‘আঠার হাজার ফোনের’ ভেল্কিবাজি ও অষ্টধাতু ডাক্তারদের দৌরাত্ম      

‘আঠার হাজার ফোনের’ ভেল্কিবাজি ও অষ্টধাতু ডাক্তারদের দৌরাত্ম     

  • আমিনুল ইসলাম কাসেমী

একসময় ফুটপাতে অষ্টধাতুর ডাক্তারদের লেকচার শোনা যেত। গ্রামের হাটবাজারে সবচেয়ে বেশী এসব ডাক্তারদের উপদ্রব দেখা যেত। মফস্বল শহরের কোর্ট- কাচারি চত্তর, রেল ষ্টেশন, বাস ষ্টপেজ ও লঞ্চ ঘাটে সেসব ফুটপাথ বক্তাদের দৌরাত্মও কম ছিলো না। ওরা একটা খালি বাক্স সামনে নিয়ে প্রচুর বাগাড়ম্বরতার মাধ্যমে শ্রোতাদেরকে প্রথমে চমতকৃত পরে ব্ল্যাকমেইল করে ফেলতো। বাক্স খালি কিন্ত ভাবখানা এমন যেন তার মধ্যে লুকিয়ে আছে ‘সাত রাজার ধন’। এভাবে সরল দর্শক শ্রোতাদের চোখে ধূলো দিয়ে কথার ছলচাতুরীতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখতো  তারা। অবশেষে শুরু হয় সেসব হকার ডাক্তারদের অষ্টধাতু বেচা। নানান মিথ্যা  প্রলোভন আর ভূয়া আশ্বাসে তারা সরল মানুষকে গছিয়ে দিতো হাজার হাজার টাকার অষ্টধাতুর আংটি, তামার মাদুলি, ষাণ্ডার তৈল আর লজ্জাবতী গাছের শেকড়ের তাবীজ।

বর্তমান ওয়াজের ময়দানটাও ফুটপাতের সেই ষাণ্ডার তেল বিক্রির মজমার মত হয়ে  গেছে। আর বক্তাগণ সেসকল ফেরিওয়ালা লেকচারারদের থেকেও কয়েকধাপ এগিয়ে। ফুটপাতের ষাণ্ডার তেলের ডাক্তারগণ যে কায়দায় শ্রোতাদের ভেল্কিবাজি করে ঔষধ বিক্রি করে, সেই একই কায়দায় ওয়াজের ময়দানের শ্রোতাদের ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে যাচ্ছে ওয়াজের ময়দানের বক্তারা। এদের কথার ভারসাম্যতা বলে কিছু নেই। যার যা ইচ্ছে সেটাই ডেলিভারি দিচ্ছে দেদারসে। তারা কখনো প্রতিভাত হচ্ছেন অভিনেতা – অভিনেত্রীর বেশে। কখনো মঞ্চে কাঁপাচ্ছে রাজনৈতিক নেতার মিথ্যার ফুলঝুরি ছড়িয়ে। কখনো চাপাবাজি করে বোকাসোকা শ্রোতাদের ধাঁধা লাগিয়ে দিচ্ছে। এমনসব কথা শ্রোতাদের সামনে উপস্থাপন করছে, যার সাথে বাস্তবতার কোন মিল নেই। অবাস্তব, অসামাঞ্জস্য কথা। মানে সেই চাঁদে মানুষ দেখার মত আর পেঙ্গুইন পাখির ওড়ার মতো গালগপ্প।

আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ স্বল্পশিক্ষিত ধর্মভীরু। ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক রাহবারদের সবচেয়ে বেশী মুল্যায়ন করেন তারা। দুনিয়ার কোন মানুষের কথা বিশ্বাস না করলেও ধর্মীয় নেতাদের কথা মনেপ্রাণে মেনে নেন। তারা যেটা বলেন কোন বাছ বিচার ছাড়াই গ্রোগ্রাসে গিলে নেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, ধর্মীয় নেতাগণ যদি মিথ্যার আশ্রয় নেন, তারা যদি সাধারণ জনতাকে ঐন্দ্রজালিক কায়দায় ধোঁকায় ফেলে দেন তাহলে এর থেকে খারাপ কথা আর হতে পারেনা।

সবখানে এখন আবু যায়েদ সারুজির ছলচাতুরী

ওয়াজ মাহফিলে এখন ওয়াজ নেই। সবখানে এখন আবু যায়েদ সারুজির ছলচাতুরী। মিথ্যা চাপাবাজি আর হঠকারিতা। নিজের ব্যক্তিত্ব এবং কামালিয়্যাতের মিথ্যে পরিবেশনা। একেবারে সেই ফুটপথের লেকচারারদের মত অবস্হা। লজ্জাবতী গাছের শেকড়ের ব্যাপক কাস্টমার বাড়ানোর জন্য আজগুবি কথামালা।

বক্তাগণ ঠিক সেই মিশনেই নেমেছেন। নিজের জীবনের বানানো ঘটনা, জেলখানার মিথ্যা কেচ্ছা, আর নিজের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য ফুলানো ফাপানো আজগুবি কথাবার্তা। দৈনন্দিন কতটা প্রোগ্রাম আসে, কত্ত মানুষ ফোন করে, ওয়াজের ভিউ কত, তার ওয়াজে লোক হয় কীরকম! অমুক জায়গায় এত্ত এত্ত মানুষ হয়েছিল। অমুক জায়গায় এত্ত টাকা হাদিয়া দিতে চেয়েছিল তারপরেও প্রোগ্রাম নেয়নি ইত্যাদি। আজকে তিনটে বা চারটে প্রোগ্রাম। আজ বেশী ওয়াজ করবো না কেননা গলার অবস্থা ভাল নয়। মানে আবোল- তাবোল কথা বলে সময় পার করে চলে যায়। আবার কেউ তো সময়ও দেয়না। এখন তিনি জেলখানা ফেরত এক চিড়িয়া। মানুষ দেখার জন্য ভিড় জমাচ্ছে। মঞ্চে উঠে হম্বিতম্বি করে টাকার বান্ডেল নিয়ে চস্পট দিচ্ছেন।

ওয়াজ মাহফিলের বারটা বেজে গেছে। লিল্লাহিয়্যাত, রুহানিয়্যাত কোনটাই বাকি নেই। শুধু ওয়াজের নামে বড় বড় জমায়েত হচ্ছে।  অধিকাংশ মাহফিলগুলোতে একই অবস্থা। এক সময় মানুষ ওয়াজ মাহফিল থেকে চেতনা নিয়ে, রুহানিয়্যাত নিয়ে, আল্লাহর ভয়ে কান্নাওয়ালা চক্ষু নিয়ে বাড়ি ফিরত।

এখন সবকিছু ব্যতিক্রম। বিশেষ করে ইচড়েপাকা বক্তা এবং তাদের কিছু সাঙ্গপাঙ্গ আবিস্কার হওয়ার পরে ওয়াজের ময়দানটা এখন সার্কাসের মঞ্চ। ওই ইচড়েপাকা বক্তা জেলখানা যাওয়ার পূর্বে যেসব অশালীন মন্তব্য করেছিলেন, বিশেষ করে রাষ্ট্রের কর্ণধরদের ব্যাপারে অস্রাব্য মন্তব্যে জনমনে এবং আলেম সমাজে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিল।  জেলখানা থেকে মুক্তির পরে আবারও লাগামহীন বক্তব্য শুরু করেছেন। যেটা স্পষ্টভাবে জাতিকে বোকা বানানো ছাড়া আর কিছু নয়।

এজন্য এসব ভেল্কিবাজি বন্ধ করা দরকার। যে কায়দায় হোক ওয়াজের ময়দানে পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে সকলের। ওয়াজ মাহফিলের মত পবিত্র জায়গাতে আর মিথ্যাকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবেনা। ওয়াজ কম হোক, কিন্তু যতটুকু হবে সেটা যেন লি ওয়াজহিল্লাহ হয় সেই চেষ্টা করতে হবে।

ওয়াজ মাহফিলের আয়োজকদের একটু ঠিক হওয়া দরকার। সমস্যা হচ্ছে, আজকাল যেখানে সেখানে ওয়াজ মাহফিল এবং যেনতেন ব্যক্তি ওয়াজ মাহিলের আয়োজক। আগে ওয়াজ মাহফিল হত মাদ্রাসাকেন্দ্রিক, মসজিদ কেন্দ্রিক।  কিন্তু এখন ওয়াজ মাহফিল পথেঘাটে, রাস্তা বন্ধ করে, বাজারের পট্টিতে, ফেরীঘাট, লঞ্চঘাটে। আর আয়োজক হল, বেনামাজী, বেশরা চলাফেরা মানুষগুলো। যাদের ধর্মীয় জ্ঞান নেই। শরীয়াতের উপরে চলেনা। ওরা চাঁদা তুলে ওয়াজ মাহফিল দেয়। আর বক্তা তালাশ করে ইউটিউব চ্যানেল দেখে। ইউটিউবে কার সুরেলা কণ্ঠ, কার চাপার জোর বেশী এধরনের বক্তা বাছাই করে। আবার টাকার খেলা চলে। অমুক বক্তা আনতে হবে। টাকা কত লাগবে? যত টাকা লাগুক অমুককে চাই। আর এই সুযোগ গ্রহণ করে কিছু ওয়াজ ব্যবসায়ী এবং গলাবাজ লোকেরা। ওরা গো ধরে বসে থাকে এত্ত টাকা ছাড়া যাওয়া যাবেনা। দাওয়াত দেওয়ার সময় এ্যাডভান্স এবং ষ্টেজে ওঠার আগে সমুদয় টাকা পরিশোধ চাই ইত্যাদি শর্ত- শরায়েত জুড়ে দেয়।

বড় আফসোস! জাতির জন্য। একটা বরকতময় অনুষ্ঠানকে কিছু অযোগ্য আয়েজক এবং অযোগ্য ও লোভী ওয়ায়েজগণ সর্বনাশ করে ফেলছে। বরকতি অনুষ্ঠানের পরিবর্তে এখন বেবরকতি কাজ চলছে। মাহফিলে আদ্যপান্ত কোন কাজই আর লিল্লাহিয়্যাত হচ্ছেনা। ঘরে ঘরে ওয়াজ মাহফিল কিন্তু শ্রোতাদের ফায়দা নেই।  কোন পরিবর্তন আসছেনা কারো। বক্তাও যেমন  টাকার লোভে ওয়াজে আসছে, আয়োজকগণও লোক দেখানো আয়োজন করছে। বড় গ্যাদারিং করে নিজেদের কর্তৃত্ব জাহির করা যায় এমন চিন্তা- চেতনা নিয়েই ব্যস্ত সকলে।

শেষকথা, ওয়াজ মাহফিল নিয়ে আর ভেল্কিবাজি নয়। চাপাবাজ বক্তাদের অবসান হোক। সেই সাথে লোক দেখানো ওয়াজ মাহফিলগুলো বন্ধ হোক। ওয়াজ মাহফিল হোক আল্লাহর জন্য। বক্তা এবং স্রোতা সকলেই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করুক এমন কামনা – বাসনা রইল। আল্লাহুম্মা আমিন।

লেখক, শিক্ষক ও কলামিস্ট

সম্পাদনা,  আব্দুস সালাম ইবন হাশিম

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *