আমাদের কি লজ্জা-শরম হবে না কোনদিন?

আমাদের কি লজ্জা-শরম হবে না কোনদিন?

আমিনুল ইসলাম কাসেমী ❑ উস্তাদ আল্লামা আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া রহ.। তিনি আমাদেরকে ক্লাশে মাঝে মাঝে তাঁর শ্রদ্ধেয় পিতার সংগ্রামী জীবনের কথা শোনাতেন। আবুল ফাতাহ সাহেবের পিতা একজন প্রতিভাধর আলেম ছিলেন। ময়মনসিংহ জামেয়া ইসলামিয়া, চরপাড়া-এর মোহতামিম পদে অনেক বছর খেদমত করেছিলেন তিনি। একজন আলেম এবং বুজুর্গ হিসেবে ময়মনসিংহ এলাকায় বেশ খ্যাতি ছিল তাঁর।

আবুল ফাতাহ সাহেব বলতেন, আমার পিতা মাদ্রাসার বেতনের উপর কখনো নির্ভরশীল ছিলেন না। মাদ্রাসার তরফ থেকে কোন হাদিয়া আসলেও ভাল, আবার না আসলেও আলহামদুলিল্লাহ। তিনি মাদ্রাসার ক্লাশ করে বাড়ীতে এসে বসে থাকেন নি কখনো। নিয়মিত সাংসারিক কাজ কর্ম করেছেন। সবজি চাষ করেছেন বাড়ির আঙিনায়। যতটুকু ফসলি জমি ছিল, নিজেই ফসল ফলানোর ব্যবস্থা করেছেন। এ কারণে মাদ্রাসার তানখার উপর কখনো নির্ভর করেন নি।

আমি আমার ছোট বেলার উস্তাদদের দেখেছি, তাঁরাও কখনো মাদ্রাসার বেতন কে নিজের সংসার চালানোর চাবিকাঠি মনে করেন নি। দরস শেষ হলে, নিজের হাতে কামাই করার চেষ্টা করেছেন। একজন শ্রদ্ধেয় উস্তাদকে দেখেছি, ছাত্রদের পড়ানো শেষ হলে কিতাব বাঁধাই করতেন। পুরাতন কোরআন শরীফ, খাতা, ছেঁড়া কিতাবাদি বাঁধাই করে টাকা রোজগার করে সংসার চালিয়েছেন।

আমাদের পূর্বসুরী বুজুর্গানে দ্বীনদের এরকম সিফাত ছিল। মাদ্রাসার ছবক শেষে নিজ হাতে কিছু কামাই করার চেষ্টা করেছেন। কেউ লেখালেখি, কিতাব রচনা, অনুবাদ, প্রেসের কাজ, প্রুফ দেখা, এসব কাজে জড়িত হয়ে যা কিছু রোজগার হয়েছে। তা দিয়েই চলেছে সংসারের ভরণ-পোষণ।

কত বুজুর্গ টুপি সেলাই করতেন, জামা সেলাই করেছেন, আতরের ব্যবসা করেছেন। ইসলামী জগতের অনেক বড় পন্ডিতদের এভাবে নিজের হাতেই কামাই করতে দেখা গেছে। হাদীসের দরসের পাশাপাশি হালাল উপার্জনের রাস্তা তাঁরা বেছে নিয়েছেল।

ইলমে হাদীসের ময়দানে বহু রাবী, হাদীস বর্ণনাকারী, মুহাদ্দিসদের জীবনীর দিকে তাঁকালে দেখা যায়, তাঁরা শিক্ষকতার জন্য কোন বেতন গ্রহণ করেন নি। আল্লাহর ওয়াস্তে খেদমত করে গেছেন। তবে তাঁদের সংসার পরিচালনার জন্য নিজ হাতে কোন পেশায় যুক্ত থেকেছেন। একজন হাদীসের বর্ণনাকারী পাওয়া যায়, ‘ইসকাফী’ তাদের নামের শেষে তাঁর কর্মের পরিচয় তুলে ধরেছেন। ইসকাফী মানে আমাদের পরিভাষায় বলে মুচি। যে নাকি জুতা সেলাই করেন। একজন প্রখ্যাত মুহাদ্দিস, হাদীসের বর্ণনাকারী, তিনি অবসরে জুতা সেলাই করে তাঁর জীবিকা নির্বাহ করেছেন। কত আলেমের নামের শেষে দেখা যায়, ‘খাইয়্যাত’। খাইয়্যাত মানে দর্জি। অবসরে দর্জিগিরী করে যা উপার্জন হয়েছে, তা দিয়েই চলত সংসার।

কেউ যদি মাদ্রাসার খেদমতের পাশাপাশি অন্য কোন ব্যবসা-বাণিজ্য বা কোন আয়-রোজগারের রাস্তা বের করলে উল্টো ফতোয়া দেই।

পূর্বসুরী বুজুর্গানেদ্বীন কোন পেশা খাঁটো চোখে দেখেন নি। তাঁরা কোন হালাল কামাইকে ছোট করেন নি। বরং মাদ্রাসার খেদমতের পাশাপাশি সানন্দে চিত্তে নিজের উপার্জনের রাস্তা বেছে নিয়েছেন। মাদ্রাসায় তালিবুল ইলমের হক পুরোপুরি আদায় করে তারপরে নিজের আয়ের পথ বেছে নিয়েছিলেন তারা। এমন ও নয় দরস-তাদরীসে কোতাহী করেছেন কখনো।

বর্তমানে আমাদের বড় এক রোগ হল, সাধারণ কোন পেশাকে খাঁটো চোখে দেখি। কেউ নিজ হাতে কিছু উপার্জন করতে চাইলে বাঁকা দৃষ্টি পড়ে সেখানে। কেউ যদি মাদ্রাসার খেদমতের পাশাপাশি অন্য কোন ব্যবসা-বাণিজ্য বা কোন আয়-রোজগারের রাস্তা বের করলে উল্টো ফতোয়া দেই। নিরুৎসাহী করা হয়। অনেকে গোমরাহ ভাবেন!! ইলম থেকে মাহরুম হয়ে যাচ্ছে!!! আরো কত কি!!

অথচ আমরা মাদ্রাসার জন্য ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে করতে লজ্জাবোধ করিনা। রশিদ বই বোগল দাবা করে ছুটছি দুনিয়াদ্বারদের পিছনে। লাঞ্চিত-অপমানিত হচ্ছি বারবার। মানুষ ঘৃনার চোখে দেখছে, তারপরেও আমাদের যেন কোন শরম-লজ্জা থাকছেনা।

রমজানে যাকাত আদায়ের জন্য ছুটে বেড়াই সারা মাস। এই টাকা কালেকশন করতে গিয়ে মাহে রমজানের ইবাদত বন্দেগীতে শরীক হতে পারেন না হাজারো আলেম-মোহতামিম-শিক্ষকগণ। কতজন যে তারাবীর নামাজ ছেড়ে দেন শুধু চাঁদা কালেকশন করার জন্য। এরপরেও কিন্তু অনুভূতি জাগেনা আমাদের। কেউ নিজের হাতে কামাই করার চেষ্টা করিনা।

এই যে দেখুন! কোরবানীর সময় কি অবস্থা হয় আমাদের। রক্তে ভরে যায় কোরবানীর চামড়া টানতে টানতে। মানুষ মিসকিন মনে করে। একটা শিক্ষিত, ধনী পরিবারের ছেলেকেও মানুষ মিসকিন ভাবে। অত্যান্ত করুণ ভাবে মানুষের দ্বারে দ্বারে যেতে হয়। সুদ খোর, ঘুষ খোর, মদ খোর, গাঁজা খোর, সবার কাছে নত হয়ে চামড়া কালেকশন করতে হচ্ছে আমাদের। শুধু কি যাকাত আর চামড়া? বাঁশ, ধান, পাট, পিয়াজ, রসুন, কাঁঠাল মোটামুটি মৌসুমী ফসল যা আছে, সব কিছু কালেকশনে নামতে হচ্ছে। আর মানুষ আমাদেরকে খাঁটো চোখে দেখছে সব সময়।

আজকাল হক কথা বলতে গেলে, একদল গালি দেয়, যাকাত-ফেতরা খোর বলে। আমরা রাজপথে কোন আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গেলে ওরা বলে ‘যাকাত খোরের দল ক্ষেপে ওঠেছে।’

এরপরেও কি আমাদের লজ্জা হবেনা। নাকি লাজ- স্মরমের মাথা খেয়ে ফেলেছি আমরা। এই সংকটময় মুহুর্তে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। যদি আমরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারতাম। নিজে কামাই করে কিছু উপার্জন করতাম, তাহলে এই দীর্ঘ লক ডাউনে কওমীর শিক্ষকদের বেহাল দশা হতনা। মাদ্রাসা বন্ধ, ব্যস, শিক্ষকদের চুলা আর জ্বলেনা। কেননা, আমরাতো সবাই মাদ্রাসার বেতনের উপরে নির্ভরশীল। আর মাদ্রাসা বন্ধ হলে তো কেউ চাঁদা দিতে আসছেনা। কেউ যেতে পারছেনা বাইরে। একটা মহা সংকট।

আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। লাঞ্চিত-অপমানিত হয়ে আর চাঁদা নয়। যাকাত-ফেৎরার জন্য ধনীর দ্বারে ঘোরা নয়। নিজে কিছু করতে হবে। নিজে হাতে কামাই করার চেষ্টা করে যেতে হবে। মাদ্রাসার তালিমের পাশাপাশি হালাল উপার্জনের ব্যবস্থা থাকা উচিত সকলের। আল্লাহর ওয়াস্তে আর কেউ ফতোয়া দিবেন না। মাদ্রাসায় পড়ানো বাদ দিয়ে অন্য কিছু করলে সে গোমরাহ হয়ে গেছে। ইলম থেকে মাহরুম হয়েছে। এভাবে যদি নিরুৎসাহী করি, তাহলে কখনো আমাদের অবস্থার পরিবর্তন হবেনা।

কোন পেশাকে ছোট করা যাবেনা। আজকাল আমাদের পেষ্টিজ খুব বেশী। আমি আলেম হয়ে অমুক পেশার কাজ করব? এই বলে ঘরে বসে থাকি। নিজে গায়ে খেটে কিছু করে খাওয়া উত্তম, নাকি ভিক্ষা ক্ষারের খাওয়া উত্তম? হোক না ছোট পেশা। আমরা কি করতে পারিনা। টাকা কামানোর বহু সুরত রয়েছে। দ্বীনি তালিম দিব আমরা পুরোপুরি। এরপর ছড়িয়ে পড়ব হালাল রুজি কামানোর জন্য।

তাই আসুন! আমরা এই ডাক পৌছে দেই কওমীর ঘরে ঘরে। আর কারো দ্বারে দ্বারে যাওয়া নয়। নিজে কিছু করি। যদি আমাদের আহবানে কেউ না আসে অন্তত একলা চললেও চলতে হবে। এজন্য কবি বলেছেন- ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে/ একলা চলরে একলা চলরে।’ আল্লাহ তায়ালা কবুল করুন। আমিন।

লেখক: শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *