একপাতা ওষুধ

একপাতা ওষুধ

একপাতা ওষুধ

জাকারিয়া জাকি : আজকাল মনটা ভালো নেই ফাহিমের। স্কুল যায় ঠিকই কিন্তু ক্লাসে বসে কী যেন ভাবনার অতল গভীরে হারিয়ে যায় কেউ জানে না। মোটেও মনযোগ নেই ক্লাসে। পড়ার টেবিলে ইদানিং মনই বসছে না তার। কারো সাথে কথা বলে না। কেউ কিচ্ছু বললে উত্তর ও দেয় না। একা বসে বসে শুধু কী জানি ভেবেই যায় শান্ত ছেলেটা। ক্লাসের ছেলে মেয়েরা এক সময় বিরক্ত হয়ে উঠল ফাহিমের প্রতি। এমনকি হাস্যবস্তুতে পরিনত হল সে।

এ দিকে ফাহিফ কারো কথার কোন তোয়াক্কাই করছে না। এক মনে ভাবে আর ভাবে। ক্লাসের সবাই যখন ওকে নিয়ে মজা করে, তখন তনয় নামের একটি ছেলে বাধা দেয়। ভাই! তোরা ওকে নিয়ে মজা করিস না। ছেলেটি এমনিতেই কষ্টে আছে।

তনয় এভাবেই বাধা দিতো সবাইকে। ফাহীম বিষয়টি খেয়াল করলো। ভাবলো! সবাই আমাকে নিয়ে দুষ্টুমি, মজায় লিপ্ত, আর এ ছেলেটা আমার হয়ে তার বন্ধুদের সাথে ঝগড়া করছে! আস্তে আস্তে তনয় আর ফাহীমের মাঝে জমে উঠে বন্ধুত্ব। একসাথে উঠা বসা শুরু হয় তাদের। ভাবুক ছেলেটা এখন মিশুক হয়ে গেছে। আর শান্ত ছেলেটা একটু অশান্ত। আজকাল‌ বেশ চঞ্চল হয়ে উঠেছে ফাহিম। এভাবেই কেটে গেল একটা দীর্ঘ সময়।

হঠাৎ একদিন আবারো ফাহীম কী যেন ভাবছে! ফাহীম! ফাহীম! দোস্ত ! তুই আবার কী ভাবছিস? চল উঠ! বসে থাকিস না।

না, তনয় এর কথা আজ ফাহীম শুনছে না।

আরে দোস্ত উঠ।

তনয় এর কথা মোটেও কানে নিচ্ছে না।

ওকে তুই থাক, আমি যাই।

তোর এসব কাণ্ড একদম ভালো লাগে না ফাহীম।

একটু রাগ করেই চলেগেল তনয়।

পরের দিন। আজও ভাবছে ফাহীম। কিন্তু আজ তনয় কিছু বলল না।চুপচাপ চলে গেল। বিষয়টি লক্ষ করলো ফাহীম। তাই পরের দিন ক্লাসে আসার পরই তনয়কে ডাকলো।

বলল, তুই কি জানতে চাচ্ছিস? আমি কী ভাবি? আর কেনই তা? তাহলে ক্লাস শেষে পার্কের ঐ গাছতলায় যাবি। তোকে সব বলবো।

ক্লাস শেষ হতেই তনয় হাজির গাছতলায়। কিছুটা কৌতুহলের বাসা বেধেছে ওর মনে। কী এমন কারণ থাকতে পারে। যা ওকে কষ্ট দেয়, ভাবায়। ওর অনুভুতিগুলো কেড়ে নিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে ওর স্বপ্ন, ওর ভালো লাগা, এককথায় সব কিছুই।

ফাহিম এ এলো, তনয়! কখন আসলি বন্ধু? একটু আগেই আসলাম।এ কটু বড় শ্বাস ফেলেই বলল তনয়, তাহলে শুনবি? কেন ভাবি আমি? কেন একা বসে থাকি ঐ গাছ তলায়। কেন হারিয়েছি আমার অনুভুতি? আমার ভালো লাগা, আমার সব কিছু? তাহলে শুন, আমি বলছি-

আমার বয়স তখন ১২ বছর।তখন ক্লাস সেভেন পড়ি। সেদি ন খুব বৃষ্টি ছিল। প্রবল বাতাসে অস্থির ছিল চারিদির। বিদ্যুত চমকে আতঙ্কিত ছিল মানব-দানব নির্বিশেষে সকলেই। গাছ পালাতে আশ্রয় নেয়া পাখিগুলো সে দিন হয়েছিল নীড় হারা। বিকট আওয়াজে চুপ ছিল রাতের অন্ধকারে চলা প্রাণীগুলো। নিস্তব্দ পৃথিবীর সবকিছু। রাত তখন ঠিক বারোটা।

ফাহাদ! ফাহিম! ফাহাদ! ফাহীম!(ফাহাদ ফাহীমের বড় ভাই) হ্যাঁ, ফাহিমের মা আমেনা সেদিন রাতে এ ভাবেই ডেকেছিলেন।

ঘুম ভাঙতে সেদিন একটু দেরী হয়েছিল ফাহমের। দেরি হয়েছিল ফাহিমের বড় ভাই ফাহাদের ও।

আবারো, ফাহিম! ফাহাদ! এবার কিন্তু উঠেগেল ফাহিম। মা! মা! তোমার কী হয়েছে?

ফাহিমের মা বলল, বাবা আমার শরীরটা বেশ খারাপ লাগতেছে। আমার ঔষধ এর পাতাটা শেষ হয়েগেছে। তোর কাছে কোন টাকা আছেরে বাবা?
ফাহিম চুপ হয়ে গেল। ততক্ষণে ফাহাদও এসে হাজির। ফাহাদও চুপ। চুপ থাকার কারণটা একটু বলে দেই, সেদিন ফাহীম ফাহাদের পকেটে শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই ছিল না।

বড় ভাই হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে ফাহাদ বলল মা! তোমার কী রোগ? তুমি তো কোনদিন আমাকে বলনি! মা বলল, আরে বাবা তেমন কিছু না। যদি তোর কাছে টাকা থাকে তাহলে এক পাতা ঔষধ নিয়ে আয়, আমার শরীরটা একদমই ভালো লাগছে না।

ফাহাদ বলল, পাতাটা কোথায়? ফাহাদের প্রশ্নে হাতে ঈশারা করে দেখালেন আমেনা বেগম। বৃষ্টি এড়িয়েই পথে ছুটল ফাহাদ। আজ যেভাবেই হোক মায়ের ঔষধ আনতে হবে। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে সবকিছুই তো মায়ের থেকে পেয়েছি। বাবার মমতা পাইনি, তবে মায়ের আদরে তার অভাব বুঝে উঠতে পারিনি কোনদিন। সারাজীবন মা আমাদের জন্য সব বিলিয়ে দিয়েছেন। আর আজ? আমি মা’র জন্য এক পাতা ঔষধ আনতে পারবো না?

নালায়েক আমি। হতভাগা। এসব ভেবে অস্থির হয়ে যাচ্ছিল ফাহিম। তবুও পথচলছে সে। যে করেই হোক আজ মায়ের ঔষধ নিয়েই ঘরে ফিরব।

রাত তিনটা। না, সেদিন কোন কিছুই করতে পারেনি সে। এক পাতা ঔষধ সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়েছে সেদিন। যেন রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে সকল পথ। এক সময় ক্লান্ত হল ফাহাদ। ক্লান হল ফাহাদের পদযোগল। পথ চলতে অস্বীকৃতি জানাল তারা। বসে পরল ফাহাদ। ভাবছে আনমনে। আজ যদি ঔষধের কারণে আমায় ছেড়ে চলে যান মা! তবে আমার মত সন্তান না থাকাইতো ভাল ছিল!

না,এসব কী আজেবাজে ভাবছি আমি! হঠাৎ এভাবেই চমকে উঠেছিলো ফাহাদ। মা’কে যে ও কোনদিন হারাতে চায় না। পৃথিবীর মানুষগুলো বল দেখায় তাদের আশ্রয় আছে বলেই। একটি ভরসার জায়গা আছে বলেই।

ফাহাদেরও আশ্রয় আছে। আছে একজন মা। একজন সমাজ সংস্কারক। একটি আদর্শবান পৃথিবীর জনক। তাই ফাহাদ কোনদিনই হারাতে চায় না তার আশ্রয়কেন্দ্রটাকে। হারাতে চায় না তার আস্থার জায়গাটা। ভাবছে ফাহাদ। ভাবছে ওর সাথে আশপাশের নীরব পরিবেশটাও। চোখের কোনায় জল আসে ওর।না, আমাকে তো কিছু একটা করতেই হবে। মাথার উপরে দাড়িয়ে আছে একটি কাঠাল বৃক্ষ। টপ টপ করে পানি পরছে ফাহাদের মাথার উপর। যেন ফাহাদের সাথে সাথে কাঠাল গাছটাও অশ্রু ফেলছে।

হয়তো সাধ্য থাকলে সেদিন ফাহাদের কান্নায় ভাগ বসাতো আরো অনেকে। অনেকক্ষন বসে থাকার পর। এবার বাসায় যাওয়া যাক।কিন্তু কী বলবে বাসায় গিয়ে? মাথায় আসছিলো না ফাহাদের। মা’র সামনে কী করে দাঁড়াবে ও? কী করে এ মুখ দিয়ে ডাক দেবে ওর মা’কে? এসব ভাবছে আর ধীর গতীতে পথ চলছে ফাহাদ।

হাঁটতে হাঁটতে কখন যে ও রাস্তার মাঝে চলে আসছে তা খেয়াল করেনি মোটেও। হঠাৎ পিছন থেকে মালবাহী একটি ট্রাকের ধাক্কাতে এখানেই থমকে গেল ফাহাদের পথচলা। মায়ের ঔষধ নিয়ে আর ঘরে ফিরা হয়নি ফাহাদের …

অন্যদিকে কিছু সময় আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন ফাহাদ ফাহিমের মা বিবি আমেনা বেগম।

(একদিনে মা আর ভাই হারানোর ব্যথাটা একজন ফাহিম নয় পৃথিবীর বৈধ অবৈধ কোন সন্তানই হয়তো মেনে নিতে পারবে না।)

কথাগুলো শেষ করার আগেই তনয় নিজের শার্টটা ভিজিয়েছে চোখের পানি দিয়ে।

ফাহিমের আর কিছু বলার আগেই তনয় বলল, আজ থেকে তুই আমার ভাই। আমিও তোর মতই একজন। আমরা একসাথে থাকব। বাঁচব একসাথে। ভাগাভাগি করে নেব আমাদের সুখ দুঃখ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *