করোনার দিনে মোসাফ-মোয়ানাকা ও ইসলামের দিক নির্দেশনা
আবুদ্দারদা আব্দুল্লাহ ❑ পরিচিত বেশীরভাগ মানুষের সাথে সালাম মোসাফার পরে আলিঙ্গনে আবদ্ধ হওয়া আমার পুরনো অভ্যাস। আলিঙ্গনের পরের অনূভুতি বেশ ভালো লাগার মতোই। হৃদয়ে প্রশান্তির বান ডাকে, প্রচন্ড ভালোবাসা অনুভূত হয়। সালাম, মোসাফা, মোয়ানাকা নবিজির অনেক বড় একটা সুন্নাত। শরয়ী পরিভাষায় সুন্নাত বলা হয় , রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঐ সকল বাণী, যা দ্বারা তিনি কোন বিষয়ে আদেশ-নিষেধ, বিশ্লেষণ, মৌণ সম্মতি ও সমর্থন দিয়েছেন এবং কথা ও কর্মের মাধ্যমে অনুমোদন করেছেন, যা সঠিকভাবে জানা যায় তাকে সুন্নাহ বলা হয়।
সুন্নাত পালন করার মধ্যে সবসময় সুকুন বা প্রশান্তি থাকে। বহুবিধ উপকারও আছে। যেমন ধরুন, সালাম মোসাফা, মোয়ানাকার কথা। এই তিনটা জিনিস পালন করলে পরস্পরের মধ্যে দূরত্ব ঘুচে যায়। পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত গাঢ় এবং মজবুত হয়। ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়। শত্রু বন্ধুতে পরিণত হয়। পরস্পরের ভালো মন্দের খোঁজ খবর নেয়া হয় এবং বিপদে আপদে একে অপরকে পাশে পাওয়া যায়।
ইসলামের আগাগোড়া সবটাই কল্যাণে ভরপুর। ভালোবাসা এবং মমতায় মোড়ানো।
এগুলো যে শুধু মাত্র হাতে হাত মেলানো বা বুকে বুক মিলানোতে সীমাবদ্ধ তা কিন্তু নয় বরং নবিজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাত এবং বুক মেলানোর সময় একে অপরের কল্যান কামনার জন্য দোয়াও শিখিয়ে দিয়েছেন এবং সেই অনুযায়ী সাহাবায়ে কেরাম আমল করেছেন।
ইসলামের আগাগোড়া সবটাই কল্যাণে ভরপুর। ভালোবাসা এবং মমতায় মোড়ানো। নবিজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জীবদ্দশায় যেভাবে ভালোবাসা বিলিয়ে গিয়েছেন যুগ যুগ ধরে সেই ভালোবাসার ধারাটা টিকিয়ে রেখেছেন আল্লাহ ওয়ালা বুজুর্গগণ।
ইসলাম কল্যান কামনার ধর্ম যার কারণে স্বাভাবিকভাবেই এই ধর্মের আদব কায়দা, শিষ্টাচার অন্য ধর্মালম্বীদেরকে মুগ্ধ করে, কাছে টানে। গত কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের ওপেনার ব্যাটসম্যান তামিম ইকবালের ফেসবুক লাইভ শোতে নিউজিল্যান্ডের কেন উইলিয়ামসন বলেছেন, তোমরা যে সাক্ষাতের শুরুতে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলো এটা আমার কাছে খুব ভাল লাগে। (সূত্র : patheo24.com ২৩ মে, ২০২০)
ইসলাম যেভাবে ভালোবাসতে শেখায় সেভাবে অন্য কোন ধর্ম শেখায় না।
এই ভালো লাগা বা মুগ্ধতা থেকেই দিনদিন পশ্চিমারা ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়ছে কারণ ইসলাম যেভাবে ভালোবাসতে শেখায় সেভাবে অন্য কোন ধর্ম শেখায় না। মুসলমান সবসময় একে অপরের কল্যাণ কামনা করবে এবং পরস্পর পরস্পরকে ভালোবাসবে এটাই ছিলো নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সারা জীবনের ব্রত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও সহানুভূতির ক্ষেত্রে মুমিনদের দৃষ্টান্ত এক দেহের ন্যায়, যার একটি অঙ্গ অসুস্থ হলে গোটা দেহ জ্বর ও অনিদ্রায় আক্রান্ত হয়। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৬০১১; সহীহ মুসলিম, হদীস ২৫৮৬)
মুসলমান একে অপরের সাথে ভালোবাসা, মোহাব্বত বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে সালাম, মোসাফা, মোয়ানাকা তথা একে অপরের সাথে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে যে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটায় সেটার কোন বিকল্প নেই। তবে ক্ষেত্র বিশেষ বা কোন দুর্যোগকালীন সময়ে এগুলো পালন না করতে পারলে গুনাহ নেই বরং সেক্ষেত্রে ছাড় আছে। যেমন : বর্তমানের করোনা পরিস্থিতি।
বিশিষ্ট ছড়াকার গিয়াসউদ্দিন রুপম ভাইয়ের সাথে গতকাল দুপুরে দেখা আমাদের বনশ্রী মাদ্রাসার সামনে। বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস বিস্তার লাভ করার আগে যতবার রুপম ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছে ততবারই সালাম মোসাফার পরে আলিঙ্গনবদ্ধ হয়েছি কিন্তু গতকাল আর সেটা সম্ভব হয়নি। খুব খারাপ লেগেছে কিন্তু সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এখন খুব আবশ্যকীয়। ইসলাম আবেগের ধর্ম না, বিবেকের ধর্ম সুতরাং বিবেক খাটালে আর মন খারাপের সুযোগ থাকে না। আমি মনে করি, প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সালাম, মোসাফা, মোয়ানাকার যে সওয়াব এই মহামারীর সময়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখলেই সেই সওয়াব হাসিল হয়ে যাবে।
ইসলাম স্বভাব ধর্ম, বাস্তবতার ধর্ম সুতরাং বাস্তবতাকে সবসময় ইসলাম স্বীকার করে। আল্লাহ পাক কুরআন শরীফও নাজিল করেছেন মানুষের রুচি এবং স্বভাব অনুযায়ী। মানবজাতির উপরে উদ্ভট, অবাস্তব কোন কিছু চাপিয়ে দেননি বরং সমাজ এবং মানুষের সামঞ্জস্যতা বজায় রেখে প্রত্যেকটা আয়াত এবং সুরা নাজিল করেছেন।
বর্তমান করোনা পরিস্থিতি অনুযায়ী বাস্তবতা এখন বলছে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা জরুরি। কুরআন হাদীসেরও একই কথা সুতরাং পরিস্থিতি অনুযায়ী সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এখন ফরজ। কেউ যদি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার উপরে পুঙ্খানুপুঙ্খ আমল করে তাহলে সে অবশ্যই সওয়াবের অধিকারী হবে বরং সওয়াব আরো বেশিও হতে পারে কারণ আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সচেতন বান্দাকে অনেক ভালোবাসেন।
সাহাবায়ে কেরামও সবসময় সচেতনতাকে খুব গুরুত্ব দিয়েছেন যার কারণে সাহাবায়ে কেরাম কখনোই ব্যর্থ হননি। তাদের জীবন সফলতায় মোড়ানো ছিলো সুতরাং বোঝা গেলো পরিস্থিতি অনুযায়ী সচেতনতার কোন বিকল্প নেই। আসুন, আমরা সকলে সচেতন হই। সচেতনতার দ্বারা দেশ এবং দেশের মানুষকে ভালো রাখি, সুস্থ রাখি। আল্লাহ পাক আমাদের সহায় হোন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গল্পকার ও শিক্ষক