কাচারি ঘর মসজিদ

কাচারি ঘর মসজিদ

কাচারি ঘর মসজিদ

আবুদ্দারদা আব্দুল্লাহ : প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বড় বড় শীল পড়ছে। মুসা মিয়া মসজিদে বসে আছেন একশো দানার একটা সাদা তসবিহ হাতে। একটার পর একটা দানা তিনি গুনছেন কিন্তু তিন তসবির যে আমল সেটা তিনি করছেন না। মুখে চিন্তার ছাপ। ভয়াবহ রকমের চিন্তা তাকে জেঁকে ধরেছে। প্রচণ্ড পানির পিপাসা পেয়েছে। তিনি যে কাউকে ডেকে পানি খাবেন সেই পথও নেই কারণ এটা রোজার মাস। আর রোজার মাসে তাকে কেউ পানি এনে খাওয়ানোর মতো নিষিদ্ধ কাজ করবে না। আবার পানি খাওয়ার জন্য মুসা মিয়া কলপাড়েও যেতে পারছেন না, কারণ সেখানে কয়েক ঘরের মহিলারা থালা বাসন মাজছে। মুসা মিয়া গালিগালাজ করে সমস্ত মহিলাদের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করলেন। মুসা মিয়া এবারের রমজানে একটা রোজা ভাঙতে না পারলেও অবশ্য গত রোজায় তিনটা ভেঙেছিলেন। বউয়ের কাছে হাতেনাতে ধরাও খেয়েছেন। দুইটা ভেঙে পার পেয়েছিলেন কিন্ত তিন নাম্বার রোজা ভাঙার সময় খেলেন ধরা। তাও আবার একেবারে ইফতারের আগ মুহূর্তে।

পরিবারের সবাই ইফতার সামনে নিয়ে বসেছে, ওমনি মুসা মিয়ার বউ তার সামনে থেকে ইফতার কেড়ে নিয়ে গেলেন। জোরে জোরে বললেন, রোজা রাখে না আবার ইফতার সামনে নিয়ে বসেছে? আল্লাহর সাথে ধোঁকাবাজি করো, না? গজবের ভয় নাই? ঘর ভর্তি মানুষ তার মধ্যে আবার পিচ্চি পিচ্চি নাতি নাতনিরাও ছিলো। খিলখিল করে তারা হেসে উঠলো। হাততালি দিতে দিতে বললো, নানা রোজা রাখে নাই, নানা রোজা রাখে নাই, আমাদের নানা রোজা রাখে নাই। হা হা হা। মুসা মিয়ার সামনে তিন ছেলের বউ ছিলো তারা হতভম্ব। শেষমেশ বাচ্চাদের সাথে তারাও খিলখিল করে হেসে দিলো। এ ছাড়া উপায় নেই। হতভম্ব ভাব তো কাটাতে হবে। মুসা মিয়া নাতি নাতনিদেরকে ঝাড়ি দিয়ে চুপ করাতে চাইলেন, কিন্তু সে কায়দা আপাতত নেই। ছেলে বউদের সামনে এটা করা যাবে না, মাইন্ডের ব্যাপার-স্যাপার আছে। আবার প্লেট ছুড়ে ফেলে উঠেও যেতে পারছেন না। নাতি নাতনিদেরকে ঝাড়ি দিলে ছেলের বউরা যদি আবার বাপের বাড়ি হাঁটা দেয় তাহলে সর্বনাশ, কারণ কয়েকদিন পরেই ঈদ। আর প্লেট ছুড়ে মারলেও সমস্যা। কার না কার গায়ে লাগে, তখন বিপত্তি আরো বড় করে বাঁধবে। তা ছাড়া পেটে ক্ষুধাও ছিলো।

গত বছরের সেই ভয়াবহ ইতিহাস মুসা মিয়ার ভালোভাবেই মনে আছে। বৃষ্টির দিনেই ঘটনাটা ঘটে ছিলো। আজকেই সেই বৃষ্টির দিন তাই মনে পড়ে গেল, তবে আজকের দিনটা গত বছরের দিন থেকে ভয়াবহ। শীল বৃষ্টি জোরে জোরে হচ্ছে। টিনের চাল ফুটো হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। মুসা মিয়া ভয়ে সিটিয়ে গেছেন ঠাঠা পড়ে কি না কে জানে। ঠাঠা পড়লে নাকি মানুষ ম্যাগনেট হয়ে যায়। ম্যাগনেটের আবার অনেক দাম। তিনি যদি আজকে ম্যাগনেট হয়ে যান তাহলে কি হবে? নিশ্চয় তার ম্যাগনেটের মৃতদেহটা নিয়ে অনেক কাড়াকাড়ি হবে। তার তিন ছেলে যদি কাড়াকাড়ি করে সব অংশ নিয়ে যায় তাহলে মেয়েরা তো কিছু পাবে না। এ বিষয়ে এখনি একটা সুরাহা করে যাওয়া উচিৎ। তা না হলে মেয়েরা অভিশাপ দিবে, গালিগালাজ করবে। তবে যারা ম্যাগনেট হয় তারা তো ভাল মানুষের কাতারে পড়েনা। ঠাঠা জিনিসটা তো আল্লাহর গজব আর গজব তো ভালো মানুষের উপর পড়ে না। মুসা মিয়া নিজের পাপ সম্পর্কে নিজেই সবচেয়ে ভালো জানেন।

গ্রামের সবচেয়ে বড় যে মসজিদ সেটা তার কারণেই কয়েকভাগে ভাগ হয়ে গেল। ধুম ধারাক্কা মারামারিও হলো। মাডার হয়ে গেলো পশ্চিম পাড়ার মজিদ শেখের দুবাই প্রবাসী বড় ছেলেটা। মসজিদে সবচেয়ে বেশি দান করতো ছেলেটা। দানটাও হতো খুব গোপনে, কেউ জানতো না। মৃত্যুর পরে প্রকাশ হলো বিষয়টা। দানের পরিমাণ প্রায় চল্লিশ লাখ টাকা। আর মুসা মিয়ার প্রকাশ্য দানের পরিমাণ দুই হাজারের উপরে যাবেনা বোধহয়। মুসা মিয়ার লোকেরা আরো কয়েকজনকে আহত করলো, গুরুতর আহত। মারের থেকে নিজের পিঠ বাঁচানোর জন্য মসজিদে আর যান না। কেউ যেতে চাইলেও মুসা মিয়া বাঁধা দেন। শেষমেষ নিজের অনুসারীদের চাঁপে বাড়ির উপর পরিত্যাক্ত একটা কাচারি ঘরকে মসজিদে রুপান্তর করলেন। মসজিদের হুজুর রাখা হয়েছিলো কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে সেই হুজুর এখন পলাতক।

মুসা মিয়ার ভাতিজাকে মসজিদের ভারপ্রাপ্ত কোষাধ্যক্ষ বানানো হয়েছে। তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল হুজুরের বাড়ি ফোন করার। পালানোর সঠিক কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। হুজুরের সাথে কোষাধ্যক্ষের কথা হয়েছে সন্ধ্যায়। হুজুর ফোনে যা বলেছেন তা মুসা মিয়ার কানে দিতে ভারপ্রাপ্ত কোষাধ্যক্ষ সাহেব খুব ভয় পাচ্ছেন। তিনি নিজেও খানিকটা শংকিত। বারুদের মতো সংবাদ। হুজুর বলেছেন, কয়েকদিনের মধ্যেই মুসা মিয়ার জানাজা পড়াতে আসবেন। মুসা মিয়া বেঁচে থাকতে হুজুর কাচারি ঘরের এই মসজিদে আর আসবেন না। আর হুজুর স্বপ্নে দেখেছেন মুসা মিয়া দুই সপ্তাহের মধ্যে মারা যাবে। আর তার মৃত্যুটা হবে ভয়াবহ। তার আশপাশে যারা থাকবে তাদেরও বিরাট ক্ষতি হবে। মুসা মিয়ার জন্য জায়নামাজ না বিছানোয় হুজুরকে বাপ মা তুলে গালি দিয়েছিলো মুসা মিয়া। এরপরে হুজুর আর থাকেননি সেই না থাকাটাকেই মুসা মিয়া পলাতক হিসেবে চালিয়ে দিয়েছেন। কাচারি ঘরের অন্যান্য মুসল্লিদের কাছে জবাবদিহি তো করতে হবে। সুতরাং মুসা মিয়া ইমাম সাহেব পলাতক এই মর্মে সোজাসাপ্টা জবাবদিহি করেছেন। দুই দিন হয়ে গেছে হুজুর নেই। তারাবী ঠিকঠাক মত হচ্ছে না। মুসুল্লিরা সবাই মুসা মিয়াকে ধরলেন। উপায় না দেখে মুসা মিয়া ভাতিজাকে ডাক দিলেন, কি ব্যাপার কোষাধ্যক্ষ সাহেব, আমাদের ইমাম সাহেব হুজুর কি বললো?

ভারপ্রাপ্ত কোষাধ্যক্ষ সাহেব কি বলবেন কিছুই মাথায় আসছেনা। ইমাম সাহেব হুজুরের তরফ থেকে তার কাছে যে বারুদ সংবাদ আছে সেটা এক দুইজনের সামনে দেয়া যায় কিন্তু ভরা মজলিশে তো সম্ভব না। কোষাধ্যক্ষের পা ঘামছে। মুসা মিয়া ক্ষেপে উঠলেন, এতো দেরি লাগে একটা কথা বলতে? একটা পুঁইচকা হুজুরের কথা বলবা তাতেও তোমার এতো ভাবা লাগে? এই কারণে দায়িত্ব দিতে চাই নাই। আল্লাহর ঘরের দায়িত্ব নিতে হইলে বুক ভরা সাহস লাগে।

বাধ্য হয়ে ভরা মজলিশে বারুদ মারতে হলো। বারুদের বিস্ফোরণে যতটা ক্ষয়ক্ষতি হয় তার থেকেও বেশি হয়ে গেল। ছি ছি করতে করতে সবাই মসজিদ থেকে বের হয়ে গেল। এর মধ্যে এক মুসুল্লি মুসা মিয়ার জুতা কাচারি ঘরের চালের উপর রেখে দিলো। এক ঘর দুই ঘর হতে হতে সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়লো। মুসা মিয়ার বউ থম মেরে বসে থাকলেন। ছোট বউ এসেছিলো ঈদ করতে সে ইমাম সাহেব হুজুরের অভিশাপের ভয়ে বাপের বাড়ি চলে গেলো। ঈদ উপলক্ষ্যে বড়বউ আর মেজোবউয়ের আসার কথা ছিলো তারা বাসের টিকেট ক্যান্সেল করলো। আর এদিকে ভারপ্রাপ্ত কোষাধ্যক্ষ অন্যান্য মুসল্লিদের চাপে পড়ে মসজিদে রুপান্তরিত হওয়া কাচারি ঘরে তালা মেরে দিলো। কিছু করার নেই। পাঠকদের কাছে মনে হতে পারে মুসা মিয়াও বোধহয় ইমাম সাহেব হুজুরের অভিশাপের ভয়ে ভীত। মোটেও না, তিনি উল্টো আরো বলে বেড়াচ্ছেন, ধুত তোর পুঁইচকা হুজুর। অভিশাপের বুঝেটা কি ও? কথায় আছে না, শকুনের দোয়ায় গরু মরে না।

ইমাম সাহেব হুজুরের ভবিষ্যত অবশ্য ফললো না। দুই সপ্তাহের জায়গায় তিন সপ্তাহ কেটে গেল। চতুর্থ সপ্তাহেও মুসা মিয়া পুরোদস্তুর ভালো মানুষ। পঞ্চম সপ্তাহে ছোটখাটো একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেলো তবে সেটা যে ইমাম সাহেব হুজুরের অভিশাপ সেটা বলা যাবে না কারণ অভিশাপের পর্যায়ের দুর্ঘটনা মারাত্মক হয়, মুসা মিয়ার দুর্ঘটনা হলো পায়ে সামান্য একটা লোহার জিনেরি ঢুকেছে। অল্প একটু রক্ত বের হলো ব্যস, তারপরে আর কোন ব্যাথা নেই। ইঞ্জেকশন নেয়া তো দূরের কথা, কাউকে জানানোর প্রয়োজনই মনে করলেন না। অভিশাপ দেয়ার দেড় মাসের মাথায় মুসা মিয়া কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়লেন কারণ যেখানে লোহার জিনেরিটা ঢুকেছিলো সে জায়গাটায় ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। এই ক্ষতটা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকলো। ঠিক মতো হাঁটতে পারেন না।

চায়ের দোকানে যেতে পারেন না আগের মত। দুঃখে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মান্না দের ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা’র গান মুখে আসে। এ ছাড়া আর কোন উপায় নেই। আজকাল কেউ তার ধারেকাছেও আসে না। চিকিৎসার জন্য তিন ছেলের একজনও পর্যাপ্ত টাকা পাঠায় না। মুসা মিয়া শুয়ে শুয়ে ছেলেদেরকে ইতরের বাচ্চা ইতর বলে গালি দেন। ইমাম সাহেব হুজুরের ভবিষ্যত বাণী ফলে গেলো আট মাসের মাথায়। বুধবার সকাল সাড়ে নয়টায় মরণব্যাধী ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে কাচারি ঘর মসজিদের সভাপতি জনাব মুসা মিয়া মারা গেলেন। মৃত্যুকালে তার মুখে মান্না দের বিখ্যাত গান ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা’ জারি ছিলো।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *