান রাখবে এ শিল্প।
এ জন্য দরকার পর্যটন শিল্পে দ্রুত বিনিয়োগ। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কাজ করতে হবে সকলকে। অবকাঠামো, যোগাযোগ ব্যবস্থা, ইকো-সিস্টেম, আবাসস্থল, মানসম্মত খাদ্য, নিরাপত্তা ও ইমেজ বৃদ্ধি করা গেলে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প জিডিপিতে বড়ো ধরনের অবদান রাখতে সক্ষম হবে।
২০.০৯.২০১৮