কেমন আছে নৌকাডুবিতে শহীদপরিবার

কেমন আছে নৌকাডুবিতে শহীদপরিবার

খোঁজে । মুজীব রহমান

কেমন আছে নৌকাডুবিতে শহীদপরিবার

১.
গত আগষ্ট মাসের চার তারিখ। খুবই হৃদয় বিদারক একটা দিন ছিল।এ দিন নেত্রকোনার উচিতপুরে ট্রলার ডুবে শহীদ হন ময়মনসিংহের বেশ কয়েকটি আলেম পরিবারে আঠারো জন সদস্য। চলতি মাসের চার তারিখ এ মর্মান্তিক দূর্ঘটনার এক মাস পূর্ণ হয়।

এ এক মাস সন্তান হারা বাবা মা, স্বামী হারা স্ত্রী,আব্বু হারা মাসুম বাচ্চাদের বেদনাময় দিনগুলো কেমন কাটল খোঁজ নিতে বেড়িয়ে ছিলাম আমরা। উস্তায লাবীব আব্দুল্লাহ ও আমি মুজীব রাহমান। জুমার দিন।তপ্ত রোদ। রোদের তাপে রাস্তার বালু কণাগুলো চিক চিক করছিল খুব।

নৌকা, মটর সাইকেল; এরপর তিন চাক্কার ভ্যান আমাদের নিয়ে ছুটছিল কোনা পাড়ার দিকে।

ঠাডা পড়া রোদ, অসহ্য গরমকে মাথায় নিয়ে আমরা প্রথমে হাজির হলাম শহীদ মাওলানা সাইফুল ইসলাম এর বাড়িতে।
তার ঘরে ঢুকতেই হৃদয়টা ছেদ করে উঠল।

তার পাঁচ বৎসরের আদরের খনি আবরারের দিকে চেয়ে আমরা ঠিক থাকতে পারলাম না।

আবরার এভাবে কাকে খুঁজছো?
আমার আব্বুকে।
এরপরে কী হল? সে ঘটনার বিবরণ আমি লেখতে পারব না। আমাকে ক্ষমা করুন।

উস্তাযের চোখের কোনাতেও পানি।তিনি আবরারকে কুলে তুলে আদর করতে লাগলেন।স্নেহ মমতার হাত বুলিয়ে দিলেন তার মাথায়।
আবরার কে আমি কুলে নিলাম।মাথায় হাত বুলিয়ে পশ্চিম দিকে মাথা ঘুরাতেই দেখি দু’ বৎসরের আরেক শিশু ফারিহা, সাইফুল ভাই এর চোখের কাজল খাটের এক কোনায় ঘুমিয়ে আছে।

ফারিহা তো তেমন কিছু বুঝে না।এরপরও রাতে ঘুমের বিছানায় মাঝরাতে সে তার আব্বুজীকে খুঁজে বেড়ায়। আবরার সারাক্ষণ জানালার কাছে বসে থাকে। তার আব্বু তার জন্য মজা নিয়ে আসবে বলে।

আম্নু! আব্বু আসে না কেন! আব্বুর কী হয়েছে?

উম্মে আবরার মাজেদা বেগমের কন্ঠে তখন চাপাকান্না।পর্দার আড়াল থেকে তিনি আমাদের সাথে কথা বলছেন।

মাজেদা বেগম লাবীব আব্দুল্লাহ সাবের ছাত্রী।

হুযুর! এটা কী ঘটে গেল! আমি এদের কে এখন কীভাবে মানুষ করব? কিছুই বুঝতে পারছি না।

হুযুর আপনি আমার জন্য দুআ করবেন না?

পর্দার আড়ালের সদ্য বিধবা মাজেদা বেগমের চোখের পানি, সন্তান হারা বাবা ইদ্রিস আলীর বোবা কান্না, আদরের টুকরো সন্তান আবরারের চোখের নিষ্পাপ চাহনির কাছে আমরা আবার হেরেগেলাম।

আবরার, ফারিহা আর কোনদিন তাদের আব্বুকে আব্বু বলে ডাকতে পারবে না!

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মাদরাসা থেকে ফিরে এসে তাদের কচি ঘাসের মত নরম গাল দু’টিতে তাদের বাবা আর কোনদিন আদর করবে না!

২.
জুমআর আজান হচ্ছে। আমরা দ্রুত উপস্থিত হলাম শহীদ মাওলানা হামিদুল ইসলামের বাড়িতে।

বাড়ির সামনেই তার বাবা ইদ্রিস আলীকে দেখেই আমরা চিনে ফেললাম। তার দেওয়া জমিতেই তার ছেলেকে সহ আরো নয়জনকে দাফন করা হয়েছে।

ইদ্রিস আলী সাব ছেলেকে আলেম বানিয়েছেন।আশা ছিল ছেলে তার জানাযা পড়াবে। প্রতি ওয়াক্ত নামাজের পর বাবার জন্য চোখের অশ্রু ফেলে ‘রাব্বির হামহুমা…’ পড়বে।কিন্তু না! তার ছেলেই তাকে রেখে তার আগে চলে গেল।এখন বৃদ্ধ বাবা সন্তানের জন্য সবসময় দুআ করেন।কবরের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন,আমার খোকা আমাকে রেখেই এখানে সারাজীবনের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছে। মুরব্বীর গাল, পাটের আঁশের মত সাদা দাড়িগুলো তখন ভিজে একাকার।

হামিদুল ইসলাম ভাই এর দু’ ছেলে সন্তান।দু’জনই কুলের শিশু। আমরা যখন তাদের বাড়িতে ঢুকলাম তখন দু’ জনই ঘুমাচ্ছিল।

তার স্ত্রী গর্ভবতী। গর্ভবতী অবস্থায় মেয়েদের বড় ভরসাস্থল হয় তাদের স্বামীরা। এসময়টা সুখ দুখের গল্প করে,কখনো আবেগের ভেলায় চড়ে কখনো আহ্লাদে, অভিমানে এ সময়টা তারা পাড় করে দেয়।এ মেয়েটা এখন কী করবে?

বিয়ে হয়েছে এখনো দশ পার হয় নি। বিধবা হয়ে গেল সে। কুলে দু’ শিশু। আরেকজন ক’দিন পর আলোর মুখ দেখবে!

এমন মেয়েকে আমরা কী বলে সান্ত্বনা দিব?
৩.
হামিদুল ইসলামের বাড়ি থেকে বের হয়ে মসজিদের পথে আমরা।

এর মাঝখানেই গোরস্থানের দিকে তাকাতেই দেখি এক বৃদ্ধ ঝরঝর করে কাঁদছেন। আরেকজন কবরগুলো ঠিক করছেন। যিনি কবরগুলো ঠিক করছিলেন তিনি ওয়াজ উদ্দীন।মাহফুজ ভাই এর ভাই।

ওয়াজ উদ্দীন ভায়েরও দু’ মেয়ে শহীদ হয়েছে।

হাফেজা লুবনা আক্তার। জুলফা আক্তার। জুলফার বয়স ছিল সাত।লুবনার এগারো।

লুবনার কুরআন তেলাওয়াত ছিল খুবই শ্রুতি মধুর। মাহফুজ ভায়ের তার এ ভাতিজী কে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল।

আমাদেরকে দেখেই ওয়াজ উদ্দীন ভাই এগিয়ে আসলেন।চোখ ছলছল করছিল তার।

এক মাস কেটে গেছে মেয়ে দু’টোকে তিনি ভুলতে পারেন নি।কিভাবে ভুলবেন! পৃথিবীর কোন্ মা বাবা পারবেন আদরের টুকরো সন্তানদের ভুলে যেতে!

ওয়াজ উদ্দীনের চোখে এখন সবসময় একটাই স্মৃতি- সে বসে আছে কিংবা শুয়ে আছে তার মেয়ে দু’টো তার দু পাশে কুরআন পড়ছে।মাঝে মাঝে সে ভুলেই যায় তার মেয়ে দু’টো যে দুনিয়াতে নেই।তাই মাঝে মাঝে জুলফাকে ডাক দিবে দিবে এমন অবস্থায় মনে হয়ে যায় আমার আদরের ধনতো দুনিয়ায় নাই!

ওয়াজ ভাই সাধারণ একজন মানুষ হলেও ঘরে বউ করে নিয়ে এসেছিলেন একজন কুরআনের হাফেজা কে।একটাই উদ্দেশ্য তার যতগুলো ছেলে মেয়ে হবে সবগুলোকেই কুরআনের হাফেজ বানাবে।

যেন পরম যত্নে মাদের কাছেই তার সন্তানরা হাফেজ হতে পারে এ ছিল তার গোপন বাসনা।

বড় মেয়ে লুবনাতো হাফেজা হয়েছিল।জুলফাও শুরু করেছিল।হঠাৎ সবকিছু ভেঙ্গেচুড়ে শেষ হয়েগেল!

ওয়াজ ভাই এর ছোট এক ছেলে আছে।তার এখন আল্লাহর কাছে একটাই চাওয়া এ ছেলেটাকে যেন ভাল আলেম হিসেবে কবুল করে।

৪.
জুমার পর আমরা শহীদ মাহফুজ ভাই এর বাসায়।

আজ যেখানে এসে বসলাম ঠিক এ’ জায়গাটাতেই আরকদিন এসে বসেছিলাম।তখন মাহফুজ ভাই ছিলেন। আজ নেই।

একটা বিষয় আমাকে খুব আপ্লুত করেছে এখানে।এরআগে যখন মাহফুজ ভাই থাকতে এসেছিলাম তখনো সোফাতে বসার এক মিনিটের মাঝে পর্দার আড়াল থেকে আমাদের সামনে লেবুশরবত

পরিবেশন করা হয়েছিল। আজও বসার পরপরই লেবুশরবত আমাদের সামনে পরিবেশন করা হল।

একজন মেহমান আসলে প্রথমে ঠান্ডা পানি কিংবা শরবত পরিবেশন করা উচিত। এ কঠিন দিনগুলোতেও তারা এটা ভুলে যান নি।
মাহফুজ ভাই কি তাদেরকে এভাবেই গড়ে তুলেছিলেন?

মাহফুজ কে নিয়ে আমি দূর্ঘটনার সময় লেখেছিলাম।

তার পরিবারের মোট আট জন শহীদ হয়েছে।

মাহফুজ ভাই এর মোট পাঁচ ছেলে এক মেয়ে।

বড় দু’ছেলে মাহবুব আর মাহমুদ তাদের বাবার সাথেই ছিলেন সেদিন।তাদের বাবার সাথে তারাও চলে গেছে ওপারে।

এখন বেঁচে আছে মাশকুর মাসরুর আর মাসউদ।

মাশকুর আর মাসরুর কাছাকাছি বয়সের। দশ।বারো।

সেদিন তারাও যেতে চেয়েছিল।কিন্তু যাওয়া হয় নি। যদি সেদিন তারা যেত তাহলে কি তারাও…..।

মাশকুর আর মাসরুর এখনো স্বাভাবিক হতে পারে নি।

তাদের মুখদু’টোর দিকে তাকালেই চোখে পানি চলে আসে।এত সুন্দর দু’টো মুখ। অথচ মুখে কোন হাসি নেই। চোখ মুখে সবসময়ই আতংকের ছাপ।
মাশকুর খুব মেধাবী।তার কুরআন তেলাওয়াতও খুব ভালো।সে তার বাবার কাছ থেকে একটা জিনিস শিখেছে। তার বাবা তাকে শিখিয়েছে কারো কোন জিনিষের প্রতি লোভ করা যাবে না। তাই যখন কবর জিয়ারত করতে এসে কেউ চকলেট ইত্যাদি তাদের হাতে দিতে চায় সে নিতে চায় না।তার চোখ মুখ লাল হয়ে যায়।

এত বিপদের মাঝেও ক’দিন আগে ছোট ছেলে মাসউদের ওপর ফ্যান পড়ে গিয়ে মাথায় ও হাতে ব্যাথা পায় সে।

মাহফুজ ভাই নেই।এলাকাবাসী কারোই এটা বিশ্বাস হতে চায় না। তার অনুপস্থিতিতে তার মসজিদের মিম্বার, মাদরাসা দু’টোর প্রতিটি বালু কণা যেন ঠুকরে ঠুকরে কাঁদছে।

৫.
এই ট্রলারডুবিতে মাহফুজ ভাই এর এক ভাগ্নে হাফেজ রেজাউল ইসলামও মারা যায়।

এর আগে দুই হাজার বারোতে তার বাবা মারা যায়।

তার বাবা মারা যাওয়ার পর তাকে ও তার বাকি আর দুই ভাই, দুই বোনকে তাদের মা রেহানা আক্তার খুব কষ্টে লালন পালন করেছে। ভাইদের ভিতরে রেজাউলই ছিল সবার বড়। রেজাউলের বয়স হয়েছিল উনিশ বৎসর। রেজাউল একটু একটু করে বড় হচ্ছিল তার মাও একটু একটু করে হাঁফ ছাড়ছিল।রেজাউল বড় হবে বাকি ভাইবোনদের দেখাশুনা করবে।

কিন্তু রেজাউল চলে গেল। রেজাউলের ছোট ভাই এর নাম রাকিব। সে দশ পারা হিফজ করেছে। ভাই এর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তার চোখেও পানি।

“ভাই আমাদের যে সবাই চলে গেল। প্রথমে বাবা চলে গেল, মামার কাছে বড় হতে লাগলাম। এখন মামাও চলে গেল, ভাইজানো চলে গেল।”
তার আরেকজন ছোট ভাই আছে রাইহান।
৬.
মুফতী আজহারুল ইসলাম। বিয়ে করেছেন সবেমাত্র এক বছর পার হয়েছে। দূর্ঘটনার কয়েকদিন আগে সে ফুটফুটে এক পুত্র সন্তানের বাবা হয়েছে।
সন্তানের মুখের বাবা বাবা মধুর ডাক শুনার আগেই সে চলে গেল দুনিয়া ছেড়ে।

আজহারুল ইসলামের স্ত্রীও অল্প বয়সেই বিধবা হয়েগেল।

আজহারুল ইসলামের স্ত্রীকে তার বাবা মা তাদের বাড়িতে নিয়েগেছে।তাকে অন্যত্র বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে।

এ দূর্ঘটনায় যারা বিধবা হয়েছেন তাদের কয়েকজনেরই বয়স পঁচিশ কিংবা এর কাছাকাছি।

৭. মাহফুজ ভাই এর বাড়ি থেকে আমরা চলে গেলাম গোবিন্দপুর। শহীদ জহিরুল ইসলামের বাড়িতে।

এ পরিবারের অভিভাবক বলতে একমাত্র জহিরুল ভাইই ছিলেন।

তার মৃত্যুর পর বলা যায় এ পরিবারটি একেবারেই অভিভাবক শূন্য হয়ে গেছে।

জহিরুল ইসলামের বয়স যখন মাত্র ছয় বৎসর তখন তার বাবা মারা যায়। তার মা তাকে মাদরাসায় লেখা পড়া করিয়ে মাওলানা বানিয়েছে।
জহিরুল ইসলামের মা খুব বৃদ্ধা। তার প্রতীবেশীরা আমাদেরকে জানাল জহিরুল ইসলাম তার মাকে অনেক ভালবাসত।মাদরাসা থেকে বাড়িতে আসলে তার ছেলে মেয়েদেরকে যেরকমভাবে গোছল করিয়ে দিত।আদর করে খাওয়িয়ে দিত তার বৃদ্ধা মাকেও ঠিক বাচ্চাদের মতই সাবান মেখে গোসল করিয়ে দিত।খাওয়িয়ে দিত।

জহিরুল ইসলামের দু’ মেয়ে এক ছেলে। মুবাশ্বিরা,জাকিয়া,মুজাহিদ। মুবাশ্বিরার বয়স সাত।জাকিয়ার সাতের কাছাকাছি। মুজাহিদের চার।
দু’ বোন বাড়ির কাছেই হিফজ পড়ছে এক মাদারসায়।

জহিরুল ইসলাম আর্থিকভাবে খুব অসচ্ছল ছিলেন।

তার তিন সন্তান স্ত্রীর ভবিষ্যত নিয়ে এলাকাবসাীরাও খুব উদ্বিগ্ন।

মুবাশ্বিরা, জাকিয়া যখন আমাদের সামনে আসল তাদের পোশাক দেখেই আমরা তাদের অর্থনৈতিক বিষয়টা আঁচ করতে পেরেছিলাম।
মুবাশ্বিরা, জাকিয়া, মুজাহিদ খুব লাজুক, শান্ত ও ভদ্র।

এলাকাবাসীর তাদের জন্য খুব মায়া হয়। মেয়ে দুটো অল্প বয়সেই এতিম হয়েগেল।

৮.
এ শহীদ পরিবারগুলোকে গত এক মাসে দেশের বিভিন্ন সামাজিক সংস্থা ও ব্যাক্তিগতভাবেও অনেকেই সাহায্য সহযোগিতা করেছেন।তাদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন।

যা খুবই প্রশংসনীয়।

আমরা খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছি এ পরিবাগুলোর অধিকাংশই অসহায়, দরিদ্র ও অসচ্ছল।

তাদেরকে দীর্ঘ মেয়াদীভাবে কিংবা স্থায়ীভাবে স্বাবলম্বী করা যায় কি না এ ব্যাপারে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

অনুদান প্রদানের ক্ষেত্রে উপযুক্ত পরিবার তা পাচ্ছে কি না এটাও নজর রাখতে হবে।

বিশেষভাবে বিধবা নারী ও শিশুদের জন্য আমাদেরকে ভাবতে হবে। বাড়াতে হবে সহযোগিতার হাত৷

পরস্পরে সহযোগিতায় গড়ে ওঠবে সুন্দর সমাজ৷

যে সমাজে অধিকার পারে পিতৃস্নেহ বঞ্চিত শিশু ও বিধবা৷

শিকড় সাহিত্য মাহফিল

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *