- আমিনুল ইসলাম কাসেমী
এখনো সেই দুর্বিষহ স্মৃতি ভুলতে পারি না। ২০০৫ সাল। ২২ আগষ্ট। একটা কালো দাগ কেটে আছে আমার হৃদয়ে। এর ক’দিন আগে, ১৭ আগষ্ট যেমন ছিল এক জঘন্যতম অধ্যায়। সেই সময়কার কিছু পথভ্রষ্ট মানুষ, সরকারের বিভিন্ন পদে যাদের পদায়ন ছিল, তাদের যোগসাজসে এক ভয়াবহতম ঘটনা ঘটে। ১টি বাদে দেশের ৬৩টি জেলায় একসাথে সিরিজ বোমা হামলা চালানো হয়। কিন্তু মহান আল্লাহর খাছ দয়া এবং অনুগ্রহ ছিল বাংলাদেশের উপর, ব্যাপক প্রাণহানি এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ।
কিন্তু এর দিন কয়েক পরে কী ঘটলো আবার? উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে দেওয়ার অপচেষ্টা। আসল অপরাধীদের আঁড়াল করার জন্য একজন হক্কানী আলেমের উপর চড়াও হল তারা। যিনি লন্ডনের উদ্দেশে আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ঢাকা এয়্যারপোর্টে তাঁকে গ্রেফতার করা হলো। দেশের উজ্জল নক্ষত্রকে ঢেকে ফেলার ষড়যন্ত্র করা হলো।
মলিন চেহারা। মাথায় সেই প্রসিদ্ধ কিস্তি টুপি। তবে বীর মুজাহিদের মত কদম ফেলে চলছিলেন তিনি। একজন জগৎ বিখ্যাত আলেমকে কোন প্রকার তাহকিক ছাড়া। পরশ্রীকাতর হয়ে, হিংসার অনলে পুড়ে, তাঁর প্রতিভাকে ধ্বংস করার মানসে, তাঁকে দাবিয়ে রাখার চিন্তায় তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। কী বীভৎস চিন্তা-চেতনা তাদের। কী রকম হিংস্র মেজাজ ছিল ওদের। যেটা ভাবতে কষ্ট হয়।
বড় বেদনাদায়ক স্মৃতি সেটা। খবরের কাগজগুলো এবং টিভি চ্যানেলের হেডলাইনে ছিল সে নিউজ। বড় কষ্ট হয়েছে তখন। মনকে মানাতে পারিনি। একজন ইসলামী স্কলার। খ্যাতিমান আলেম। দারুল উলুম দেওবন্দের সূর্যসন্তান,আবার ফেদায়ে মিল্লাত সাইয়্যেদ আসআদ মাদানীর খলিফা। তাঁকে হাতকড়া দিয়ে কারার অন্ধকার প্রকষ্ঠে নিক্ষেপ করেছিল তারা। অথচ শায়খুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ সাহেব তাঁর জীবনে কোনদিন রাজনৈতিক খেলা খেলেননি। নির্ভেজাল মানুষ তিনি। রাজনীতি-অরাজনীতি কোন প্রোগ্রাম বা মিছিল-মিটিং এ তাঁর কোন সম্পৃক্ততা নেই। সেই নিরীহ মানুষের উপর খড়গ চাপানো হলো। আল্লামা মাসঊদকে রিমান্ডে নির্যাতন করল জালিমেরা।
ইসলামের নাম দিয়ে ক্ষমতায় আরোহণ করে কীভাবে রক্ত চুষেছে, সেটা দেখেছে বিশ্ববাসি।
সে দৃশ্য মনে হলে আমার মন এখনো কাঁদে। টিভির খবর আর পত্রিকার পাতা পড়ে চোখের জল ফেলানো ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। হতবাক হয়েছিল এদেশের সচেতন মানুষেরা। নিরীহ মানুষের উপর হায়েনার হিংস্রথাবা বিশ্ববাসি স্পষ্টাকারে লক্ষ্য করেছিল। ইসলামের নাম দিয়ে ক্ষমতায় আরোহণ করে কীভাবে রক্ত চুষেছে, সেটা দেখেছে বিশ্ববাসি। তবে সাহসী বীর আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ সাহেব। এরকম সাহসী মুজাহিদ মনে হয় এই জামানায় আর নেই। বর্তমান তাঁকে মাওলানা সাইয়্যেদ হুসাইন আহমাদ মাদানী (রহ.) এর প্রতিচ্ছবি বলা হয়। আসলে তিনি হবহু মাদানীর মত সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন।
একবার করাচীতে খেলাফত কমিটির সম্মেলন হয়েছিল। সেই সম্মেলনে ৯ লক্ষ লোকের সমাগম হয়েছিল। গান্ধীজীও সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন। সভা চলাকালিন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়েছিলেন হযরত হুসাইন আহমাদ মাদানী (রহ.)। এমন সময় ব্রিটিশদের পক্ষ থেকে হযরত মাদানীকে গুলি করার হুকুম হয়। হযরত মাদানী অকুতভয়ে কোটের বোতাম খুলে কামানের গোলন্দাজের সামনে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন।
সেসময়ে তিনি বলেছিলেন- ‘লিয়ে ফিরতে হ্যায় বুল বুল চোঁ মে গুল/শহীদ নায কি তরবিয়াত কাঁহা হাঁয়।’ [ফুল নিয়ে ঠোঁটে ঘুরিয়া বেড়ায় উড়ন্ত বুল বুল/খুজিয়া বেড়ায় শহীদ সমাধী দেওয়ার তরে ফুল।] লোকেরা হুসাইন আহমাদ মাদানীর হিম্মৎ ও জযবা দেখে নারায়ে তাকবীর ধ্বনিতে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে তুলেছিল।আধ ঘন্টা স্লোগান চলার পর গোলন্দাজের গুলিও স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল (বরেণ্য আলেমদের জীবন- কথা, পৃষ্টা- ৩৫)
তদ্রুপ আল্লামা মাসঊদ সাহেব সেই সময়ে জালিমের কাঠগড়ায় উঠে বলেছিলেন। কারা বোমা হামলা করেছে সেটা মন্ত্রীদের কাছে জিজ্ঞেস করুন। সেই সময়কার কথিত ইসলামী দলের নেতা, যারা জোট সরকারের শরীকদল। সেই জামায়াতে ইসলামীর আমীর মতিউর রহমান নিজামীর নাম ধরে মাননীয় আদালতকে বলেছিলেন, নিজামীকে রিমাণ্ডে নিলেই বোমা হামলার তথ্য উদঘাটিত হবে।
চিন্তা করুন, কী সাহসী বীর তিনি। যারা ক্ষমতায়, তাদের বানানো বিচারকের সামনে তাদের কুকর্ম সম্পর্কে বলতে তিনি দ্বিধাবোধ করেননি। একটু ভয় পাননি। ঈমানের বলে বলীয়ান ছিলেন তিনি। অথচ গ্রেফতার কৃত মানুষ ভয়ে জড়সড় হয়ে যায়। মুখ খোলেনা কখনো। কিন্তু তিনি ছিলেন দ্বীন ইসলামের অকুতভয় সৈনিক। তিনি যে নির্দোষ,নিরপরাধী, সে কথার জানান দিয়েছিলেন তিনি। সত্যি সত্যি থলের বিড়াল বেরিয়ে গেল একদিন। কারা সেই সিরিজ বোমা হামলা করেছিলো, কে সহযোগিতা করেছিল। এর সব কিছু উদঘাটন হয়ে গেল।
নির্জলা মিথ্যাচার করে মানুষকে জুলুম নির্যাতনের প্রতিফল ভালো হয় না কোনদিন।
জালিম যত বড় শক্তিশালী হোক না কেন, ওর পতন হবেই। যারা আল্লামা মাসউদ সাহেবকে হেনেস্তা করেছে। জুলুম করেছে। যারা মাসের পর মাস তাঁকে জেলে রেখে কষ্ট দিয়েছে। ইতিহাস তাদের ক্ষমা করেনি। ওদের সে খেসারত দিতেই হয়েছে। নির্জলা মিথ্যাচার করে মানুষকে জুলুম নির্যাতনের প্রতিফল ভালো হয় না কোনদিন।
শায়খুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ সাহেব তাঁর সাহসিকতা এবং হক-হক্কানিয়্যাতের উপর তাঁর দৃঢ়তার কারণে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে আকাশ ছোঁয়া ইজ্জত সন্মান দান করেছেন। ওরা চেয়েছিল তাঁকে বিনাশ করে ফেলবে। আর সামনে বাড়তে দিবে না। কিন্তু জালিম শাহীর জুলুম নির্যাতন ভোগের পর তাঁর মর্যাদা আরো বেড়ে গেছে। তিনি বিশ্ববিখ্যাত হয়ে উঠেছেন। বিশ্ববিখ্যাত ইসলামিক স্কলার এর মর্যাদা তিনি লাভ করেছেন।
এভাবে ২০১৩ সনে আমরা আবার দেখেছি, সেই মিথ্যাবাদীদের মুখোশ উম্মোচন করে দিতে। পুরো দেশের আলেম সমাজ যেখানে ওদের দাপটে ভীত সন্ত্রস্ত ছিল। কেউ কোনদিন কথা বলার সাহস রাখেনি। বিশেষ করে জোটবদ্ধ ইলেকশন করার পরে যেন আলেম-উলামার মুখ বন্ধ হয়ে পড়ার উপক্রম। পদ-পদবীর লোভে। বা ক্ষমতায় আরোহণের আশায় তাদের চতুরতা-অসারতা কেউ প্রকাশ করার সাহস রাখেনি। অথচ ওরা দেওবন্দী হালকার মাঝে প্রবেশ করে আলেম-উলামাদের মাঝে জটলা পাকিয়ে রাখত সব সময়। শাইখুল ইসলাম আল্লামা মাসঊদ সাহেব এর হক জবান আবারো গর্জে উঠেছিল ওদের বিরুদ্ধে। রাজপথে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাওয়ার সাহস কারো ছিল না। কিন্তু সেই সাহসিকতার পরিচয় তিনি দিয়ে ছিলেন। যদিও সমালোচনার সাইক্লোন বয়ে গেছে তাঁর উপর দিয়ে। কিন্তু তিনি ছিলেন অটল-অবিচল। হক কথা যতই তিক্ত হোক তাঁর মুখ থেকে স্পষ্ট ভাবে বেরিয়েছে। কোন লুকোচরি খেলেননি। যা বলেছেন, বীর মুজাহিদের মত বলেছেন। বাতিলকে বাতিল বলে উল্লেখ করেছেন। আর হককে বলেছেন হক।
অবশ্য হকের উপর তাঁর দৃঢ়তা। তাঁর বীর মুজাহিদের ভুমিকা। একটু দেরীতে হলেও সবাই বুঝতে পেরেছেন। তিনি সত্যি হক্কানী আলেম। আসলেই তিনি বীর মুজাহিদ। পূর্বসূরীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেছেন। আকাবিরে দেওবন্দের বাস্তব নুমনা শাইখুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ (দা.বা.)। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে নেক হায়াত দান করুন। আমিন।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিষ্ট
আরও পড়ুন: আমার স্বপ্নপুরুষ যিনি, আমি তাঁর গল্প বলি