৩০শে মে, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ , ১৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ , ৯ই জিলকদ, ১৪৪৪ হিজরি
পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : দেশের মোটরসাইকেল খাতে বিদ্যমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ডলার-সংকটের কারণে মোটরসাইকেলের যন্ত্রাংশসহ বিভিন্ন কাঁচামাল আমদানি কমেছে, তবে খরচ বেড়েছে। এতে বাজারে মোটরসাইকেলের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। সব মিলিয়ে ২০২২ সালে দেশে মোটরসাইকেলের বিক্রি আগের বছরের তুলনায় কমেছে। তবে বিক্রি কমলেও গত বছর দেশে মোটরসাইকেল নিবন্ধনের সংখ্যা রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের প্রথম তিন মাস জানুয়ারি থেকে মার্চে দেশে মোটরসাইকেল বিক্রিতে প্রবৃদ্ধি হয় ৭ শতাংশ। অর্থাৎ ২০২১ সালের একই সময়ের তুলনায় গত বছর বিক্রি ৭ শতাংশ বেশি হয়েছে। বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক এপ্রিল-জুনে প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ শতাংশ। কিন্তু জুলাই মাস থেকে বেচাকেনায় মন্দা শুরু হয়। ফলে গত বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে মোটরসাইকেল বিক্রি আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ শতাংশ কমে। আর শেষ প্রান্তিকে বিক্রি ৩০ শতাংশ হ্রাস পায়।
ব্যবসায়ীরা জানান, সব মিলিয়ে ২০২২ সালে দেশে মোটরসাইকেল বিক্রি হয় ৫ লাখ ৮৭ হাজার ৬৮৯টি। এর আগের বছর বিক্রি হয়েছিল ৫ লাখ ৮৭ হাজার ৯২৫টি মোটরসাইকেল। অর্থাৎ এক বছরে মোটরসাইকেল বিক্রি কমেছে ২৩৬টি। ব্যবসায়ীরা জানান, স্বাভাবিকভাবে এই খাতে ১৫-২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়ে থাকে। চাহিদা কমায় এখন খাতটি বেশ চাপের মধ্যে পড়েছে।
বেশ কয়েকটি কোম্পানির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশে মোটরসাইকেল বিক্রির হার ভালো ছিল। তবে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় জুন মাস থেকে ব্যবসায়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে। এতে মোটরসাইকেলের আমদানি ব্যয় ও উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। অন্যদিকে অর্থনৈতিকভাবে চাপে পড়ায় সাধারণ গ্রাহকদের মধ্যে মোটরসাইকেল কেনার চাহিদা কমতে থাকে।
টিভিএস অটো বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বিপ্লব কুমার রায় বলেন, ‘গত বছরের ঈদ পর্যন্ত আমাদের প্রবৃদ্ধি ঠিকই ছিল। তবে জুলাই মাস থেকে দেশের মোটরসাইকেল খাত বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়েছে। সেপ্টেম্বর থেকে তো বিক্রি প্রায় ৫০ শতাংশই কমে গেছে। সেই অবস্থা নতুন বছরেও চলছে।’
দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নতি না হলে চলতি ২০২৩ সালেও মোটরসাইকেল খাতে নেতিবাচক অবস্থা থাকবে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। এসিআই মোটরসের নির্বাহী পরিচালক সুব্রত রঞ্জন দাস বলেন, বছরের প্রথম মাস অর্থাৎ চলতি জানুয়ারিতে এখনো সেভাবে মোটরসাইকেল বিক্রি হয়নি। অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন না হলে বিক্রি বাড়বে না।
দেশে অনেকগুলো মোটরসাইকেল ব্র্যান্ডের নিজস্ব কারখানা রয়েছে। তারা বিদেশ থেকে কাঁচামাল এনে নিজেদের কারখানায় মোটরসাইকেল সংযোজন করে। কিন্তু ডলার-সংকটের কারণে গত বছরের শেষ ছয় মাসে ঋণপত্র (এলসি) খোলা নিয়ে সমস্যায় পড়েন ব্যবসায়ীরা। এ সময়ে কাঁচামাল আমদানির খরচ ২০-২৫ শতাংশ বেড়েছে। এতে ঋণপত্র খোলার পরিমাণ কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। ফলে কাঁচামাল আমদানি কমেছে। পাশাপাশি দেশে যেসব প্রস্তুত মোটরসাইকেল আসত, সেগুলোর আমদানিও একপ্রকার বন্ধ রয়েছে। ফলে ব্র্যান্ডভেদে প্রায় ১০ শতাংশ পর্যন্ত মোটরসাইকেলের দাম বেড়েছে।
দেশের শীর্ষ সাতটি মোটরসাইকেল ব্র্যান্ডের মধ্যে গত বছর বিক্রি বেড়েছে তিনটির, কমেছে চারটির। এ ছাড়া ভারত ও চীনের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল বিক্রিও ২৯ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।
এসিআই মোটরসের নির্বাহী পরিচালক সুব্রত রঞ্জন দাস বলেন, এমনিতেই মোটরসাইকেল নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা রয়েছে। সরকার মহাসড়কে মোটরসাইকেল চালানোর অনুমতি দিচ্ছে না। পদ্মা সেতুর মতো জনপ্রিয় জায়গাগুলোতে মোটরসাইকেল নিয়ে যাওয়া যায় না। এসব কারণে গ্রাহকেরা মোটরসাইকেল কেনায় নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।
এদিকে ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া মোটরসাইকেল কেনা যাবে না—এ রকম বিধিনিষেধের কারণেও মোটরসাইকেল বিক্রি কমেছে বলে জানান টিভিএস অটো বাংলাদেশের সিইও বিপ্লব কুমার রায়। তিনি বলেন, মোটরসাইকেল অত্যাবশ্যক পণ্য না হলেও প্রয়োজনীয় একটি বাহন। বিক্রির সময় নিবন্ধন যাচাইয়ের বিষয়টি না রেখে কেবল সড়কেই (ট্রাফিক পুলিশের কাছে) রাখা উচিত। এ ছাড়া মোটরসাইকেল কেনার জন্য ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
নিবন্ধন বেড়েছে
দেশে ২০২২ সালে বিক্রি কমলেও মোটরসাইকেল নিবন্ধনের সংখ্যা রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৫৬ লাখের মতো। এর মধ্যে মোটরসাইকেলের সংখ্যাই ৪০ লাখের বেশি।
২০১০ সালে দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ছিল সাড়ে সাত লাখের মতো। এরপর ২০২০ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে ২৩ লাখ ৭০ হাজার মোটরসাইকেল নিবন্ধিত হয়। ২০২১ সালে ৩ লাখ ৭৫ হাজার মোটরসাইকেল নিবন্ধিত হয়। আর গত বছর নিবন্ধিত হয়েছে ৫ লাখ ৬ হাজার ৯১২টি মোটরসাইকেল। অর্থাৎ এক বছরে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার নিবন্ধন বেড়েছে। এটি গত সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার জানান, বেশ কিছু কারণে মোটরসাইকেল নিবন্ধন বেড়েছে। সরকার নিবন্ধনের বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপ করায় মোটরসাইকেল কেনার সময়ই অধিকাংশ নিবন্ধন হচ্ছে। নতুন গ্রাহকেরাও আইনি জটিলতা এড়াতে নিয়ম মেনে চলছেন। তিনি বলেন, ‘দুর্ঘটনা এড়াতে মহাসড়কে মোটরসাইকেল চালানোর বিষয়ে আমরা নিরুৎসাহিত করি। এ নিয়ে একটি নীতিমালা তৈরির কাজ চলছে।’
সূত্র : প্রথম আলো