কিশোরদের মতো কিশোরীরাও কোরআন দিয়ে একদিন বিশ্বজয় করবে

কিশোরদের মতো কিশোরীরাও কোরআন দিয়ে একদিন বিশ্বজয় করবে

  • ফাহমিদা মুন্নী

গতকাল ছিল ২৭শে রমযানের রাত। এদেশের বেশির ভাগ মানুষেরই ধারণা, কদরের রাত বুঝি ২৭শে রমযানেই হয়। তাই তারাবীহ সালাতের সময়ই ধারণা করছিলাম যে, আজ কিয়ামুল লাইলে নারীদের সমাগম হয়তো আগের দু’দিনের থেকে একটু বেশিই হবে।

কিন্তু মসজিদে সালাত শুরু হবার প্রায় এক ঘন্টা আগে গিয়ে বুঝতে পারলাম যে, বাস্তবতা আমার কল্পনাকেও হার মানিয়েছে। মুসল্লার প্রবেশ পথে যে পরিমাণ জুতো আর স্যান্ডেলের সমাগম দেখলাম, তাতে বুঝলাম আজ এই গভীর রাতের সালাতে জায়গা পেতেও আমাকে মোটামুটি যুদ্ধ করতে হবে।

ভেতরে ঢুকে দেখলাম, যা আশঙ্কা করছিলাম ঠিক তাই। এই মধ্যরাতেও সব বাঁধা উপেক্ষা করে শত শত নারী এসেছে কিয়ামুল লাইলে অংশগ্রহণ করতে। এদের মাঝে আছে, কিশোরী, বালিকা, তরুণী, মধ্যবয়সী নারী সহ ষাট-সত্তরোর্ধ নারীরাও। আমার দুই কন্যাকে কোনো রকমে এক জায়গায় বসিয়ে দিলাম। কিন্তু, আমার নিজের জন্য জায়গা খুঁজে পেতে বেশ বেগ পেতে হল। শুনলাম, তারারীহ সালাতে উপস্থিত নারীদের মধ্য হতে বিরাট এক সংখ্যক নারী বাড়িতে যায়নি, শুধু কিয়ামুল লাইলে অংশগ্রহণ করবে বলে।

পরবর্তী এক ঘন্টা যাবত নারীরা শুধু আসতেই থাকলো, দলে দলে। মনে হল, এ যেন হ্যামিলনের সেই বাঁশিওয়ালার যাদুর কোনো সুর, যে সুরে পাগল হয়ে এই গভীর রাতে দলে দলে সকল বয়সের নারীরা ঘর থেকে বের হয়ে এসেছে। সালাত শুরুর পূর্ব মূহুর্তেই সমগ্র মুসল্লা জুমার দিনের মত কাঁনায় কাঁনায় পূর্ণ হয়ে গেল। আর তিল ধারণের জায়গাও থাকলো না। অবস্থা শেষ পর্যন্ত এমন দাঁড়ালো যে, দেরীতে আগত নারীরা একটুখানি জায়গা পাবার জন্য অন্যদের নিকটে কাকুতি-মিনতি করতে লাগলো।

আমি মাঝে মাঝে ভাবি, কে বলে এই উম্মাহ’র মাঝে কল্যাণ নেই? যে উম্মাহ’কে আমাদের মহান রব “খাইরা উম্মাহ” বলে ঘোষণা দিয়েছেন, সেই উম্মাহ’র মাঝে কি কল্যাণ না থেকে পারে!

যে নারীদের জন্য এদেশের মোটামুটি ৯৯ ভাগ মসজিদের দরজা বন্ধ, সারাবছর যে নারীদের মসজিদে জুমার সালাতও আদায় করার সৌভাগ্য হয় না, যে নারীদের মসজিদে যেতে এই সমাজ উৎসাহিত করে না, আজ কিনা একটুখানি সুযোগ পেয়ে, দ্বীন সম্পর্কে কম জ্ঞান সম্পন্ন আর সুবিধাবঞ্চিত সেইসব নারীরা, সংসারিক ব্যস্ততাকে একপাশে রেখে, ঝলমলে বিপণীবিতানগুলোর আকর্ষণ উপেক্ষা করে, সারাদিন রোজা রেখে, কর্মক্লান্ত দিনের পর রাতের নিদ্রা ত্যাগ করে, গভীর রাতে দলে দলে মসজিদে ছুটে এসেছে শুধু তাদের রবের সন্তুষ্টির জন্য! সত্যিই, এজন্যই তো আমাদের রব এই উম্মাহ’কে ‘খাইরা উম্মাহ’ বলেছেন।

পুরোটা রমযানে আমি যখন মসজিদে বসে আপন মনে কোরআন তিলওয়াত করেছি, তখন দেখেছি উপস্থিত নারীদের মাঝে কত অসংখ্য নারী পরম আগ্রহ নিয়ে আমার তিলওয়াত শুনেছেন। এদের মধ্যে অনেকে নিজেরাও হয়তো ঠিক মতো কোরআন পড়তে পারেন না, হয়তো বা জীবনের রূঢ় বাস্তবতা তাদেরকে সে সুযোগ করে দেয়নি। কিন্তু, কোরআনের প্রতি তাদের নিখাদ ভালোবাসায় আমি প্রতিনিয়ত মুগ্ধ হয়েছি।

কোরআন আমি সাধারণত একটু জোরেই পড়ি। একদিন পড়ার মাঝে পাশের এক আপাকে বললাম, ‘দু:খিত আপা, আমি হয়তো আপনার জন্য বিরক্তির কারণ হচ্ছি।’ উনি আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, ‘আপনি পড়ুন, আপনার তিলওয়াত শুনতে আমার খুব ভালো লাগছে।’

পুরোটা রমযানে অসংখ্য নারী আমাকে বলেছেন, ‘আপা, আপনি কি কোরআন শেখান? জানেন, আমার না কোরআন শুদ্ধ করে পড়তে শেখার খুব ইচ্ছা। আপনি কি আমাকে শেখাবেন?’ আমি সবিনয়ে বলেছি, ‘আমার তো সে যোগ্যতা নেই আপা। আপনি বরং ভালো কোনো একজন শিক্ষক খুঁজে নিন।’

কেউ বা হয়তো বলেছে, ‘আপা, আপনি কি আরবী ভাষা শেখান? আমাকে কি শেখাবেন আপা?’ আমি হেসে বলেছি, ‘আমার তো সে সময় নেই আপা, আপনি বরং ভালো কোন ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়ে যান।’

আমাদের মসজিদগুলোতে পুরুষদের জন্য কোরআন কিংবা আরবী ভাষা শিক্ষার নানারকম প্রোগাম আছে। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য, এদেশের বিপুল সংখ্যক নারীরা এখনো এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে আছে। আমার বিশ্বাস, এ দেশের শহর থেকে আরম্ভ করে গ্রাম-গঞ্জের প্রতিটি মসজিদে যদি নারীদের কোরআন কিংবা আরবী ভাষা শিক্ষার যথাযত সুযোগ করে দেয়া হয়, তবে এদেশের কিশোরদের মতো কিশোরীরাও কোরআন দিয়ে একদিন বিশ্বজয় করবে। সেইসাথে তাদের অন্তরগুলো হবে কোরআনের আলোয় আলোকিত।

আর কোরআনের আলোয় আলোকিত এই সমস্ত কিশোরী আর বালিকারাই ভবিষ্যতে এমন জননী হবে, যারা তাদের সন্তানদের আবু সালেহ তাকরীমের মতো বিশ্বজয়ী কোরআনে হাফিজ বানানোর স্বপ্ন দেখবে।

লেখক : গবেষক ও স্থপতি

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *