আরবের দিনলিপি ।। পর্ব- ২১

আরবের দিনলিপি ।। পর্ব- ২১

  • কাউসার মাহমুদ

সারাদিন পর এই মধ্যরাতে লিখতে বসেছি। অদ্ভুৎ এক অভ্যেস তৈরি হয়েছে আমার। আশ্চর্য এক দোদুল্যমানতা। এই বসব, বসছি করে কীভাবে যেন কয়েকটা দিন চলে যায়। তারপর অসময়ে নিতান্ত অপারগ হয়ে লিখতে বসি। আজও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি নিশ্চয়। যেন ইচ্ছের স্বেচ্ছাচারিতাকে কোনোক্রমেই পরাস্ত করতে পারি না। যদিও নানাবিধ আখ্যান তৈরী করে রাখি মস্তিস্কে। বিস্তর পরিকল্পনা সাজাই। তবু কোথা থেকে যেন দৈবর মত আলস্য এসে ঘিরে ধরে। ঠিক ফেব্রুয়ারীর এ সময়টার মত স্যাঁতস্যাঁতে। যখন সকালে কালো মেঘে আকাশটা ঢেকে থাকে। দুপুর নাগাদ ঈষৎ রোদের ঝলক। বিকেলে পরিস্কার আবহাওয়া। তারপর সন্ধ্যা নামতেই হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা বায়ূর সাথে পেঁজা তুলোর মত আবার সেই খণ্ডবিখণ্ড মেঘের আস্ফালন।

আজ মঙ্গলবার। সেই রোববার থেকে টানা তিনটা দিন একই নিয়মে চলছে। এখানের প্রকৃতি বুঝি মুখস্থের মত। বুঝতেই পারছি কখন কোন হাল হবে। সেইসাথে ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন হচ্ছে আমার মনোভঙ্গিও। যেন বিরস দুশ্চিন্তাগ্রস্ত এ হৃদয় ও মগজ থেকে আর মুক্তি নেই। প্রতি মুহুর্তে যার চিন্তা নানাবিধ বিষয়ে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। ফলে কোথাও যে এক দণ্ড সুস্থির হয়ে উপগত হবে, সে সুযোগ নেই।

এখানের প্রকৃতি বুঝি মুখস্থের মত। বুঝতেই পারছি কখন কোন হাল হবে

এই যেমন পাঠের কথাই বলা যাক। গত তিনদিনে গুনে গুনে তিনটি বই ধরেছি। যার একটিও নির্দিষ্টভাবে এগুতে পারছি না। ফলে নিজের পঙ্কিল জীবনের কথা ভেবে যদি ভয়ে কাতর হয়ে পড়ি। যদি হতাশায় মুষড়ে পড়ি। যদি ইহজাগতিক বঞ্চনাগুলো জেঁকে ধরে। যদি সুধীর জোছনার মত পরকাল কাছে আসে মনে হয়। তখন ডক্টর মুস্তফা মুরাদের ‘মালাকুল মাউত ওয়াল আম্বিয়া’ পড়ছি। কিন্তু এ পাঠ বড় স্বল্প সময়ের। একবার মাঝে ছেদ পড়ল তো পরে আবার উর্দু উপন্যাস ‘পীরে কামেল’ নিয়ে বসছি। এ-ও স্থায়ী নয়। ভাবি খুশবন্ত সিংয়ের ‘দিল্লীতে’ যে খাসা বর্ণনা—ওটা শেষ করা দরকার। তখন আবার সেটা নিয়েই পড়ি। পড়তে পড়তে মনে হয়, লোকটা কোনোকিছুরই তোয়াক্কা করেনি। না ভাষা, না বর্ণনা। লেখককূলের মাঝে নিঃসঙ্কোচ যাদের বলা যায়, তিনি তাঁদেরই একজন।

Lady J.H.T অনুচ্ছেদ থেকে একটু নমুনা দেখুন। “We go along the Mathura-Agra Road, cross the ancient Barapulla bridge. The Rolls-Royce switches off its headlights. The morning light reveals scores of defecating bottoms. We go over the railway bridge, past Friends Colony and through the stench exuded by the sewage disposal farm. We bump past the Road Research Institute. We go through the village Badarpur, turn off the main highway and ride into the rising sun. The fields are littered with defecators; some face us with their penises dangling between their haunches; others display their buttocks–barely an inch above pyramids of shit. The Indian peasant is the world’s champion shitter. Stacks of chappaties and mounds of mustard leaf-mash down the hatch twice a day; stacks of shit a.m. and p.m.”

দস্তয়েফস্কির ‘হোয়াইট নাইটস’ গল্পের সেই অস্থির যুবকের মতো মনে হয় নিজেকে। যেন আকাঙ্খিত কোনো বস্তুই করতলগত হচ্ছে না

সে যাহোক, আমি মূলত আপন সত্তার দ্বান্দ্বিক অবস্থাটির কথা বোঝাতে চাইছি। মনে হয়, এ অশান্তি, দ্বন্দ্ব ও প্রতিকূলতার কথা ধারাবাহিক এ দিনলিপির বেশ কিছু জায়গাতেই উল্লেখ করেছি। পাঠকের জন্য যা বিরক্তির কারণ হতে পারে। কিন্তু কী করব বলুন। দস্তয়েফস্কির ‘হোয়াইট নাইটস’ গল্পের সেই অস্থির যুবকের মতো মনে হয় নিজেকে। যেন আকাঙ্খিত কোনো বস্তুই করতলগত হচ্ছে না আমার৷ পার্থিব জগতে কী চাই—তাও নির্দিষ্ট নয়। সমস্ত সময় কেবল দুর্ভাবনা আর অনিশ্চিয়তায় মোড়া। মাঝেমাঝে ভাবি, এ হয়তো আমার শিল্প-মানসেরই করুণ দশা। যাতে যাবতীয় সমাচারই অর্থবহ এক দোদুল যন্ত্রণায় ঘেরা। যেকোনো স্থান, সময় এমনকি অনেক মানুষের ভীড়ের মাঝেও যা আমায় আক্রান্ত করতে পারে। আর ফার্নান্দো পেসোয়ার মত ভ্রমের ভেতর গিয়ে মনে হতে পারে, ‘Everything around me is evaporating. My whole life, my memories, my imagination and its contents, my personality – it’s all evaporating. I continuously feel that I was someone else, that I felt something else, that I thought something else. What I’m attending here is a show with another set. And the show I’m attending is myself.
― Fernando Pessoa, The Book of Disquiet (ফার্নান্দো পেসোয়া : বহুল দেবতা, বহু স্বর/ রাজু আলাউদ্দিন)

এসব ভাবতে ভাবতে রজনী দীর্ঘ হয়। এত দ্রুত সময়গুলো চলতে থাকে, যেন বোরাকের পিঠে চড়ে ছুটছে। তখন মজনু শাহর কবিতার মত বলতে ইচ্ছে করে, ‘ধীরে রজনী, ধীরে।’ কেননা রাত্রিই আসলে যন্ত্রণাকাতর মানুষের নিঃসংশয় গৃহ। সুখী মানুষেরা এ সময় হয়তো সম্ভোগ ও সম্ভাষণ করে। দুঃখীরা কল্পনার সরোবরে ভাসতে থাকে। কল্পনা ও রাত্রি— এ দুটি জিনিসের পূর্ণ সংমিশ্রণ হলে তো হলোই৷ হয় সে রাতে তাঁদের কুসুম নিদ্রা হবে, নয় নির্জন নিদ্রাভঙ্গ।

ক্ষুধা ও যৌনতা।’ বহুদিন আগে কোনো এক দার্শনিক প্রবন্ধে পড়েছিলাম , জগতে সামগ্রিকভাবে অনিষ্টির কারণ এ দুটো বস্তু

এ-সময় বিশেষত দুটো জিনিস প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। ‘ক্ষুধা ও যৌনতা।’ বহুদিন আগে কোনো এক দার্শনিক প্রবন্ধে পড়েছিলাম , জগতে সামগ্রিকভাবে অনিষ্টির কারণ এ দুটো বস্তু। কথাটি শ্রবণে অতি তরল বোধ হলেও, মনে হয় এর প্রাসঙ্গিকতা সত্যিই বাস্তবধর্মী। পৃথিবীতে অসহায় দুঃখী মানুষগুলোর প্রতি সে মমতাই আমার হয়, যে মমতা নিজের প্রতি। হ্যাঁ, এ সত্য যে আমি নিরন্ন নই। অনাহারে থাকি না। কিন্তু কেবলই ক্ষুধা ও এর নিবারণ মানেই যে আনন্দ ও স্বচ্ছলতা তা কিন্তু না। বরং মানুষের জীবনে এমন অবস্থাও আসে, যখন তাঁরা খানাখাদ্য নিয়ে বসে, গলাধঃকরণ করতে পারে না। যখন শয্যায় যায়, ঘুমুতে পারে না। যখন কাউকে ভালোবাসে, বলতে পারে না। যখন শৃঙ্খলহীন সবল হাত পা নিয়ে বিচরণ করে, কিন্তু জীবনের পরাধীনতা থেকে বেরুতে পারে না।

এই পরবাস জীবনে এমন অসংখ্য মানুষ দেখলাম। সকলেই জীবনের কাছে পরাধীন। সকলেই বিপদাপন্ন। তাঁদের ঘনিষ্ঠ হলে, আশ্চর্য এক বিষয় চোখে পড়ে। তা সে দুঃখই। যা প্রত্যেকের কাছেই অন্যের চেয়ে অধিকতর। ঘোরতর। অবর্ণনীয় এবং মর্মান্তিক। এখানে আবার দুটি ভাগ লক্ষ্যনীয়। তারা কুমার ও পতি গোত্রীয়। কুমারেরা সাধারাণত মাতৃভক্ত। পতিরা স্ত্রী-প্রেমী। তাদের জীবনে প্রধান যে বিপত্তিটি ঘটে থাকে তা বড় রসাত্মক। ফলে বিদেশে থাকা প্রতিটা পতি পুরুষের একটাই ব্যথা যে, পরিবার তাকে স্ত্রী-ভক্ত রূপে গণ্য করে। এখানে প্রেম আর ভক্তির বিষয়টি গুলিয়ে যায়। বিবাহের পূর্বে যে কুমার বহুবিধ সঙ্কটে পদপিষ্ট, পরে তাঁর কপালে জোটে বউ-প্রিয়তার দোষ। ফলে পূর্বাপর সর্ববস্থাতেই সে থাকে যন্ত্রণাদগ্ধ। বধূ ও মাতা উভয়ের মান ও মন রক্ষায় সন্দিগ্ধ।

 

১৩ ফেব্রুয়ারী সোমবার, ২০২৪

ক্রমশ..

লেখক, কবি ও কথাসাহিত্যিক

আরবের দিনলিপি ।। পর্ব- ২০

আরবের দিনলিপি ।। র্পব-0১

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *