- আমিনুল ইসলাম কাসেমী
বর্ষা আর শরৎকাল জুড়ে পদ্মার ভরা যৌবন। সেই সাথে তীব্র হাওয়ায় শুরু হয় উত্তাল ঢেউ। পদ্মার করালগ্রাসে থেমে যায় কত মানুষের জীবনযাত্রা। হাজারো বাড়ি-ঘর, জায়গা-জমি বিলীন হয়ে যায়। পদ্মার উত্তাল ঢেউ উপেক্ষা করে লঞ্চ পার হয়েছি বহুবার। ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেতেও পদ্মা পার হতে হয়েছে। লঞ্চ আর বড় বড় ফেরীগুলো পদ্মার ঢেউয়ের তোপে থাকে টালমাটাল। কখনো বিশালাকার ঢেউ ফেরীর উপরে আছড়ে পড়ে, কখনো লঞ্চগুলো পানিতে ডুবু ডুবু হয়ে যায়।
মহান আল্লাহর মেহেরবানীতে এবার আর লঞ্চ পার হওয়া লাগেনি। উত্তাল ঢেউ আর ছুতে পারেনি। পদ্মার বুক চিরে এখন বিশাল সেতু। এপার ওপারের মহামিলন ঘটে গেছে। বালু-পাথর জমিয়ে বন্ধন এখন মজবুত। যাকে বলে সেতুবন্ধন।
প্রভাতের হিমেল হাওয়ায় রাজবাড়ি থেকে রওনা হলাম। সরাসরি ফরিদপুর শহর। ফরিদপুরের বাস ষ্টপেজ থেকে ঢাকাগামী গাড়িতে চেপে বসলাম। পদ্মা সেতু হয়ে এখন ফরিদপুর থেকে গাড়ি ছাড়ছে। কোথাও আর যাত্রা বিরতি নেই। সকাল সাতটায় গাড়ি ছেড়ে দিল। ঘড়ির টাইম যখন ৮.৩০ মিনিট। পৌছে গেলাম ইটপাথরের দালানে ঘেরা ঢাকা শহরে।
বড় আশ্চার্য এক ব্যাপার। ফেরী ঘাটে যেখানে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে হয়েছে। সে তুলনায় নিমিষেই যেন চলে গেলাম ঢাকাতে। তাও আবার স্বপ্নের গুলিস্তান, বঙ্গবাজার, বাবু বাজার, ইংলিশ রোডের মত ব্যস্ততম এলাকাতে।
সকাল সাড়ে আটটা। ঢাকা তখনো কিছুটা ফাঁকা। নগরি প্রাণচাঞ্চল্যতা ফিরে পায়নি। সেই মুহুর্তেই গুলিস্তান, গোলাপশাহ মাজার এলাকাতে পায়ে হেঁটে যাচ্ছি। বড় ফুরফুরে মেজাজে ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে। এত অল্প সময়ে এই প্রথম ঢাকাতে আগমণ। মন ভরে গেল।
ঢাকাতে পৌছে গেলেও আমার কাজ শুরু হতে অনেক দেরী। কেননা আজকে অন্য কোনো কাজ নেই। পদ্মা সেতুর বন্ধনের সাথে এবার ইসলাহী বন্ধন মজবুত করার অঙ্গিকার নিয়ে ঢাকায় আসা। এতদিন ঢাকায় আসতে যথেষ্ট বেগ পেতে হত। ফেরী ঘাটেই দিন পার হয়ে যেত কখনো। রাজধানীর জামিআ ইকরাতে প্রতি মাসে ইসলাহী ইজতেমা হয়। কিন্তু যাতায়াত সমস্যার কারণে সময় মত থাকতে পারিনি। যার কারণে প্রিয় শায়েখের ইসলাহী প্রোগ্রামগুলো এতদিন অধরা ছিল। এবার পদ্মার উপরে নতুন ব্রীজ। ঢাকায় আসা এখন অনেকটা সহজ। তাইতো ইসলাহী সেতু বন্ধনের প্রত্যয় নিয়েই ঢাকায় সফর করার সিদ্ধান্ত।
প্রিয় শায়েখ শাইখুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ সাহেব এখন জীবন সায়াহ্নে। বয়স তাঁর সত্তোর্ধ। পুরো জীবন সংগ্রামে কেটেছে তাঁর। একদিকে তালিম অন্যদিকে লেখালেখি। উভয় ময়দানে বীরদর্পে কদম রেখেছেন। সেই ষাটের দশক থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু। এরপর শুরু হয় অধ্যাপনা। উভয় ময়দানে তিনি যেন বীর বিক্রম। কেননা তাঁর মত কলম সৈনিক এবং ইলমে হাদীসের ময়দানে মুকুটহীন বাদশাহ পাওয়া মেলাভার। যেরকম লেখনিতে তেমনি তাঁর দরসে। সব কিছুতে যেন মুক্তা ঝরে।
নব্বই দশকের মাঝামাঝি তিনি শাইখুল আরব ওয়াল আজম শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমাদ মাদানী (রহ.) এর খলিফা এবং সাহেবজাদা, ফেদায়ে মিল্লাত সাইয়্যেদ আসআদ মাদানী (রহ.) এর নিকট বায়আত গ্রহণ করেন। আসলে স্বর্ণকার তো স্বর্ণ চেনে। বায়আতের একবছর পরেই তিনি ফেদায়ে মিল্লাত থেকে খেলাফত-ইজাজত লাভ করেন। এরপর শুরু হয় নতুন আরেক সংগ্রাম-সাধনা। সুলুকের লাইনে যুহদ-মোজাহাদার মাধ্যমে তিনি সামনে অগ্রসর হতে থাকেন।
ফেদায়ে মিল্লাত থেকে পীরত্ব লাভ করার পর তিন লাইনে খেদমতে করতে থাকেন। লিখনী, দরস এবং আত্মশুদ্ধির নিবীড় মেহনত। যেটা রঙ ছড়াতে থাকে সর্বত্র। হাজারো ওলামা তলাবা তাঁর হাতে বায়আত গ্রহণ করেন। সেই সাথে এ ময়দানে তাঁর সীমাহীন কোরবানী ত্যাগ শুরু হয়। যে কারণে তাঁর ভক্ত-অনুরক্ত দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার জামিআ ইকরাতে খানকায়ী আমল শুরু হয়। সেই সাথে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তাঁর ইসলাহী কার্যক্রম চলতে থাকে। বিভিন্ন জেলাতে ইজতেমা শুরু হয়। ওদিকে কিশোরগঞ্জের তাড়াইলে বার্ষিক ইসলাহী প্রোগ্রাম হয়, যেখানে লাখো মানুষের সমাবেশ ঘটে।
❝আহ, বয়ানের মধ্যেই শায়েখের দৃষ্টি আমার দিকে। আরে তুমি আমিনুল ইসলাম! জাযাকাল্লাহ। (আমিন) অনেক দূর থেকে এসেছো। মনে হলো জীবনের বড় পাওনা। বয়ান শেষ করার পর মুসাফাহা করার সময় আমাকে বুকে টেনে নিলেন। কী যে এক লাজ্জত অনুভব করলাম, সেটা আর লিখতে পারছি না।❞
কিশোরগঞ্জের তাড়াইলে বেশ কয়েকবার ইসলাহী ইজতেমাতে শরীক হয়েছি। অনেক উপকৃত হয়েছি। নিজের সাথীরাও অনেক ফায়দা হাসিল করেছেন। তাড়াইলের জমিয়াতুল ইসলাহ ময়দান যেন এক নুরানী মঞ্জিল। সেখানকার আমলগুলো, ভক্তবৃন্দের আগমণ এবং দেশ সেরা আলেমদের উপস্থিতি ও তাদের ইসলাহী আলোচনা সকলকে অন্য এক জগতে নিয়ে যায়। একটা আমলী পরিবেশ সেখানে। শেখার অনেক কিছু আছে। রাতদিন চব্বিশ ঘন্টা আগত মুসল্লিগণ যেভাবে আমলে শরীক হন এবং শায়েখ যেভাবে তাদের তালিম দেন, সেটা বর্ণনাতীত। হৃদয় ভরে যায়। মনের মধ্যে জমা হয় সবকিছু। ভক্তবৃন্দের আমূল পরিবর্তন ঘটে।
বছরে একবার তাড়াইলে গেলে তো আর হয় না। মনেচায় সবসময় যেন প্রিয় শায়েখের সামনে বসে থাকি। চাতক পাখিরমত চেয়ে থাকি তাঁর দিকে। আর হৃদয় থেকে দুর করে দেই যত ব্যাথা-বেদনা। কেননা সময়ের অভাবে তাঁর খেদমতে বসা হয়না ঠিকমত। তাইতো ২৫ আগষ্ট প্রিয় শায়েখের খানকা এবং ঢাকার ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্টান জামিআ ইকরাতে পৌছালাম।
সারাদিন কিছু বন্ধুদের সাথে মোলাকাত সেরে মাগরিবের মুহুর্তে হাজির হলাম সেখানে। ইকরা ঝিলপাড় মসজিদে পৌছানোর পূর্বেই মাগরিবের আজান শুরু হয়ে গেল। অনেক মধুর সুর বয়ে আসতে লাগল আজান থেকে। আজানের মনমুগ্ধকর আওয়াজে যেন আশে-পাশের এলাকা মোহিত হচ্ছে। এক অভূতপুর্ব দৃশ্য। সত্যি মনটা যেন কেড়ে নেয়। আজান শেষ হতেই মসজিদে ঢুকে গেলাম। মনোরম পরিবেশ সেখানে। কোনো গ্যাদারিং নেই। সুনসান নীরবতা। মুসল্লিরা মসজিদে প্রবেশ করছে। আমিও মসজিদে ঢুকে কাতারবন্দী হয়ে বসলাম।
মাগরিবের নামাজ শেষেই শুরু হয়ে গেল ইসলাহী ইজতেমার কার্যক্রম। সুরা ওয়াকিয়া তেলাওয়াত। এরপর বার তাসবিহের জিকির। জিকির তালিম দিলেন একজন আলেমেদ্বীন। বড় ভালো লাগল জিকিরের মজলিস। জলি জিকির হলো, তবে অত্যন্ত দরদ ভরা কন্ঠ। আবেগ মিশ্রিত। সবচেয়ে বড় বিষয়, সহীশুদ্ধ উচ্চারণের মাধ্যমে জিকিরের শব্দগুলো বলা হলো। কোনো তাড়াহুড়ো নেই। ধীরে ধীরে বার তাসবীহ আদায় করল সবাই।
জিকির শেষে মনটা ছটফট করছে। কখন শায়েখের সাথে দেখা হবে। সর্বশেষ মার্চ মাসে তাড়াইল ইজতেমাতে শায়েখের সাক্ষাত পেয়েছিলাম। আর দেখা হয়নি তাঁর সাথে। এর মাঝে ছয়মাস অতিবাহিত হয়েছে। মাঝখানে হসপিটালে ছিলেন কিছুদিন। কেমন আছেন তিনি? এজন্য বারবার মনটা আনচান করছে।
এশার আজানের সময় হয়ে গেল। হঠাৎ প্রিয় শায়েখের আগমণ। সাদা শুভ্রবসন। পাঞ্জাবী-পায়জামা আর সেই পরিচিত কিস্তি টুপি মাথায়। মসজিদের উত্তর দিক থেকে মেম্বারের দিকে এগিয়ে আসলেন। সেখানে উপবিষ্ট কিছু সেলিব্রিটি শায়েখের সাথে মুসাফাহার জন্য দাঁড়িয়ে গেল। আমরা দক্ষিণ পার্শ্বে বসা কিছু লোক ছিলাম তারা দাঁড়ায়নি। তাঁর কষ্ট হবে বলে মুসাফাহা থেকে বিরত থাকলাম।
সেলিব্রিটিদের নাম উল্লেখ না করলে বেমানান হয়, আল্লামা ইয়াহইয়া মাহমুদ, ড. মাওলানা মুশতাক আহমাদ, মাওলানা আরীফ উদ্দীন মারুফ, মাওলানা এমদাদুল্লাহ কাসেমী, মাওলানা আব্দুর রহীম কাসেমী, মুফতি আবুল কাসেম খুলনা, মুফতি ফয়জুল্লাহ আমান, মাওলানা রেজাউল করিম আবরার প্রমুখ মহারথীগণ সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
প্রিয় শায়েখ অসুস্থতার কারণে বয়ান করতে পারেননি। তবে দু-একটা কথা বলেছেন। তাতেই যেন ভক্তবৃন্দের হৃদয় মন্দিরে আঘাত করলো। ‘যে আল্লাহকে পেতে চায় অবশ্যই আল্লাহ তাকে পাইয়ে দিবেন’। সামান্য এই কথাগুলো ক্ষুধার্ত ভক্তের জন্য বিশাল খোরাক। তৃপ্তিতে ভরে গেল হৃদয়।
আহ, বয়ানের মধ্যেই শায়েখের দৃষ্টি আমার দিকে। আরে তুমি আমিনুল ইসলাম! জাযাকাল্লাহ। (আমিন) অনেক দূর থেকে এসেছো। মনে হলো জীবনের বড় পাওনা। বয়ান শেষ করার পর মুসাফাহা করার সময় আমাকে বুকে টেনে নিলেন। কী যে এক লাজ্জত অনুভব করলাম, সেটা আর লিখতে পারছি না। একটা ভরপুর মজলিসে আমার মতো নাদান-গর্দভের নাম ধরে ডাকা এবং তাঁর বুকে আমাকে স্থান দেওয়ার মতো পরমসৌভাগ্য আর কার হয়।
❝আল্লাহওয়ালা মানুষের নেক দৃষ্টি মানুষকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। তার জীবনে আমূল পরিবর্তন ঘটে। জেসমানী এবং রুহানী সব দিকে শক্তি সঞ্চার হয়। সামান্য এক মুহুর্তের সোহবতে জীবনের মোড় ঘুরে যায়।❞
মাওলানা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী (রহ.)। তিনি শাইখুল হিন্দের দরবারে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকতেন। কোনো কথা বলতেন না। মজলিস শেষ হয়ে গেলে হযরত শাইখুল হিন্দ জিজ্ঞেস করতেন কাশ্মিরীকে। তোমার কোনো প্রশ্ন আছে কিনা? তিনি বলতেন, অনেক প্রশ্ন নিয়ে এসেছিলাম, কিন্তু আপনার সোহবতে এসে সবকিছু সমাধান হয়ে গেছে।
ঠিক আল্লাহর ওলীদের সোহবতটা এমনি। তাদের সাথে এই যোগাযোগ, এই সোহবত, অন্তরাত্মাকে শক্তিশালী করে দেয়। তাদের সাথে এই বন্ধন হৃদয় থেকে দূর হয়ে যায় যাতনা। আমার যেন তার ব্যত্যয় ঘটেনি। এক নতুন জীবন ফিরে পেলাম।
নতুন পদ্মা সেতু। নতুন করে আবার আল্লাহর পেয়ারা বান্দাদের সোহবতে আসা-যাওয়া শুরু হলো। তাদের সাথে বন্ধন-প্রীতি গড়া সহজ হয়ে গেল। এখন অনেক উপকৃত হবে সকলে। আল্লাহ তায়ালা প্রিয় শায়েখ আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ সাহেবকে কবুল করুন। তাঁর নেক হায়াত দারাজ করুন। আমিন।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিষ্ট