আব্দুল্লাহ আফফান : বিকেলের আকশটাও আজ ঝকঝকে নীল। তবে কয়েক টুকরো মেঘ ও জমে আছে আকাশে। এখন বর্ষা কাল নয় বলেই মনে হয় মেঘে মেঘে ছেয়ে যায়নি আকাশ। ঢাকায় আকাশ দেখার খুব ভালো সুযোগ নেই। বড় বড় বিডিং প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। খোলা আকাশ দেখতে হলে বড় রাস্তা বা ছাদে যেতে যেতে হয়। আসিফের অবশ্য সে সমস্যা নেই। তার ঘর বড় রাস্তার পাশে, বস্তিতে। তাদের ঘরটা সবার আগে। ঘর থেকে বেরুলেই রাস্তা। আর আসিফের আকাশ দেখতে খুব ভালোলাগে। আকাশের সাথে তার প্রেম।
আসিফ রাস্তায় বসে আনমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ঝকঝকে আকাশের দেখলে এমনিতেই তার মন ভালো হয়ে যায়, কিন্তু আজ ঝকঝকে নীল দেখছে, তারপরও আসিফের মন খারাপ। সকাল থেকে তার পেঠে কিছু যায়নি। এদিকে দু’দিন ধরে তার মা অসুস্থ। মায়ের খুব জ্বর। বিছানা থেকে উঠতে পারছে না। ঘরে টাকা-পয়সা যা ছিল ডাক্তার দেখিয়ে, ঔষধ কিনে শেষ। ঔষধ আগামীকাল র্পযন্ত চললেও ঘরে খাবার নেই একটুও। কিছু গুড়-মুড়ি ছিল, সেটাই তার মাকে খাইয়ে সকাল আর দুপুরের ঔষধ খাইয়েছে। এখন রাতে খাবার মতো কিছু নেই ঘরে। বুঝলাম আসিফ না খেয়ে রাত কাটিয়ে দিবে, কিন্তু মা কিভাবে ঔষধ খাবে, এনিয়ে ভাবনার শেষ নেই তার। নিজের অজান্তে চোখ ভিজে উঠল আসিফের। মনে কেবল একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে, তারা এত গরীব কেন?
হঠাৎ আসিফ, আসিফ …
মায়ের ডাকে তার তন্ময়তা ভাঙে। দৌঁড়ে মায়ের কাছে যায়।
কই ছিলি? এতক্ষণ ধইরা ডাকতাছি তোর কোন সাড়া নাই।
এহানেই তো ছিলাম।
তোর খুব কষ্ট হইতাছে নারে?
আমার কষ্ট হইব ক্যাঁ। কষ্ট তো তোমার হইতাছে। কয়দিন ধইরা জ্বরে পইরা রইছো। ঠিক মতো খাইতেও পারতেছো না।
একটু কথা বলতেই গলা শুকিয়ে গেল মর্জিনার। লালা দিয়ে গলা ভেজাতে চেষ্টা করলো, কিন্তু পারলো না। দূর্বল কন্ঠে মর্জিনা বললো, ইকটু পানি দে। গলাডা খালি হুগায় যায়।
দিতাছি বলে, দ্রুত পানি এনে খাওয়ালো আসিফ।
অসুস্থ মর্জিনা অল্প একটু পানি খেয়ে চোখ বন্ধ করলো। কদিনের জ্বরে শরীরটা একদম শুকিয়ে গেছে, ভেঙে গেছে, শক্তি নেই মোটেই।
আসিফ কোলে থাকতেই স্বামী মারা যায় মর্জিনার, জীবন থেমে থাকে না। থেমে থাকেনি মর্জিনার জীবনও। যুদ্ধ করে গেছে ছেলের জন্য। অনেক অন্যায় মেনে নিয়েছে শুধু ছেলের জন্য। কোন কখনো ক্লান্তি ছিল না শরীরে। অতীত মনে করে চোখের কোনে জল জড়ো হয়েছে। মায়ের চোখে জল দেখে আসিফ বলে উঠল, মা মা তুমি কাঁন্দো ক্যাঁ, কাইন্দ না, তোমার শরীরডা শাইরা উঠলে সবঠিক হইয়া যাইব।
মর্জিনা ছেলেকে ধরে কাঁদতে লাগলো। আসিফ অনেক্ষণ ধরে কান্না আটকে রাখার চেষ্টা করছে। মায়ের কান্না দেখে ‘মা আমরা এতো গরীব ক্যান বলে’ সেও কাঁদতে লাগলো।
মা-ছেলে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। হয়তো এ কান্নার নৈপথ্য কেউ জানবে না। জানবে না দুটি বুকের ব্যাথার কথা। ব্যাথাময় গল্পগুলো বুকে চাপা পড়ে থাকবে। বহু প্রশ্নের ভিড়ে চাপা পড়ে যাবে একটি প্রশ্ন, আমরা এতো গরীব কেন মা। আমরা এতো গরীব কেন?