৩০শে মে, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ , ১৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ , ৯ই জিলকদ, ১৪৪৪ হিজরি
সেবার মিশকাত শেষ করেছি। রমযানের পরই সিহা সিত্তাহ পড়বো সে আনন্দে দিনগুলো খুব দ্রুতই চলে যাচ্ছিলো। আঠারো রোযায় তারাবির খতম শেষ করে ভাবছিলাম বাকি দিনগুলো কী নিয়ে কাটাবো? আমাদের উস্তায ড. মাওলানা হুসাইনুল বান্না দা.বা. বললেন, ক’দিন বাদেই বুখারী শরীফ পড়তে যাচ্ছো। সামনে ই’তিকাফ, শায়খে বুখারীর সান্নিধ্য অর্জনের এই তো সময়।
কোনো কিছু না ভেবেই আমি ই’তিকাফের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলাম। আল্লাহ তা’আলা আমাকে দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ জায়গায় তাঁর শ্রেষ্ঠতম একজন বান্দার সাথে বছরের শ্রেষ্ঠতর মাসের শ্রেষ্ঠ দশক অতিবাহিত করার সুযোগ দান করলেন।
শাইখুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ দা.বা. এর সাথে হাজীপাড়া ঝিল মসজিদে সেবছরের ই’তিকাফের সেই স্মৃতি কখনো ভোলার নয়। পুরো মসজিদ লোকে লোকারণ্য। দেশের নানান জায়গা থেকে হুজুরের মুহিব্বীন ও মুতাআল্লীকীন, ভক্ত ও মুরিদানরা এসেছেন ই’তিকাফে। যিকির, তা’লিম, কিয়ামুল লাইল, দু’আ–মুনাযাতের এক স্বর্গীয় পরিবেশ বিরাজ করছে মসজিদ জুড়ে।
সকাল দশটায় সূফি আবূ তালেব ভাই সবাইকে জাগিয়ে তুলতেন। ধীরে ধীরে মিম্বারের সামনে জড়ো হতেন সবাই। বড় হুজুর সবার আগে উঠে চাশতের নামাজ পড়ে তেলাওয়াত শুরু করে দিয়েছেন। ইতিমধ্যে সবাই মিম্বারের সামনে জমা হয়েছে। হুজুর পর্দা ঘেরা অস্থায়ী হুজরা থেকে বের হয়ে আসতেন। হুজুরকে খুব চনমনে আর নূর-বিধৌত মনে হতো তখন। সাইয়্যেদুত ত্বাঈফাহ হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী রহ. এর ‘ইমদাদুস সুলুক’ বইটি থেকে হুজুর তা’লিম করতেন।
সেটার আবার ব্যাখ্যা করে করে বুঝিয়ে দিতেন। নিজে বইটির অনুবাদ করেছেন। তবুও ফকীহুন নাফস রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী রহ. এর ‘ইরশাদুল মুলুক’ থেকে পাঠ করতেন। এর কারণ আকাবিরদের নির্বাচিত শব্দ ও কথামালার ফয়জ ও বরকত গ্রহণ করা ছাড়া অন্য কিছু বলে মনে হয় না। তাসাউউফের জটিল বিষয়গুলোকে পানির মতো সরল করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। কখনো এক দেড় ঘণ্টা পার হয়ে যেতো সেই তা’লিমের, আমাদের মুগ্ধতা আর তন্ময়তা শেষ হতো না।
যোহরের সময় হয়ে যেতো প্রায়। নামাযের পর হুজুরের খলীফা, রংপুরের পীর সাহেব মাওলানা হুসাইন আহমদ সাহেবের মায়া জাগানিয়া কণ্ঠে এবার ১২ তাসবিহের জিকিরের হালকা বসবে। গুঞ্জনহীন এই নির্জন দুপুরে জিকিরে তখন অন্য রকম এক স্বাদ অনুভব হতো। সেই জিকিরের হালকায় হুজুর নিজেও বসেন। শুনেছি, একসময় হুজুর নিজেই মশক করাতেন, বৃদ্ধ বয়সে তাঁর জিকিরের জোর অবাক হয়ে দেখতো সকলে। সেবার কখনো কখনো আবার হুজরায় গিয়ে নিভৃতে তাসবিহ পাঠ করতেন। অস্থায়ী হুজরাখানার পর্দা নামানোর কাজে আমি আগে আগে থাকার চেষ্টা করতাম। বিছানা গুটানোর কাজেও আগে থাকতাম। যাতে করে হুজুরের চোখে পড়তে পারি। একটু-আধটু পরিচিত হতে পারি।
সেবার আমরা পাঁচজন সহপাঠী একসাথে ই’তিকাফে বসেছিলাম। আব্দুর রহমান, মাহতাব নোমান, হাজী ইমরান, হুজুরের কনিষ্ঠপুত্র সামনূন ও আমি। আমরা সবাই হুজুরের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করতাম এবং একটু আধটু হুজুরের কোনো খেদমত করতে পারলে গর্ববোধ করতাম।
দু’দিন পরে আমাদের উস্তায মুফতি ফয়জুল্লাহ আমান কাসেমী সাহেব ও মাওলানা রুহুল আমীন সিরাজী সাহেব দা.বা. এর অনুরোধে হুজুর তারাবির পরে আলেমদের নিয়ে প্রশ্নোত্তর মজলিসের জন্য সম্মত হলেন। সেই প্রশ্নোত্তরগুলো লিখে রাখার দায়িত্ব এলো আমার কাছে। এই সুযোগকে আমি লুফে নিলাম। প্রতিদিন সুযোগে থাকতাম কীভাবে হুজুরকে কোনো একটা প্রশ্ন করা যায়? কিন্তু একে তো সাহস হতো না, তার মাঝে আবার বড় বড় আলেমদের সামনে কি না কি প্রশ্ন করে বোকা বনে যাই সেই ভয়ে তটস্থ থাকি।
একদিন জিহাদ ও জঙ্গীবাদ নিয়ে আলাপ উঠলো। পৃথিবীব্যাপী তখন নব্য জঙ্গীগোষ্ঠি দায়েশের উত্থান। সেই রমজানেই বাগদাদী নিজেকে খলীফা ঘোষণা করে বাইয়াতের ডাক দিয়েছিলো। বাংলাদেশেও দায়েশী মতবাদের অনল ছড়িয়ে পড়েছে। তখন আমি সাহস করে হুজুরকে বাগদাদী ও দায়েশ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। হুজুর কৌশলে যে উত্তর দিয়েছিলেন তাতে কারোরই বুঝতে বাকি ছিলো না কী হতে যাচ্ছে পৃথিবীতে। ইরাক সিরিয়া লিবিয়া জুড়ে কী ভয়ঙ্কর দায়েশী ধ্বংসযজ্ঞ চলেছিলো, তা দেখতে আমাদের বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি।
ডায়েরিতে আমি সব আলোচনা টুকে রেখেছিলাম। কিন্তু সেটি হারিয়ে ফেলেছি। এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস অবলিলায় আমি হারিয়ে ফেলেছি, যেগুলো সঞ্চয় করলে বিরাট ইলমী সঞ্চয়িতা হতে পারতো।
জিকিরের হালকার পরে ছিলো ইনফিরাদি আমল কিংবা বিশ্রাম। আসরের পরে পবিত্র কুর’আনুল কারীমের দাওর। হুজুর সবসময় কুর’আনের নুসখা নিয়ে দাওরে বসতেন এবং গভীর মনোযোগে তেলাওয়াত শুনতেন। ইফতারের আগে হুজুর সবাইকে নিয়ে মুনাযাতে হাত উঠাতেন। সারাদিন রোযা রেখে ক্লান্ত কাতর দেহটি মোনাজাতের সময় এসে কী এক অদৃশ্য শক্তিতে বলিয়ান হয়ে উঠতো তা আমরা কখনোই ভেবে পেতাম না। দশ মিনিট, বিশ মিনিট, মাঝে মাঝে ত্রিশ মিনিট পর্যন্ত গড়াতো কান্না জর্জরিত মোনাজাত। অবুঝ শিশুর মতো অনবরত কেঁদেই যেতেন। মসজিদের প্রাচীর ভেদ করে কান্নার আওয়াজ ছড়িয়ে পড়তো দূরের আকাশ পর্যন্ত। অনেকের স্বীকারোক্তি, হুজুরের এই রোনাজারি পূর্ণ মোনাজাতটি পাওয়ার আশায় কেবল দূর দূরান্ত থেকে এখানে ই’তিকাফ করতে আসি।
ইফতারের পরে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে তারাবিতে দাঁড়িয়ে যেতেন। তারাবি শেষে দুরূদের খতমের আমল। শায়খ যাকারিয়া রহ. প্রণীত ৪০ দুরূদ ও সালামের সংকলনটি একজন পাঠ করতেন, বাকিরা মিম্বরমুখী হয়ে বসে বসে শ্রবণ করতেন। খতম শেষে আবার হুযুর দুআ করতেন। মসজিদের কদমের দিককার কিছু লাইট ছাড়া বাকিগুলো নিভিয়ে ফেলা হতো। আধো-অন্ধকারে খোদার প্রতি আত্মসমর্পণের এক আলোকিত পরিবেশের জন্ম হতো। বেজোড় রাতগুলোতে দুআ দীর্ঘতর হতে হতে আধাঘন্টা ছাড়িয়ে যেতো। কান্নার দমকে জ্বলে উঠতো পাপীআত্মার তমসাচ্ছান্ন কোণ।
রাতে আবার কিয়ামুল লাইলের জামাত অনুষ্ঠিত হতো। এমন জমজমাট কিয়ামুল লাইল দেশবাসী কখনো দেখেছে কিনা জানিনা। রাত বারোটা বাজার আগেই ইকরার মাঠ গাড়িতে ভরে যেতো। বিশেষ করে বেজোড় রাত্রিগুলোতে মাঠে গাড়ি পার্কিং এর ঠাঁই হতো না যেনো। পুরান ঢাকা, কাকরাইল, গুলশান থেকে মুসল্লীরা আসতেন কিয়ামুল লাইলে অংশগ্রহণ করতে। কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকলেও মসজিদের প্রায় সবাই জামাতে শরিক হতো। উস্তাযে মুহতারাম শাইখুল কুররা ওয়াল মুফাসসিরিন শায়খ আরীফ উদ্দীন মারুফ সাহেব দা.বা. এর হৃদয় উতলা করা মধুর তেলাওয়াতে শেষ রাতের বাতাবরণ ঘটতো।
আমরা যেখানে দুই রাকাত পড়ে ক্লান্ত হয়ে বসে যেতাম, হুজুরকে দেখতাম তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছেন। দীর্ঘ কিয়ামুল লাইলের মাঝে গরম গরম স্যুপ ও খেজুর দিয়ে মুসুল্লীদের আপ্যায়ন করা হতো। এই সময়টায় হুজুর একটা চেয়ারে বসে বিশ্রাম নিতেন। পারতপক্ষে হুজুর কখনো বসে নামাজ পড়তেন না। ফরজ নামাজ তো বসে পড়ার চিন্তাই করা যায় না। রোগ-শোকে আকীর্ণ দেহে এই বার্ধক্যবেলায় এখনো তিনি নির্বিঘ্নে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়েন। রুহানী শক্তির কোন মার্গে অধিষ্ঠান লাভ করলে শারীরিক অক্ষমতাকে উপেক্ষা করে আত্মার প্রতি মানুষ এতোটা অনমনীয় দার্ঢ্যমান হয়ে উঠতে পারেন ভেবে পাই না।
কিয়ামুল লাইলের পর আবার মোনাযাতে তাঁর কান্নায় ভেঙ্গে পড়া। রাতের শেষ প্রহরের নিরবতার সাথে মিশে একাকার হয়ে যেতো ‘মালিক, ও মালিক’ আহাজারি।
এভাবেই দশটি দিন কেটে যায়। ই’তিকাফের দশদিন এভাবে কেটে যায় প্রতিটি মু’তাকিফ মুসল্লির, আমলে আমলে, দুআয় আর মহামহিমের দরবারে অঝোরধারার কান্নাকাটিতে। ঈদের চাঁদ যখন দেখা দিলো, মনটা ভেঙ্গে চৌচির হয়ে গিয়েছিলো এই দশটি দিনের মায়ায়।
আমি তেরোটি বছর ধরে আছি হাজিপাড়া এলাকায়। ১০টি বছরে দেখিনি হুজুরকে ই’তিকাফ ছাড়া থাকতে। বিগত দুয়েক বছর ধরে সদাঋজু এই মানুষটি আর অসুস্থতার সাথে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। ভেতরের বাঁধ ভাঙ্গা ইচ্ছা থাকলেও দেহে ভর করেছে শতাব্দির ক্লান্তি। রমযানে ই’তিকাফ ছাড়া বাসায় বসে থাকা এই কর্মবীর মানুষটির জন্য কতটা কষ্টকর, কত বেশি মর্মপীড়ার আমরা কিছুটা বোধ করতে পারি। গতকাল থেকে মসজিদে মসজিদে ই’তিকাফ শুরু হয়ে গিয়েছে। এবারও তিনি মু’তাকিফের বেশে আসতে পারেননি চৌধুরী পাড়া হাজিপাড়া ঝিল মসজিদে। এই মহল্লার আকাশ-বাতাস, ধূলিকণা, ঝিল মসজিদ তাঁকে খুঁজে ফিরছে। তিনিও হয়তো খুব ভালো নেই তিন দশক কাটিয়ে দেওয়া এই ঝিলের মাটি ও মসজিদকে দূরে রেখে।
প্রিয় পাঠক, আপনি যদি এই লেখা পড়ে থাকেন তাহলে ছোট্ট একটা অনুরুধ করবো। আমাদের হুজুরের জন্য একটু দু’আ করুন, তিনি যেনো সুস্থ সবল ও বলিয়ান হয়ে মু’তাকিফের বেশে আবার ঝিল মসজিদে আসতে পারেন। শেষ রাতের কান্নায়, সাঁঝের মোনাজাতে আমাদের পাপমলিন জীবনকে পুন্যের প্রভাতে আবার রাঙিয়ে দিয়ে যান।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, আত তুরাস একাডেমি ও ইমাম শাইবানী ফিকহ একাডেমি। সাবেক মুহাদ্দিস, জামিআ ইকরা বাংলাদেশ।