আরবের দিনলিপি-৬

আরবের দিনলিপি-৬

 

  • কাউসার মাহমুদ 

গত পর্বের পর 

মাঝেমাঝে হৃদয়টা পাথরের মত ভার হয়ে থাকে৷ এর হেতু কী? কেন যে প্রায়শই এমন হয় বুঝতে পারি না। না আনন্দ না নিরানন্দ, না সুখ না দুঃখ, না বর্ণিল না বর্ণহীন অজ্ঞাত এক বিস্বাদ হাত-পা ছড়িয়ে থাকে সারা চরাচরে। যা বড় ক্লান্তির। ভীষণ অস্বস্তি ও নির্মম ব্যাধির। সেসময় না বসতে ভালো লাগে, না হাঁটতে। না কাজে ভালো লাগে না কিছু করতে। ফলে যা-কিছুই করি না কেন দৈবাৎের মত যেন তাতে ত্রুটি ঘটে। অশুভের মত অদৃশ্য কিছু এসে তাতে ভর করে। সামগ্রিকভাবে যেসবের জের টানতে হয় ব্যক্তির।

মানে এখানে আমার গতকাল থেকে তেমনই এক গুমোট পরিবেশ স্থায়ী হয়ে আছে মনে। রাতে গুরুভার আহারও পরিপাকতন্ত্রের জন্য সুখকর হয়নি। ফলে বারবার নিদ্রাভঙ্গ হয়েছে। ভোরে টনটনে মাথাব্যথা নিয়ে কাজে যেতে হয়েছে। আমাদের মত শ্রমজীবী মানুষের যা থেকে কোনও নিস্তার নেই। অতএব অসুখী মনোভাব নিয়ে কাজে গেলে যা হয় তাই হল। পুনঃপুন কয়েকটি ভুল ঘটল। তাতে মালিকের রাগ চটল। কয়েকটি শক্ত কথা শুনলাম আর প্রবলভাবে মন খারাপ পেয়ে বসল।

দুপুরের বিরতিতে এলাম। সামান্য আহারাদি গ্রহণ করে তড়িৎ উঠে গেলাম। ইয়েমেনীদের তাবুতে গিয়ে কিছুক্ষণ চোখ বুজে এপাশওপাশ করলাম যদিও, মনের তিক্ত ভাবটা গেল না। এখানে ইয়েমেনীদের কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে পারি। শীতে বড় কাবু হয়ে থাকে ওরা। এর কিছুটা যদিও আরবীয় বৈশিষ্ট্যগত, তবে তাতে আলস্যই লক্ষনীয়। কেননা শীতে ওরা সমস্ত সময়ই জুতোমোজা পরে শুয়ে-বসে থাকে। আহারাদি পর্যন্ত ওভাবেই করে ঠিক। কিন্তু প্রবল গরমেও এ স্বভাবে বিশেষ পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় না ওদের। বহুদিন দেখেছি মধ্যরাতে কাজকর্ম ছেড়ে এসেছে, তৈলাক্ত পোশাক, ঘর্মাক্ত ও দুর্গন্ধ শরীরে—কেবলই মুণ্ডুখানা ধুয়ে সটান বিছানায় চলে গেছে। কেবল জুম্মার দিনে ওদের এই ব্রত ভাঙ্গে। তাও ঠিক নামাজের কিছু পূর্বে। তখন সকলের যে গোসলের হিড়িক, সকলেরই যে তাড়াহুড়ো— তা বড় বিস্ময় জাগানিয়া।

আমাদের কল্পনাগুলো কী অদ্ভুৎ তাই না! নরওয়েজিয়ান উড পড়ে এতকাল যে মুরাকামিকে কল্পনা করে এসেছি, তাঁর পদক্ষেপ দেখে তাতে বিভ্রান্তই হলাম

পরস্পর গালমন্দ, ভর্ৎসনাসহ এমনসব বিচ্ছিরী শব্দের প্রয়োগ—অসম বয়সী বয়স্কদের সামনে তো দূরের কথা, আমরা বাঙালিরা কখনও তা সমবয়সীদের সামনেও অমন অনায়াসে উচ্চারণ করতে পারব না। শুনেছি এবং সাক্ষাৎ দেখেছিও কেবল সহোদর সহোদরে কেন বরং পিতাপুত্রও এমন সব কথা বলে ফেলে, আমাদের সমাজে যা খুবই অসমীচীন। তেমনি পার্শ্ববর্তী কামরা হওয়ায় ভোর অবধি ওদের হৈ-হল্লাও শুনতে হয়েছে আমার। বৃহস্পতিবার রাতে যা নিরবিচ্ছিন্ন উৎপীড়ন হয়ে আবির্ভূত হয়। তামাক, হুঁকো আর সিগারেট নিয়ে সেই যে বসে, ভোরবেলা জলবিয়োগ করতে গেলে বহুদিন অমনই জাগ্রত দেখেছি। ফলে কিছুটা উন্মত্ত ও খামখেয়ালি মেজাজের তিন চারটি ইয়েমেনীর সঙ্গে সজ্ঞানেই বিবাদ এড়িয়ে কিঞ্চিৎ সখ্যতা করার প্রয়াস চালিয়েছি। যার ফল এই। দুপুরে আহারের পর মাঝেসাঝে ওদের নির্জন তাবুতে গিয়ে বিশ্রামের সুযোগ।সহসা কোনদিন আগ্রহ জাগলে দু’এক চিমটি তামাকের নিরাপত্তা।

সেই হেতু আজও ওখানেই শুয়েছিলাম। কিন্তু চোখ দুটি যখন না মুদার ব্রত নিয়েছে, অগত্যা বুদ্ধদেব বসুর ‘আমার ছেলেবেলা’ পড়তে বসলাম। আহা! এমন সুস্বাদু একটি বই। এত কোমল তার গদ্য। এত অভিজাত তার ভাষা। গতকাল শুরু করতেই যেটি চল্লিশ পৃষ্ঠা পড়ে ফেলেছি। আজ সেটি কোনোক্রমেই এগুতে পারছি না। কিছুতেই মনঃসংযোগ নিবদ্ধ করতে পারছি না। নিশ্চয় তা আমার মনের এই অস্থির অবস্থার কারণে। যাতে সবকিছু বিস্বাদ ঠেকছে। নিয়মিত অতিবাহনে ছন্দপতন হয়েছে। তথাপি মনের এই ঈষৎ মেঘলা ভাবটি কাটাতে আবারও বইটি নিয়ে বসলাম। কেননা বসুর রচনার বৈচিত্র্যের মাঝে একবার যে অবগাহন করেছে, হাতের বইটির সমাপ্তি ছাড়া তাতে তার তৃপ্ত হওয়ার অবকাশ নেই।

এমনকি এই তো গত পরশুই মহান হারুকি মুরাকামি স্পেনের Princess Asturias award পেলে ডায়েরিতে এই দুটি বাক্য টুকে রেখেছিলাম, ‘আমাদের কল্পনাগুলো কী অদ্ভুৎ তাই না! নরওয়েজিয়ান উড পড়ে এতকাল যে মুরাকামিকে কল্পনা করে এসেছি, তাঁর পদক্ষেপ দেখে তাতে বিভ্রান্তই হলাম। মনে হল, এমন শান্ত খর্বকায় একটা মানুষ, বুঝি যাবতীয় কোলাহল পেছনে ফেলে অসংযতভাবে কয়েক কদম হাঁটলেন। অথচ, রচনায় শৈল্পিক যৌনতা বলতে যা বুঝেছি, তাঁর প্রথম পাঠ দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু ‘রাত ভরে বৃষ্টিতে।’ তারপর মান্টো ও চুগতাইয়ের গল্প এবং মুরাকামির ‘নরওয়েজিয়ান উড।’

(২৩ অক্টোবর রবিবার)

চলবে..

লেখক, কবি, বহুগ্রন্থ প্রণেতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *