স্বাস্থ্য । শানু মোস্তাফিজ
করোনায় গর্ভধারণে ঝুঁকি ও করণীয়
শারমিন নাহার আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে তার ডেলিভারি হওয়ার কথা ছিলো। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে তিনি করোনা পজেটিভ হন। এতে তিনি, তার পরিবার এবং তার চিকিৎসকও ঘাবড়ে যান। চিকিৎসকের পরামর্শে তিনি করোনার চিকিৎসা নেন এবং তা সেরে যাওয়ার পরে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে তার একটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে। বর্তমানে শারমিন এবং তার কন্যা ভালো আছেন। কিন্তু করোনাকালীন সময়ে তাদেরকে ঘিরে যে উৎকণ্ঠা ছিলো, তা বর্ণনাতীত বলে জানান শারমিন।
তিনি বলেন, ‘করোনার আগেই আমি গর্ভধারণ করি, কিন্তু করোনা মহামারীতে ডেলিভারি হবে বলে খুব দুঃশ্চিন্তায় ছিলাম। শেষ পর্যন্ত করোনা থেকে রেহাই পাইনি। ঐ সময় সারাক্ষণ মনে হতো, আমি এবং আমার সন্তান শেষ পর্যন্ত হয়তো কেউই বাঁচবো না! এ সময় একজন গর্ভবতী মাকে যেভাবে এই কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়, তা তার পরিবারের অন্যান্যদেরও বহুগুন দুঃশ্চিন্তা বাড়িয়ে দেয়। তাই নিজের অভিজ্ঞতায় বলছি, এ সময় যারা গর্ভধারণ করবেন বলে ভাবছেন, তারা যেন তা থেকে বিরত থাকেন।’
শারমিন নাহার তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জেনেছেন এবং বিশ^জুড়েও চিকিৎসকরা বলছেন – ‘করোনাকালে নতুন করে গর্ভধারণ নয়। এ সময় কন্ট্রাসেপ্টিভ ব্যবহার করতে হবে এবং অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণের ঝুঁকি এড়াতে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।’
চিকিৎসকরা বলছেন, গর্ভধারণকালে একজন গর্ভবতী মায়ের এমনিতেই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। করোনায় আক্রান্ত হলে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আরো কমে যায়। এ সময় তাদেরকে সাধারণত আয়রন, ফলিক এসিড এবং ক্যালসিয়াম ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ সেবন করতে দেয়া হয় না। যদি এ সময় গর্ভবতী মায়েরা কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হন, তাহলে তাদেরকে যে সব ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা দেয়া হবে, সেগুলো মা ও গর্ভস্থ ভ্রুণের জন্য কতটা নিরাপদ হবে বা তার ফলাফল কি হবে, তা এখনো জানা যায়নি। সবকিছু একটা ট্রায়েলের মধ্যে আছে। ফলে করণাকালে গর্ভধারণ আক্ষরিক অর্থেই ঝুঁকিপূর্ণ।
এই ঝুঁকির বিষয়গুলো জানতে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা গবেষণা করছে। ইউনিসেফের ৭ মে ২০২০-এর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দেখা যায়, বাংলাদেশে কোভিড-১৯ মহামারীকালীন আনুমানিক ২৪ লাখ শিশুর জন্ম হবে এবং বৈশি^কভাবেও আনুমানিক ১১ কোটি ৬০ লাখ শিশুর জন্ম হবে। গত ১১ মার্চ কোভিড-১৯ মহামারী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ৪০ সপ্তাহের মধ্যে এইসব শিশুর জন্ম হওয়ার কথা রয়েছে। এই মহামারীর প্রভাবে বিশ^জুড়ে স্বাস্থ্যসেবা চাপের মুখে এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ প্রবাহ ব্যবস্থা বিঘিœত হচ্ছে। এরই মধ্যে এসব শিশুর জন্ম আলাদা এক ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করেছে, যা নবজাতকদের জন্য জীবনের ঝুঁকিও তৈরি করেছে।
ইউনিসেফ বলছে, প্রসূতি মা ও নবজাতকরা করোনাকালীন রুঢ় বাস্তবতার সম্মুখীন হবে। বিশ^জুড়ে লকডাউন ও কারফিউয়ের মতো নিয়ন্ত্রণমূলক নানা পদক্ষেপ, মহামারী সামলাতে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোর হিমশিম অবস্থা ও সরঞ্জামের ঘাটতি এবং ধাত্রীসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যাকর্মীরা কোভিড-১৯ এর সেবাদানে নিয়োজিত হওয়ায় শিশুর জন্মের সময় দক্ষ লোকবলের ঘাটতি থাকবে।
এসব কথা বিবেচনা করেই বিশ^জুড়ে গর্ভবতী মা ও নবজাতকের বিষয়ে সোচ্চার হয়েছেন বহু চিকিৎসক। এদেশেও করোনাকালে গর্ভধারণ নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিষয়ক চিকিৎসকরা। তারা এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরির জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। গর্ভধারণকালে যে কোনো ভাইরাল ইনফেকশনে ঝুঁকি থাকে। এ সময় ভ্রুণ যখন মায়ের গর্ভে তৈরি হতে থাকে, তখন নানা জটিলতা হতে পারে এবং ভ্রুণ ও মায়ের স্বাস্থ্য ঝুঁকি হতে পারে। এজন্য করোনাকালীন এ সময়, অন্তত: আগামী ছয় মাস গর্ভধারণ থেকে বিরত থাকা উচিত। যাদের প্রয়োজন নেই, তাদের অবাঞ্চিত গর্ভধারণ থেকে বিরত থাকতে হবে এবং এ বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। করোনার এ দুর্যোগে সন্তান নেয়ার পরিকল্পনা বা অসাবধানতা আমাদের স্বাস্থ্য ও অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করবে।
-০২-
এ সময় ঝুঁকি নিয়ে হোম ডেলিভারিও ভয়ের বিষয়। আবার অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণ থেকে বাঁচতে যে কোনো ওষুধ খেয়ে বাড়িতে গর্ভপাত করানোও খুবই বিপদজনক। তবে গবেষণায় দেখা গেছে দুর্যোগকালীন এ সময় গর্ভপাতের হারও বেড়ে গেছে এবং এ ধরণের ঘটনার কারণে জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। এতেও মৃত্যুঝুঁকিও তৈরি হচ্ছে। করোনাকালে গর্ভধারণের ঝুঁকি ও চিকিৎসার বিষয়ে সরকারের পরামর্শ এবং গাইডলাইন আমাদের সকলের মেনে চলা উচিত। জনসচেতনতা তৈরিতে সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিও এ বিষয়ে কাজ করছে। পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ও এ নিয়ে কাজ করছে। দেশে গত কয়েক বছরে মাতৃমৃত্যু কমেছে। করোনাকালে তা যেন আবারও বেড়ে না যায়, সেদিকে আমাদের সকলের সচেতন থাকতে হবে। তবে অনিয়ন্ত্রিত এবং অপরিকল্পিত গর্ভধারণ হলে দেশে মাতৃ মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ার আশংকা তৈরি হতে পারে।
করোনা আক্রান্ত গর্ভবতী মায়েরা সাধারণত আরলি প্রেগনেন্সিজনিত বিভিন্ন জটিলতা ও ত্রুটিতে ভোগেন। এমনকি এতে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হওয়ারও আশঙ্কা থাকে। মায়ের যদি শ্বাসকষ্টসহ অন্যান্য নানা সমস্যা থাকে, তবে সে ক্ষেত্রে আরো বেশি জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে বলে করোনাকালে গর্ভধারণের ব্যাপাওে বিশেষভাবে সাবধান হওয়া উচিত। তথাপি এ সময় গর্ভবতী মায়েদের বাড়ি থেকে বের না হওয়াই ভালো। খুব বেশি সমস্যা না হলে নিয়মিত চেকআপও বন্ধ রাখা যেতে পারে বা ফোনে পরামর্শ নেয়া যেতে পারে। তবে গর্ভধারণের ২০, ২৮, ৩২ এবং ৩৬ সপ্তাহের সময় যথাযথ নিয়ম মেনে চিকিৎসকের কাছে চেকআপ করিয়ে নেয়া জরুরি।
কোভিড-১৯ করোনায় আক্রান্ত গর্ভবতী মা ও নবজাতকের জরুরি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে যে গাইডলাইন বা নির্দেশনা রয়েছে তা অবশ্যই গর্ভবতী মায়েদের জানা থাকা প্রয়োজন। এ সময় গর্ভবতী মায়েদের প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে না যাওয়া ও গণপরিবহন এড়িয়ে চলা উচিত। করমর্দন ও কোলাকুলি করা থেকে এ সময় বিরত থাকা উচিত। সবার থেকে কমপক্ষে তিন ফুট দুরত্ব বজায় রেখে অবস্থান করার বিষয় মেনে চলতে হবে তাদের। পরিবারের সবাই বার বার কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড ধরে সাবান পানি দিয়ে হাত ধুতে হবে। হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার মেনে চলতে হবে। টিস্যু, রুমাল অথবা কনুইয়ের ভাঁজে হাঁচি, কাশি দেওয়ার অভ্যাস মেনে চলতে হবে। যেখানে সেখানে কফ বা থুতু কোনোভাবেই ফেলা যাবে না। সাবান দিয়ে প্রতিদিনের পরিহিত কাপড় ধুয়ে ফেলতে হবে। ভালো করে সিদ্ধ করে রান্না করা খাবার খেতে হবে। গর্ভকালীন সময়ে মায়ের স্বাভাবিক চেকআপ আপাতত বন্ধ রাখলেও খুব সমস্যা হলে চিকিৎসকের সাথে ফোনে যোগাযোগ করে সমাধান নিতে হবে। আয়রণ, ফলিক এসিড, ক্যালসিয়াম বড়ি এবং পুষ্টিকর খাবার নিয়মিতভাবে খেতে হবে।
কোভিড ১৯-এ আক্রান্ত হলে অথবা করোনার লক্ষণ বা উপসর্গগুলো দেখা দিলে গর্ভবতী মাকে দ্রুত কলসেন্টারে (১৬২৬৩ বা ৩৩৩ নম্বরে) যোগাযোগ করতে হবে। এসব সরকারি সেবার আওতায় জনসেবার জন্য নিবেদিত নম্বর। ১৪ দিন নিজগৃহ বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কোয়ারেন্টাইন অবস্থায় থাকতে হবে। সব সময় মাস্ক পরিধানসহ এবং বার বার ২০ সেকেন্ড ধরে সাবান পানি দিয়ে হাত ধুতে হবে। বেশি করে ভিটামিন সি ও তরল জাতীয় হালকা গরম পানীয় গ্রহণ করতে হবে। প্রতিদিনের পরিহিত কাপড় ভালো করে সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। পরিবারের সবার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে।
করোনাকালে গর্ভবতী মা’র পাশাপাশি নবজাতকেরও বিশেষ ব্যবস্থাপনা নিতে হবে। নবজাতককে সবার সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখতে হবে। চুমু দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। করোনায় আক্রান্ত মা বা নবজাতককে মায়ের দুধ খাওয়ানো যাবে, তবে মা অবশ্যই ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে মাস্ক পরে শিশুকে দুধ খাওয়াবেন। আবার মা বেশি অসুস্থ হলে মায়ের দুধ বের করে বাটি-চামচেও খাওয়াতে পারেন। এটিও নিরাপদ হবে। প্রয়োজনে অন্য মায়ের দুধও খাওয়ানো যাবে।
সচেতনতা সৃষ্টিতে গণমাধ্যমগুলি অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টা এবং সচেতনতা আমাদের সকলকে, বিশেষ করে আমাদের গর্ভবতী মা ও নবজাতকদের সুরক্ষিত রাখবে এ করোনাকালে।
লেখক : কলামিস্ট