- কাউসার মাহমুদ
তোমার হৃদয়ের কাছে নত হব বলে সমস্ত বিধুরতা মেনে নিলাম। দিনের অন্তভাগে প্রতিদিন সূর্যটি যায় যায়—সেইসাথে ক্রমশ আমার এই পরিত্যক্ত অসহায়তা আরো গভীরভাবে প্রকট হয়। তোমার চোখের মত নির্বাক ঘনভার রাত্রি নামে। পতঙ্গকুল নিশ্চুপ হলেও দু’চারটে পাখির ডাক শোনা যায় মাঝে মাঝে। তবু হায়! অমলিন এ নিঃসঙ্গতার শেষ নেই। যেন আমারই বুকের ভেতর কোথাও একটি কান্নার সমুদ্র পুষে রেখেছি। এত ঢেউ, এত কাকলি তার জলে! সময়ে সময়ে তাই উছলে উঠে চোখের পাতায়। তখন আকাঙ্খা উন্মত্ত হয়। অথচ প্রকাশের সমস্ত ভাষা পক্ষাঘাতগ্রস্তের মত কোথাও পড়ে আছে বুঝি। মনে হয়, ক্লান্তির চাদরে ঘেরা নতভার আমার আকুল শব্দমঞ্জরী। যেন আমারই সৃষ্টির কাছে আমি যেতে পারি না৷ অথবা, দীর্ঘকালীন শোকসন্তপ্ত এ হৃদয়—সেখানে পৌঁছতে পারে না। যেখানে আছে অবিমিশ্র শান্ত, সুবিমল সেই ধ্যানমগ্নতা। অপার লাবণ্যে ঘেরা মোহময় সৃষ্টির তাড়না। অথচ ভূমিগর্ভ থেকে যে অঙ্কুর একদা আমার চোখের ওপরে এসে বাসা বেঁধেছিল।
অতঃপর বহু দিবসের ব্যবধানে সুতনু বৃক্ষের আকারে প্রকাশ্য হয়। তার শাখাপল্লব ও কোমল পাতাসমূহের যে মৃদু আন্দোলন—তা আমি গভীরভাবেই আত্মস্থ করেছিলাম। এতোটাই যে, মনে হত; প্রকৃতির আপন ভাষাটি আমি বুঝি। আমার রোদন থেকে যেসব বেদনা ঝড়ে পড়ে, তারা তা শোষণ করে। নিঃস্বাসে লুকিয়ে রাখে। নতুবা আপন নাভীমূলে সযতনে তুলে রেখে পুষ্পরেণু ফোটায়। কোনো প্রশান্ত দিনে আমারই মুখের ওপর আবার যা ছড়িয়ে দেয়। তারই আঘ্রাণে উপলব্ধি করতাম অরণ্যলোক। যার মাঝে ছোট্টো এক জলধির স্ফটিক জলে আমারই মুখ প্রতিবিম্বিত হত। মনে হত, তরুছায়া ঘেরা কোনো অপার্থিব বনানীর নিমগ্ন সন্তান আমি। কিন্তু! এ কোন্ পঙ্কিল, নিঃসীমতা জড়ানো অবরুদ্ধ দ্বারের সম্মুখে এসে উপস্থিত হয়েছি এখন! ইচ্ছে করে উচ্চ নিনাদে অবিশ্রান্ত ডেকে যাই ‘কতদিন তোমাকে দেখি না হে পৃথিবী, কত ভোর তোমাকে দেখি না হে বসুধা!’
‘তুমি এক দুঃস্বপ্নের ভেতরে আছো। ওই দেখো ভোর! তোমার ক্লেদাক্ত বসন ছেড়ে এখনই জাগো। উঠো! দৃঢ় হও। ঋষির মতো ঋজু হও।’
আমার জরাজীর্ণ জীবনের এই বিশীর্ণ অন্তরীক্ষ—ঘিরে দিল কীসে? কে করিলো আমারে এমন পর! কোথা থেকে এলো এই নিরন্তর অসহ যাতনা; বুঝি না। যেন অনন্তকালধরে অন্তহীন এ পথে হাঁটছি। মাঝে মাঝে নিজেকে প্রবোধ দিয়ে বলি- ‘তুমি এক দুঃস্বপ্নের ভেতরে আছো। ওই দেখো ভোর! তোমার ক্লেদাক্ত বসন ছেড়ে এখনই জাগো। উঠো! দৃঢ় হও। ঋষির মতো ঋজু হও।’ কিন্তু! এরপরও প্রকৃত যা প্রবোধ—তা তো প্রবোধই মাত্র! বাস্তব আলেখ্যে এর না আছে কোনো অবয়বগত শরীর; না আছে ভবিষ্য বিচ্ছুরণ! মূলত নিজের অপারগ যাপন ঘিরে, অসীম অক্ষমতার কাছে নত হওয়ার—এ এক কারুকার্য শোভিত ধূম্রকুণ্ডলী মাত্র। নিজের অজান্তেই যেখানে সৃষ্টি হয় ‘প্রবোধ।’ আকাঙ্খা বিস্তারিত হয়ে নুয়ে পড়ে কখনও কখনও। তারপর হঠাৎই আবার স্ফুরিত হয় বাস্তব দর্শন। আমার সর্বাঙ্গ কাঁপিয়ে দেওয়া সেই ভীত কম্পনটি এতোটাই প্রবল যে, স্ফুলিঙ্গের মত দাউদাউ করে উড্ডীন হয়। অকস্মাৎ দমকা হাওয়ায় যেভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে সদ্য প্রসূত পাখির ছানা—সেভাবে, ঠিক সেভাবেই আমার সমস্ত সত্তার ওপর নেমে আসে এক আতঙ্কবোধ।
বহুদিন বহু পথ খুঁজেও এর থেকে নিস্তার পাইনি। তাই পল্কা, নির্বল, নিস্তেজ এ হৃদয়টাকে ভাগ্যের হাতেই সমর্পণ করেছি এখন। আমি জানি, কোনোরকম কুসংস্কারাচ্ছন্ন নই আমি। তবু হায়! এ জীবন যেভাবে নিস্পিষ্ট করছে আমায়। যেমন কৌহলশূন্য হয়েছে এ দুটো চোখ—তাতে এই নিস্প্রভ সমর্পণই শ্রেয়তর মনে হয়। যেন যা-কিছু ঘটবে, যা-কিছু ঘটছে তা অনিবার্যই। এতো বিষাক্ত পথ পাড়ি দেবার শক্তি নেই আর। কোথাও যাবারও নেই। স্থির করা ভবিষ্যতের সমস্ত গন্তব্য ও কল্পনায় সৃষ্টির যে প্রতুল প্রাচুর্য ছিল—সবই এখন ভাগাড় ও দূরহ ঠেকে। যেন বহুকাল ধরে নিজের ব্যর্থ, ক্লান্ত, পর্যবসিত মুণ্ডুটাই বয়ে চলছি শুধু।
এমনই ভাবাচ্ছন্ন গম্ভীর দূরাগত দৃশ্যরা সমস্ত দিন জড়িয়ে রাখে আমায়। যার ধ্বনি ও উপলব্ধিগত স্বর—গীর্জার ঘন্টাধ্বনির মতোই ইন্দ্রিয়গম্য।
বেদনার এই রূপ ও অঙ্কিত চিত্রের সুসংগত সব শৈল্পিকতাই যেহেতু আমার জানা—তাই অনির্ণেয় সেই অবসাদগ্রস্ততার মুখে যেতে বাঁধা নেই আর। যেখানে দাঁড়িয়ে কোনো সান্ধ্য ভ্রমণের মুখে দেখি একটি সরু সবুজ লতা। কী এক অপার্থিব ব্যঞ্জনায় আমারই প্রবেশদ্বারে লতিয়ে উঠেছে। তার কোমল, স্নিগ্ধ সবুজাভ এতো মনোহর যে, বুঝি কোনো হরিণীর আঁখিমধ্যস্থ বিন্দু জলের ফোঁটা। অথবা ঘোর কৃঞ্চময়ী কোনো রাত্রির বুকে সুডৌল স্তনের মত ভেসে থাকা—কয়েক খণ্ড সাদা মেঘ। ক্রমাগত বিদ্যুৎরেখা খেলে যাওয়া সেই কামিনী রাতের কিনারে উজ্জ্বল পাথরের মত জ্বলতে থাকে যা। তারই সম্মুখে কত রাত যে গত হয়েছে; ইয়ত্তা নেই। ফলত মাঝেমাঝে ভাবি, প্রগলভ উন্মত্ততার এই যে বিভ্রান্তি আমার—তা কী কোনদিনই কাটবে না। বোধের এই জরা ও অনন্ত দুঃখবোধ কী পরম্পরাগত? না হলে এই অসহ বিলোড়ন, স্মৃতির সম্মুখে স্থির নগ্নপদ দাঁড়িয়ে থেকে—কেন এই আত্ম নিপীড়ন? কেন অভ্যস্থ হতে পারি না! প্রাত্যহিক কর্মভারে নুহ্য একইধারার এই দিনাতিপাত, আত্মম্ভরিতার সামনে নিজের অপদস্থতা মেনে কুঁকড়ে যাওয়া। তদুপরি তাদের সেই বিষাক্ত আত্মশ্লাঘা; যা এমনই ক্রুর যে, প্রতি মুহুর্তে দম বন্ধ হয়ে আসে।
ভাবি, মানুষের মুখ, ঠোঁট ও চেতনায়; এই হিংস্রতা আসে কৌথে্থকে? পশুর নখদন্তের মতো তাদের চোখদুটো জ্বলে ওঠে—যেন এই এখনি অপমানে, কটুকথায় ছিঁড়েখুঁড়ে খাবে আমায়। এজন্য কতদিন, কত মুহুর্তে যে, সবকিছু ছেড়ে ছুঁড়ে চলে যাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে—তার হিসেব নেই। অবশ্য পরমুহূর্তেই আবার বাস্তবতার বাগডোর কণ্ঠনালী আটকে ধরেছে। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে নিদারুণ অসহায়তা। যেন অগ্রস্থ একটি পদক্ষেপ প্রবল হীনতা মেনে নির্জীব পিছু হটে আসে। ভাবি,, এই যে ক্রমাগত নিঃসীম অবধারিত যন্ত্রণার মুকুট; যা আমার স্কন্ধজুড়ে ঝুলছে—এ থেকে পরিত্রাণের পথ বুঝি মৃত্যই। কিন্তু হায়! মৃত্যুতেও যে বড়ো ভয় হয়। প্রায় রোজ রাতেই কোনোরকম শরীরটা টেনে যখন বিছানায় যাই—তখন মৃত্যুসম্বনন্ধীয় অজস্র চেতনাসঞ্চার হয় আমার। কীভাবে, কী করে, কী নিয়ে যে ওই প্রকৃত অনন্তের জগতে যাব—তার কোনো যথাযথ উত্তর খুঁজে পাই না।
যেহেতু বিশ্বাসী, তাই মৃত্যু ভাবনায় সবচেয়ে বেশি বিচলিত করে—কবর ও পরকাল। কত মধ্যরাত যে নির্ঘুম ভোরে গিয়ে ঠেকেছে আর নিজের পাপপুণ্যের কথা ভেবে ভেবে অজান্তেই কেঁপে ওঠেছি—তা কী আর লিখে বোঝাতে পারি! তখন আহত শিশুর মত চোখজুড়ে কান্নারা নেমে আসে। ফোঁপানো স্বর লুকোতে বালিশে মুখ বুজি। কয়েক মুহুর্ত পর কিছুটা স্থির হলে, ফজরের প্রার্থনার জন্য দাঁড়াই আর ভাবি, হায়! গতকাল সমস্ত দিন যে পার্থিব যন্ত্রণা আমাকে খোদা বিমুখ করে রেখেছিল—আমার প্রভূ কী তা শুনবেন! কেনই বা শুনবেন! তিনি তো তার গোলামের সেজদার জন্য সামান্য কয়েকটি মুহুর্ত চেয়েছিলেন মাত্র। অথচ হীন, নীচ, অর্থব, পাষণ্ড এ আমি সেটুকু সময় প্রভুর পায়ের সামনে দাঁড়াইনি। এই দোষ, এই অপরাধ আমার—একান্ত আমারই। কোনো অযুহাত কোনো অপারগতার যুক্তিই নেই এখানে। এমনই ভাবনার দোলাচালে কখন যে সেজদাটি বা রুকুটি দীর্ঘায়িত হয়ে যায়—তা আর বুঝতেই পারি না। তখন বিধ্বস্ত দাসের মতো প্রভূর সম্মুখে লুটিয়ে পড়ে এ আকাঙ্খাই জাগরূক হয় মনে, ‘আমার আল্লাহ নিশ্চয় আমাকে ক্ষমা করবেন।’
কোথাও হৈচৈ নেই। কারো চিৎকার, গুমোট হাহাকার কিংবা দুঃখের কোনো আর্তনাদ নেই৷ প্রতিটি ভোরই যেন পৃথিবীর নিষ্পাপ শিশু।
বোধের নির্মল এই ধারাটি স্থির থাকলে হৃদয় প্রশান্ত হয়। চিত্তে আনন্দ আসে। যদিও তা ক্ষণকাল; কিন্তু অভূতপূর্ব এক স্নিগ্ধতায় এর সর্বাঙ্গ ঘেরা। তখন প্রায়শই বাহিরে এসে শান্ত, সৌম্য আকাশের দিকে তাকাই। নির্বিঘ্নে অপলক তাকিয়ে থাকি কিছুক্ষণ। যেন চরাচরজুড়ে কোনো স্বর্গীয় নিঃস্তব্ধতা নেমে আসে। কোথাও হৈচৈ নেই। কারো চিৎকার, গুমোট হাহাকার কিংবা দুঃখের কোনো আর্তনাদ নেই৷ প্রতিটি ভোরই যেন পৃথিবীর নিষ্পাপ শিশু। তাই কল্পনাজুড়ে এত বিচিত্র দৃশ্যের ভেতর ভোরটাকেই কেবল ব্যক্তিগত মনে হয় কোনো কোনোদিন। সেদিন অনাবিল প্রফুল্লতায় মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। যদিও এর মাত্র কয়কে ঘন্টা পরই আবার সেই নিত্যনৈমিত্তিক অসহ্য যাপন। তবু নিজের ক্ষণকালের সে আনন্দটুকু হারাতে দিই না। মূলত উপলব্ধিই করি তা। এছাড়া, এর অধিক কোনো বিলাসিতা নেই আমার। অর্থাৎ আমার দেশের মতো অতো সবুজ, মনোহর, মায়াবতী ঝোপঝাড় আর সবুজ বীথিকা পাবো কই এখানে!
চারপাশ রূদ্ধদ্বার দেয়ালে ঘেরা গম্ভীর এক দালানের ভেতর বাস। এর বাইরের পৃথিবীও একই ধারার। সেখানে, এই কঠোর যাপনের ভেতর—ওই একখণ্ড ছাদ ও তার ওপর ভোরবেলা বিছিয়ে থাকা সে আদিগন্ত আকাশের দৃশ্যপাটটুকুই সঞ্জীব করে তোলে। ভাবি, এ আকাশের তো আর সীমানা নেই। তাবৎ পৃথিবীর ওপরে এই একখানা আকাশই ছড়িয়ে আছে। তাই কোনোদিন সন্ধ্যায় বৃষ্টি হলে, নিশ্চুপ ছাদে গিয়ে দাঁড়াই। চোখ বন্ধ করে ভাবি, যে জল এই আকাশ থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে—এরমাঝে আমার মায়ের অশ্রুপাতI আছে । আমাকে ভেবে তাঁর সেই অশ্রুমঞ্জরী তিনি মেঘের কাছে পাঠিয়েছিলেন। যেগুলো এই এখন আমার চোখমুখ, গ্রীবা, গণ্ডদেশ বেয়ে হৃদয়ের কাছে গিয়ে পড়ছে। তখন প্রবলভাবে মা-কে অনুভব করি আমি। মনে হয়, আমার মা একটি নয়নতারা গাছ। তার কোলজুড়ে দীর্ঘকাল জড়িয়ে থাকা একটি ফুল হঠাৎ কোথায় যেন হারিয়ে গেছে!