প্রযুক্তি চর্চায় বাঙালি আলেমদের আরেকটু সরব ও দক্ষতা অর্জন করা জরুরী
ড. মুহাম্মাদ সাইয়্যিদ মুহাম্মাদ ইসমাইল আল-আতিয়্যাহ। ইলমী তৃষ্ণায় ব্যাকুল এক ব্যক্তিত্ব। প্রাচীন মুহাদ্দিসীনে কেরামের মাঝে প্রচলিত পন্থায় হাদীসের সনদ অর্জনের ধারাকে অব্যাহত রাখতে ছুটে চলেছেন দেশ-বিদেশে। আজন্ম জ্ঞানপিপাসু এ বিরল ব্যক্তিত্ব এসেছেন জামিআ ইকরা বাংলাদেশ ও কর্ডোভা একাডেমির যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত হাদীস কনফারেন্সে। আদ্যোপান্ত সুনানে তিরমিযীর দরস শেষে মুখোমুখি হন পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর। ব্যক্ত করেন নিজ অনুভূতি। নিম্নে এর চম্বুকাংশ তুলে ধরা হলো—
পাথেয় টোয়েন্টিফোর : শায়খ কেমন আছেন আপনি?
ড. মুহাম্মাদ সাইয়্যিদ মুহাম্মাদ ইসমাইল আল-আতিয়্যাহ : আলহামদুল্লিাহ। ভালো আছি। আপনারা কেমন আছেন?
পাথেয় টোয়েন্টিফোর : আলহামদুল্লিাহ। আমরা সবাই ভালো আছি। আপনার স্থায়ী নিবাস সম্পর্কে জানতে চাচ্ছিলাম।
ড. ইসমাইল আল-আতিয়্যাহ : জন্মগতভাবে আমি মিশরের প্রাচীনতম নগরী ইস্কান্দারিয়া (আলেকজান্দ্রিয়া) নিবাসী। স্থায়ী ও বর্তমান নিবাস আমার এটাই।
পাথেয় টোয়েন্টিফোর : আপনার পড়াশোনা কি ইসকান্দারিয়াতেই?
ড. ইসমাইল আল-আতিয়্যাহ : হ্যাঁ। ইসকান্দারিয়ার বিখ্যাত ‘জামিয়া আল-ইসকান্দারিয়া’ থেকে হাদীস ও উলুমে হাদিসের উপর আমি ডক্টরেট করেছি।
পাথেয় টোয়েন্টিফোর : আপনার পিএইচডি থিসিস পেপার কি সম্পর্কে ছিল?
ড. ইসমাইল আল-আতিয়্যাহ : হিজরী চতুর্থ শতকের মুহাদ্দিস ইমাম ইবনে হিব্বানের উপর আমার থিসিস পেপার ছিল।
পাথেয় টোয়েন্টিফোর : শিক্ষা পরবর্তী আপনার কর্মজীবন সম্পর্কে কিছু জানতে চাই!
ড. ইসমাইল আল-আতিয়্যাহ : কর্মজীবনে আমি একজন শিক্ষক। মোট ১৫ বছর শিক্ষকতা করেছি।
পাথেয় টোয়েন্টিফোর : এসময়টাতে কোথায় কোথায় শিক্ষকতা করেছেন?
ড. ইসমাইল আল-আতিয়্যাহ : পড়াশোনা শেষ করে সর্বপ্রথম যোগ দেই সংযুক্ত আরব আমিরাত বিশ্ববিদ্যালয়ে। টানা পাঁচ বছর সেখানে অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্বরত ছিলাম। এরপর সংযুক্ত আরব আমিরাতেরই আজমান বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছি ছয় বছরকাল। দুবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বছর ও সর্বশেষ দুবাইতেই ইমাম মালেক ইবনে আনাস কলেজে দুই বছর শরীয়াহ ও ইসলামি আইন বিভাগে দায়িত্ব পালন করেছি।
পাথেয় টোয়েন্টিফোর : বর্তমানে আপনি কি করছেন?
ড. ইসমাইল আল-আতিয়্যাহ : দীর্ঘজীবন শিক্ষকতা শেষে অবসর জীবনযাপন করছি মাতৃভূমি মিশরের ইসকান্দারিয়ায়। পাশাপাশি হাদিস ও উলুমুল হাদিস বিষয়ক পড়াশোনাকে অব্যাহত রেখেছি। টুকটাক গবেষণা ও হাদিসের খেদমতেই কেটে যাচ্ছে জীবন।
পাথেয় টোয়েন্টিফোর : বাংলাদেশে আপনার কি এই প্রথম আগমন? এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ও বাংলাদেশ সম্পর্কে আপনার কী অনূভূতি?
ড. ইসমাইল আল-আতিয়্যাহ : হ্যাঁ এই প্রথম বাংলাদেশে এসেছি। সত্যি বলতে কি বাংলাদেশ সম্পর্কে আমি খুব একটা অবগত ছিলাম না ইতোপূর্বে। সংযুক্ত আরব আমিরাতে কর্মরত সময়ে আমি প্রথম বাংলাদেশ ও বাংলাদেশীদের সম্পর্কে জানতে পারি। সেখানে বাঙালি অধিকাংশদের নির্মাণসংক্রান্ত কার্যাদিতে কর্মরত দেখেছি। খুব একটা অর্থ তাদের ছিল না। বলতে গেলে তাদের দরিদ্রই বলতে হয়। তবে নিজেদের কাজে খুবই পটু এবং নিজেদের সর্বোচ্চটা দিতে দেখেছি। কিন্তু ইলমী অঙ্গনে তাদের পরিচয় তখনো পাইনি। পরবর্তীতে এ ক্ষেত্রে তাদের সরব পদচারণা সম্পর্কে অবহিত হই জামিয়া আজহারসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার যাতায়াত শুরু করার পর।
সাধারণত উপমহাদেশীয় অঞ্চলের মাশায়েখদের ‘আরবি ভাষা’ ও ‘গরীবুল কুরআন ওয়াল হাদিস’ বিষয়ে তাদের গবেষণা থেকে আমি ইন্টরনেট থেকে প্রচুর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছি। উপকৃত হয়েছি। কিন্তু আমি মনে করি ইন্টারনেট বা প্রযুক্তির চর্চায় বাঙালি আলেমদের আরেকটু সরব ও দক্ষতা অর্জন বিশেষ জরুরী। কারণ আমি উপমহাদেশীয় অঞ্চলের উলামাদের যে গবেষণাপত্রগুলো থেকে আমি ফায়েদা হাসিল করেছি, তার সবটুকুই হয়ত ভারতীয় উলামায়ে কেরাম নয়ত পাকিস্তানদের। ভারতীয়রা সবচেয়ে এগিয়ে এ ক্ষেত্রে উপমহাদেশে। বাংলাদেশে এত পরিমাণে গবেষক উলামায়ে কেরাম থাকা সত্ত্বেও ইন্টারনেটে তাদের ইলমী আলোচনার অনুপস্থিতি সত্যিই দুঃখজনক। বিষয়টির প্রতি এদেশের আহলে ইলমদের সবিশেষ দৃষ্টিদান বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে আমি মনে করি।
আমি সত্যিই খুব আনন্দিত ও গর্বিত অনুভব করছি জামি’আ ইকরায় অনুষ্ঠিত ‘আন্তর্জাতিক হাদিস কনফারেন্সে’ অংশ গ্রহণ করতে পেরে। এখানকার এ আন্তরিকতা, এ হৃদ্যতা, এ ভালোবাসা, ইলমের এ স্বাদ, এ গন্ধ, আমলের এই নিমগ্নতা, এদেশের প্রকৃতি সবকিছুতে আমি মুগ্ধ। ভালোবাসায় আপ্লুত। এটা আমার জন্য খুবই বড় একটি পাওয়া।
আরও একটি বিষয় আমার গোচরাভূত ছিল না এ দেশে আসার পূর্বে যে, ইলমে হাদিস, শুরুহে হাদিস, ইলমে ফিকহ, শুরুহে ফিকহ এমনকি আরবি ভাষাতেও এদেশের উলামাদের পান্ডিত্য রীতিমত বিস্ময়কর। বিশেষত আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ হাফিজাহুল্লাহুর সাহাবায়ে কেরামের কবিতামালা সংকলনের মত এত বিশাল একটা কাজ বই আকারে ‘রওয়ায়ে মিন আশআরিস সাহাবা’ এবং শায়খ আরীফ উদ্দীন মারুফ কর্তৃক তার এত চমৎকার ‘তালীক’ সত্যিই আমার জন্য অভাবনীয়-অপ্রত্যাশিত ছিল। বাংলাদেশের মাশায়েখে কেরামের ইলমী কাজ ও সাফল্যে আমি যুগপৎ বিস্মিত ও আনন্দিত।
পাথেয় টোয়েন্টিফোর : আমাদের শিক্ষার্থী ও তারুণ্যের প্রতি যদি কিছু বলতেন…
ড. ইসমাইল আল-আতিয়্যাহ : শিক্ষার্থীদের জন্য আমি যে কথাটি বলতে চাই সেটা হল, আরবি ভাষার প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে। যত্নবান হতে হবে খুব বেশী। যারা ইলমী বিষয়ে পড়াশোনা করতে আগ্রহী তাদের জন্য আরবি ভাষাতে দক্ষতা অর্জন, পারদর্শিতা অর্জন সর্বোচ্চ গুরুত্ব রাখে। কারণ, শরীয়তে ইসলামিয়্যার যাবতীয় বিষয়াদির বলতে গেলে সবকিছুই এ ভাষাতেই। বরং আমি তো বলব ক্লাসে পাঠদানও আরবি ভাষাতেই হোক। এতে শিক্ষার্থীদের ভাষাভিত্তিক দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে।
আরবি ভাষাতে দক্ষতা অর্জন প্রত্যেক শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। এর উপর শিক্ষার্থীদের কুরআন, তাফসির, হাদিস, ফিকহ, উসুলে হাদিস, উসুলে ফিকহ, তাওহিদসহ ইসলামের সর্ববিধ বিষয়ে দক্ষতা অর্জন নির্ভর করে।
আলহামদুলিল্লাহ, আমি জামিআ ইকরার তরুনদের সাথে কয়েকদিন কথা বলে প্রীত অনুভব করেছি যে, আরবি ভাষাতে তাদের স্বভাবজাত দক্ষতা রয়েছে। এই দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে তারা আরো সামনে এগিয়ে যাক এ আশা পোষণ করি।
পাথেয় টোয়েন্টিফোর : জামি’আ ইকরার আঙ্গিনায় আপনার এই কয়টি দিন কেমন কাটল?
ড. ইসমাইল আল-আতিয়্যাহ : আলহামদুল্লিাহ। কিভাবে যে এই কয়েকটা দিন চলে গেল বুঝতেই পারিনি। আপনাদের আপ্যায়ন ও আন্তরিকতার কৃতজ্ঞতা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। আমরা শুধু আরবদের অতিথি আপ্যায়নের কথা শুনেছি, জেনেছি ও দেখেছি; আপনাদের ভালোবাসা-হৃদ্যতা, আন্তরিকতা-আপ্যায়ন সেগুলোকেও হার মানিয়েছে। আপনাদের এই ভালোবাসা আমাকে আপ্লুত করেছে। আমি গর্বিত ও আনন্দিত বাংলাদেশে আসতে পেরে, আপনাদের আতিথ্য গ্রহণ করতে পেরে। বাংলাদেশের এই সফর চিরদিন আমার স্মৃতি হয়ে থাকবে।
পাথেয় টোয়েন্টিফোর : অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে মূল্যবান সময় প্রদান করার জন্য।
ড. ইসমাইল আল-আতিয়্যাহ : মতামত প্রকাশের সুযোগ করে দেয়ার জন্য আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।