ইতিকাফের জরুরী মাসআলা

ইতিকাফের জরুরী মাসআলা

ইতিকাফের জরুরী মাসআলা

মুফতী তামীমুল ইসলাম ফরিদী ❑ মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিনের অশেষ মেহেরবানী ও কৃপায় তাঁর অনেক বান্দারা এবছরও এই বৈশ্বিক বিপর্যয়ের মাঝেও বিভিন্ন মসজিদে ইতিকাফ করছেন। মহিমান্বিত লাইলাতুল কদর অন্বেষণের অভিপ্রায়ে তাদের এই মুজাহাদা। ফজিলত থেকে মাহরুম না হওয়ার জন্যই তারা এই ইতিকাফ করছেন। এটা একদিকে যেমন খুশির খবর অন্যদিকে একটি ভয়ের কারণ। তার পরেও যেহেতু তারা ইতিকাফে বসে গেছেন তাদের জন্য নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম ও মাসআলা সামনে রেখে চলা জরুরি। সেই বিষয়টাকেই সামনে রেখে ইতিকাফের বিভিন্ন মাসআলাগুলি আমি সংক্ষিপ্তভাবে পেশ করছি। আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিন এগুলোর উপর সকলকে আমল করার তৌফিক দান করেন। এগুলোকে সকলকে যথাযথভাবে মেনে চলার তৌফিক দান করেন আমিন।

মাসআলা: মাসনূন ইতিকাফ যেহেতু শেষ দশ দিন ব্যাপী, তাই প্রথম থেকেই পুরো দশ দিন ইতাকাফ করার নিয়ত করবে। এক সাথে দশ দিনের নিয়ত না করলে সুন্নত ইতিকাফ আদায় হবে না; বরং তা নফলে পরিণত হবে।

মাসআলা: ২০ তারিখ সূর্যাস্তের আগেই ইতিকাফের নিয়তে মসজিদে পৌঁছে যাওয়া জরুরী।

মাসআলা: মাসনূন ইতিকাফ শুরু করলে তা পূর্ণ করা আবশ্যক। ওযর ব্যতীত তা ভাঙ্গা জায়েয নেই।

মাসআলা: ইতিকাফকারীর জন্য ইতিকাফ অবস্থায় স্ত্রীসহবাস করা হারাম। তেমনি স্ত্রীকে চুমু খাওয়া, আলিঙ্গন করা ইত্যাদি সব কিছুই নাজায়েয।

মাসআলা: মাসনূন ইতিকাফ শুরু করার পর মাঝে দুএক দিন যদি ভঙ্গ হয়ে যায় তাহলে সে দিনগুলোর ইতিকাফ পরে কাযা করে নিতে হবে। অর্থাৎ যে কয়দিনের ইতিকাফ ভঙ্গ হয়েছে সে কয়দিনের জন্য রোযা অবস্থায় মসজিদে অবস্থান করবে।

মাসআলা: পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ইতিকাফ করা ও করানো উভয়ই নাজায়েয।

মাসআলা: ইতিকাফের দিনগুলোতে তেলাওয়াত, তাসবীহ-তাহলীল ও ইবাদত-বন্দিগীতে কাটানো উত্তম।

মাসআলা: কিছু সময় দীনী মাসায়েলের কিতাবাদী পড়াশোনা করা এবং অন্যকে শোনানো উচিত।

মাসআলা: পুরুষরা শুধু মসজিদে ইতিকাফ করবে। আর মহিলারা তাদের ঘরে নামাযের জায়গায় ইতিকাফ করবে।

মাসআলা: মহিলারা তাদের ইতিকাফের স্থানকে পর্দা দিয়ে ঢেকে দিবে, যেন কোন বেগানা পুরুষ আসলে স্থান পরিবর্তন করতে না হয়।

মাসআলা: অজ্ঞান বা পাগল হয়ে গেলে ইতিকাফ নষ্ট হয় না। তবে তা যদি পরবর্তী দিন বা আরো বেশি সময় পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হয় তাহলে প্রথম দিন বাদ দিয়ে যে কয়দিন এ অবস্থায় কাটে সেগুলোর কাযা কারে নিতে হবে।

মাসআলা: ইতিকাফ সহীহ হওয়ার জন্য শরয়ী মসজিদ হওয়া জরুরী। জামে সমজিদ হোক বা পাঞ্জেগানা উভয়টিতেই ইতিকাফ করা যায়।
ইতিকাফ অবস্থায় যা করা যায়

মাসআলা: অন্যান্য রোযাদারদের মত রাতের বেলায় খাওয়া-দাওয়া বা চা পান করা ইত্যাদি সবকিছুই ইতিকাফকারীর জন্য জায়েয।

মাসআলা: প্রয়োজনীয় দুনিয়াবী কথাবর্তা বলা জায়েয।

মাসআলা: প্রয়োজন মত আরাম করা ও ঘুমানো জায়েয।

মাসআলা: জরুরী চিঠিপত্র লেখা এবং ধর্মীয় বইপত্র লেখা জায়েয।

মাসআলা: মসজিদে ইতিকাফ অবস্থায় শুধু প্রয়োজনীয় বেচাকেনার কথাবর্তা বলা জায়েয। তবে পন্য মসজিদের ভেতর প্রবেশ করানো যাবে না।

মাসআলা: ডাক্তাররা প্রয়োজনবশত ইতিকাফ অবস্থায় বিনা পারিশ্রমিকে চিকিৎসাপত্র লিখতে পারবে।

মাসআলা: মল-মুত্র ত্যাগ, অজু, (ফরয ও নফল) ফরয গোসল ও সুন্নত গোসলের জন্য মসজিদ থেকে বের হওয়া জায়েয।

মাসআলা: খাবার মসজিদের পৌঁছে দেওয়ার কেউ না থাকলে নিজে গিয়ে তা আনতে পারবে।

মাসআলা: মুয়াজ্জিন ইতিকাফ করলে এবং আজানের জায়গা মসজিদের বাইরে হলে বাইরে গিয়ে তার জন্য আযান দেওয়া জায়েয।

মাসআলা: পাঞ্জেগানা মসজিদ হলে জুমার নামাযের জন্য জামে মসজিদে যাওয়া জায়েয।(অন্য কোন কাজে মশগুল হতে পারবে না।)

মাসআলা: জুমার শেষে (৪ রাকাত ও ২ রাকাত মোট ৬ রাকাত সুন্নত পড়ে সাথে সাথে) ইতিকাফের স্থানে ফিরে আসবে।

মাসআলা: অজু-ইস্তিঞ্জার জন্য বের হলে যদি কোন জানাযা উপস্থিত থাকে তাহলে পথে বিলম্ব না করে জানাযার নামায পড়ে নেওয়া জায়েয।

মাসআলা: ফরয ও মাসনূন গোসল (যেমন জুমার গোসল) ছাড়া স্বাভাবিক গোসলের জন্য মসজিদ থেকে বের হবে না। তবে খুব বেশি প্রয়োজন দেখা দিলে মসজিদের ভেতরে বসে মাথা বের করে দিয়ে মাথায় পানি দিবে। এতেও সমস্যা না কাটলে কোন কোন মুফতীর মতে অজু-ইস্তিঞ্জার জন্য যখন বের হবে তখন নিকটে পানির ব্যবস্থা থাকলে অতিদ্রুত গোসল করে নিবে।

মাসআলা: কুরআন মাজীদ ও দীনী কিতাবের তালীম দেওয়া জায়েয।

মাসআলা: ইতিকাফ অবস্থায় শরীরে তেল লাগানো, খুশবু ব্যবহার করা এবং চুল-দাড়ী আঁচড়ানোর অনুমতি আছে।

মাসআলা: ইতিকাফ অবস্থায় চুপ থাকাকে সওয়াব মনে করে চুপ থাকা অর্থাৎ কোন যিকিরও না করা মাকরূহ তাহরীমী।

মাসআলা: মসজিদ একতলা বিশিষ্ট হোক বা বহুতল বিশিষ্ট, ছাদ মসজিদের অন্তর্ভুক্ত হবে। সুতরাং ইতিকাফকারী ছাদে যেতে পারবে।

মসজিদের বারান্দা যদি মসজিদের অন্তর্ভুক্ত হয় (অর্থাৎ নির্মাণের সময় বারান্দাকেও যদি মসজিদের অংশ মনে করা হয়ে থাকে) তাহলে সেখানেও ইতিকাফকারী যেতে পারবে।
মাসআলা: ইতিাকাফকারী নফল অজুর জন্য মসজিদের বাইরে যেতে পারবে।

মহিলাদরে ইতিকাফ:

মাসআলা: মহিলারা তাদের ঘরে নামাযের স্থানে ইতিকাফ করবে। নামাযের জন্য পূর্ব থেকে কোন স্থান না থাকলে তা নির্দিষ্ট করে নিবে। এরপর সেখানে ইতিকাফ করবে।

মাসআলা: যে মহিলার স্বামী বৃদ্ধ, অসুস্থ বা তার ছোট ছেলে-মেয়ে রয়েছে এবং তাদের সেবা করার কেউ নেই, সে মহিলার জন্য ইতিকাফের চেয়ে তাদের খেদমত ও সেবাযত্ম করা উত্তম।

মাসআলা: মাসিক (ঋতুস্রাব) অবস্থায় ইতিকাফ করা সহীহ নয়। কারণ এ অবস্থায় রোযাই রাখা যায় না। আর মাসনূন ইতিকাফের জন্য রোযা রাখা জরুরি।

মাসআলা: মহিলাদের উচিত তাদের নির্দিষ্ট দিনগুলোর শরু-শেষের দিকে লক্ষ্য রেখে ইতিকাফ করা।

মাসআলা: মহিলারা তাদের ইতিকাফের নির্দিষ্ট স্থান থেকে ঘরের অন্যত্র যাবে না। অন্যত্র গেলে ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে।

মাসআলা: মহিলাদের ইতিকাফ করতে হলে স্বামীর অনুমতি নিয়েই ইতিকাফ করতে হবে। স্বামীর নিষেধ সত্ত্বেও ইতিকাফ করলে ইতিকাফ সহীহ হবে না।

ইতিকাফ ভঙ্গের কারণসমূহ:

মাসআলা: ইতিকাফ অবস্থায় সহবাস করলে ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে। এ ছাড়া স্ত্রীকে চুমু খাওয়া বা স্পর্শ করার দ্বারা বীর্যপাত ঘটলে ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে।

মাসআলা: ফরয ও মাসনূন নয় এমন গোসলের জন্য মসজিদ থেকে বের হলে ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে।

মাসআলা: শিক্ষক ও চাকুরিজীবীরা নিজ দায়িত্ব পালনের জন্য মসজিদের বাইরে গেলে ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে। এ ধরণের দায়িত্বশীলদের জন্য ইতিকাফের আগেই ছুটি নিয়ে নিতে হবে।

মাসআলা: অন্য মসজিদে খতম তারাবীর জন্য গেলেও ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে।

মাসআলা: বিনা প্রয়োজনে মসজিদের বাইরে গেলে যদিও তা অল্প সময়ের জন্য হয়, ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে।

মাসআলা: কোন কারণে রোযা ভেঙ্গে গেলে বা রোযা রাখতে না পারলে ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে। কারণ মাসনূন ও ওয়াজিব ইতিকাফের জন্য রোযা জরুরি।

মাসআলা: জানাযার জন্য মসজিদ থেকে বের হলে ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে।

লেখক: মুহতামীম ও সুবক্তা

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *