আরবের দিনলিপি-৭

আরবের দিনলিপি-৭

  • কাউসার মাহমুদ 

গত পর্বের পর 

‘এইমাত্র এক ঝাঁক বৃষ্টি উড়ে এল।’ কী অদ্ভুৎ ভাবনা আমার! এতকাল ধরে বৃষ্টির আগমন সম্বন্ধে ‘এক পশলা বৃষ্টি’ শব্দযোগে চিরাচরিত যে বাক্যটি পড়েছি, আচমকাই তার পরিবর্তন ঘটল। বৃষ্টির উড়ন্ত দৃশ্য অবলোকন করে অপূর্ব এক মোহমুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ল আপন অস্তিত্বজুড়ে। দীর্ঘদিন পর বৃষ্টি হল আজ। প্রচণ্ড শীতের আগাম বার্তাই এই বৃষ্টি। যেন ওপর থেকে ছড়িয়ে দেয়া শৈত্যের রেণু। প্রতি বছর যখনই বৃষ্টি হয়, এ নিয়ে আদিখ্যেতা করি। বিবিধ মানসিক অবস্থা ঘিরে ধরে আমায়। কখনও হর্ষোৎফুল্লতা আঁকড়ে ধরে, কখনও এত মনঃপীড়া পেয়ে বসে—যা অনির্বচনীয়। তখন হয়তো কবিতা লিখেছি অথবা ‘বৃষ্টি ও বিনয় মজুমদার’ শিরোনামে একটা গদ্য। মূলত মরুর এই দেশে যখনই বাঙলার কোনো ঋতু স্পর্শ করি বলে উপলব্ধ হয়, তখন সুখের এক চাঞ্চল্য সর্বত্র আছড়ে পড়ে।

যদিও এসব উদযাপনের উপলক্ষ বছরে কদাচিৎ জোটে। তদুপরি এখানের প্রকৃতি বড় সীমিত। চারপাশ বড় একঘেয়ে। জলসিক্ত কোনোকিছুই স্থায়ী নয়। বৃষ্টির পর কিছুকাল তার আদ্রতা মেখে যে বসে থাকব সে উপায় নেই। চোখের পলকে তুমুল বারিধারা সমস্ত ভাসিয়ে নিল তো আচমকাই রোদ্দুর এসে হানা দেবে। তা না হলেও আধঘন্টার মধ্যে যাবতীয় সিক্ততা শুষে নেবে পাথর অথবা বালি। নয়তো অবিরাম বর্ষণ সমস্ত দিন কাবু করে পরদিনও দ্বিধা করবে না। ফলে প্রকৃতির দিকে তাকালে, পথের আড়ালে গেলে ভ্রম হয়, কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হয়েছিল তো! কিংবা কোনদিন এই নগরীতে রোদ উঁকি দিয়েছিল কি?

অতএব মাতৃভূমিতে শৈশবে ঝড়ের যে মত্ত রূপ, বাতাসের যে প্রকম্পন দেখেছি, এখানের বর্ষায় বোধকরি তা অপ্রদত্ত। হ্যাঁ মরুভূমিতে বালুর ঝড় উঠেছে শুনেছি, বাতাসেরও প্রমত্ত শাঁ শাঁ শব্দ শ্রবণ করেছি, কিন্তু ডালে ডালে সেই যা আঘাত—এখানে তা দেখব কই? হাওয়ার প্রকোপে বিচিত্র পত্রদের যে উড়া, তারপর মাটিতে ভূ-পতন—সেই দৃশ্য এখানে পাব কোথায়? এখানে তো কদাচিৎ পাহাড়ের ঢালে, দীর্ঘ দূরত্বের পর রাস্তার ধারে এখানে-ওখানে,কিংবা জংলা ও জলাশয় ঘিরে মাঝেসাঝে কিছু কণ্টক বৃক্ষের দেখে মেলে। নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে কিংবা অতি ঘনত্বে যা অস্বাভাবিক লাগে। অথবা সৌন্দর্য বর্ধনে প্রধান সড়কের বক্ষজুড়ে ছাতার মত সারিসারি লাগানো থাকে স্থানীয় কিছু পাতাবাহার। তাতে ক্ষণিকের জন্য দৃষ্টি প্রশান্ত হয় ঠিক, কিন্তু বৃষ্টি ও বজ্রপাতের সঙ্গে প্রবলবেগে বায়ুপ্রবাহ আর তুফানের আনন্দটা ভোগ হয় না।

কোথাও শিশিরের শব্দ নেই যদিও, কোথাও ঝরাপাতারও আওয়াজ নেই। তবু মনে হয়, এখন পৃথিবীতে হেমন্ত। শীতের আগে এখন দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছে জীবনানন্দ।

হবেই বা কী করে? দেশে যে হেমন্ত শীতের শুভ্র নির্মল চাদরটি জড়িয়ে আসত। যখন ভোর, দুপুর ও বিকেলে একটা আদ্র আমেজের মাঝে ডুবে যেতাম। সন্ধ্যার কিছু আগে ভেজা ঘাসের ওপর পা ফেলে আঙুল ভেজাতাম, সে কথা ভাবলে বড় অসহায় বোধ হয়। অক্টোবরের শেষ এ সময়টাতে নিশ্চয় দেশে হেমন্ত চলে এসেছে। রাতে কিঞ্চিৎ কুয়াশার প্রলেপে আকাশে ঘোলাটে একটা চাঁদ জেগে থাকে। পতঙ্গ ও পক্ষীকূল পূর্বের তুলনায় অধিকতর নির্জীব হয়ে ওঠে। রাত্রি এক প্রহর অতিক্রম করতেই মানুষের সঞ্চলন ক্ষীণ হয়ে আসে। তারপর সমস্ত জীবেরা ক্রমশ উঞ্চতার দিকে ধীরপায়ে এগুতে থাকে।

গতকাল মধ্যরাতে এমনই অনুভূতিপ্রবণতায় কাতর হয়েছিলাম। যখন বাইরে দাঁড়িয়ে দেখি ঠাণ্ডা হাওয়ার স্পন্দন গায়ে এসে বিঁধছে। ঈষৎ কম্পনে হাতের রোমগুলো দাঁড়িয়ে গেছে। তখন হঠাৎই গভীর দৃষ্টি মেলে দেখি চারপাশে ভেজা অন্ধকার। তাতে কুয়াশার মৃদু আস্তরণ। কোথাও শিশিরের শব্দ নেই যদিও, কোথাও ঝরাপাতারও আওয়াজ নেই। তবু মনে হয়, এখন পৃথিবীতে হেমন্ত। শীতের আগে এখন দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছে জীবনানন্দ। গাছে গাছে ফুটেছে গন্ধরাজ, দেব কাঞ্চন, রাজ অশোক, আর ছাতিমের ফুল । শীতের ঘ্রানে প্রলুব্ধ পাখির মত তিনি গাইছেন–

‘সমস্ত পৃথিবী ভ’রে হেমন্তের সন্ধ্যার বাতাস
দোলা দিয়ে গেল কবে।—বাসি পাতা
ভূতের মতন উড়ে আসে
কাশের রোগীর মতো পৃথিবীর শ্বাস—
যক্ষ্মার রোগীর মতো ধুঁকে মরে মানুষের মন
যখন হেমন্ত আসে গৌড় বাংলায়
কার্তিকের অপরাহ্নে হিজলের পাতা
শাদা উঠানের গায় ঝ’রে পড়ে
পুকুরের ক্লান্ত জল ছেড়ে দিয়ে চলে যায় হাঁস
বনের পাতার মতো কুয়াশায় হলুদ না হতে
হেমন্ত আসার আগে
হিম হয়ে প’ড়ে গেছি ঝরে।’

২৫.১০.২০২৩

চলবে..

লেখক, কবি, বহুগ্রন্থ প্রণেতা

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *