কোনদিকে যাচ্ছে কওমী মাদ্রাসা?

কোনদিকে যাচ্ছে কওমী মাদ্রাসা?

আমিনুল ইসলাম কাসেমী

দারুল উলুম দেওবন্দের আদর্শ ও অনুসৃত রীতিনীতিতে চলমান কওমী মাদ্রাসা। আকাবির – আসলাফের পদাঙ্ক অনুসারী এক জামাত, যারা নাকি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের কেতনধারী। এ কওমী মাদ্রাসার সূত্র অনেক দূরে। মক্কার দারুল আরকাম আর মদিনার আহলে সুফ্ফার সাথে গিয়ে মিশেছে এর সূত্রপরম্পরা। আর এ উপমহাদেশে  কওমী মাদ্রাসার গোড়াপত্তন দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে।

দারুল উলুম দেওবন্দের বুনিয়াদ ইখলাস ও আদবের ধারার উপরে। যে কারণে প্রায় দুইশত বছর চলছে অভিন্ন গতিতে। ‘মা আনা আনা আলাইহি ওয়া আসহাবি’- এর উপরে পরিপূর্ণ কদম রেখে চলার অভিপ্রায়। কিঞ্চিত পরিমাণ আদর্শ – ঐতিহ্য ভুলুণ্ঠিত হতে দেয় না এঁরা। যার নজির তথা দৃষ্টান্ত স্হাপন  করে গেছেন পূর্বসুরী ওলামায়ে কেরাম। যারা আদব- আখলাকের মূর্তপ্রতিকের ভূমিকায় ছিলেন।

কওমী মাদ্রাসার বৈশিষ্ট হল হুবহু সাহাবায়ে আজমাঈনদের নকশে নমুনায় নিজেকে পরিচালিত  করা। যেমন সাহাবাগণ ছিলেন পেয়ারা হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ভক্তি- ভালবাসার স্তম্ভ। শত প্রতিকুলতায় সাহাবায়ে কেরাম কখনো পেয়ারা হাবীবকে ভুলে যাননি।  জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কোন সাহাবি পেয়ারা হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সন্মান হানি করেননি। তদ্রুপ এক ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিষ্ঠান দেওবন্দীধারার এ প্রতিষ্ঠানগুলো। আজীবন উস্তাদদের প্রতি ভক্তি ভালবাসার পাপড়ি বিছিয়ে দেয়। উস্তাদ যেমনই হোন না কেন, ভক্তির কোন কমতি নেই। সবসময় শিক্ষককের উপরে শ্রদ্ধাশীল তারা।

ইতিহাসে আজো জ্বল জ্বল করছে শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমাদ মাদানী ( রহ,) এর উস্তাদ ভক্তি। যিনি প্রিয় উস্তাদ শাইখুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দী ( রহ,) এর প্রতি ভক্তি ভালবাসার এমন দৃষ্টান্ত স্হাপন করেছেন যেটা শত শত বছরের ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া দুস্কর। নিজের শায়েখের সাথে স্বেচ্ছায় কারাবরণ! এ যেন এ জামানায় রূপকথার গল্পের মত মনে হবে। তবে সেটা বাস্তব। গল্প নয়। আপন উস্তাদের উপরে ভক্তি- ভালবাসার এক ইতিহাস রচনা করে গেছেন তিনি।

আমাদের দেওবন্দী ওলামায়েকেরামের মধ্যে এমন বৈশিষ্ট প্রগাঢ় হয়ে আছে। সকল মনিষীদের মধ্যে এমন সিফাত ছিল। নিজের শেষ বয়সেও যদি কখনো উস্তাদকে দেখতেন, নিজের অসুস্হতার মধ্যেও যদি প্রিয় উস্তাদের দেখা মিলত, তখন নিজের শারিরিক দুর্বলতা ভুলে গিয়ে উস্তাদের খেদমত এবং ইজ্জতে প্রতি তৎপর হইয়ে উঠতেন।

যখন কাজী সাহেব হযরত তাজাম্মুল আলীকে দেখতেন, তখন নিজের ব্যক্তিত্ব ভুলে যেতেন, কীভাবে উস্তাদের সেবা এবং ইজ্জত করা যায় সেটায় নিমগ্ন হয়ে যেতেন। 

নিকটবর্তী আকাবিরদের কথাই বলি, যাদেরকে স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। শাইখুল ইসলাম  হুসাইন আহমাদ মাদানী (রহ.) এর একজন খলিফা ছিলেন শায়েখ তাজাম্মুল আলী সিলেটি (রহ.)।  তাঁর শাগরেদ ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস আল্লামা কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ (রহ.)।  কাজী সাহেবকে  দেখেছি তাঁর প্রিয় উস্তাদ তাজাম্মুল আলীকে কেমন ভালবাসতেন। যখন কাজী সাহেব তাজাম্মুল আলীকে দেখতেন, তখন নিজের ব্যক্তিত্ব ভুলে যেতেন। কীভাবে উস্তাদের সেবা এবং ইজ্জত করা যায় সেটায় নিমগ্ন হয়ে যেতেন।

আমি দেখেছি মুফতি ওয়াক্কাস (রহ.) কে।  তিনি শায়েখ তাজাম্মুল আলী ( রহ.) এবং আল্লামা কাজী মু‘তাসিম বিল্লাহ (রহ.) এর শিষ্য ছিলেন। মুফতি ওয়াক্কাস এমন আদব- আখলাকী মানুষ ছিলেন যার দৃষ্টান্ত এই জামানায় মেলা ভার। মনে পড়ে মুফতি ওয়াক্কাস সাহেব তখন মন্ত্রী, যশোর ঈদগাহ ময়দানে সেই আশির দশকে ইস্তেস্কার নামাজের জন্য আমরা সেখানে সমবেত হয়েছিলাম। একজন ক্ষমতাসীন মন্ত্রী আপন উস্তাদের সামনে যেন সাধারণ তালেবুল ইলমের মত কথা বলছিলেন। এছাড়া তাঁকে দেখেছি মাওলানা মহিউদ্দিন খান সাহেব ( রহ.) এর সামনে। মহিউদ্দিন  খান সাহেব তাঁর উস্তাদ ছিলেন না। কিন্তু বয়োজৈষ্ঠ মুরুব্বী হিসাবে নিজের উস্তাদের মত তাঁকে ভক্তি করতেন।

আমি দেখেছি শাইখুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ দামাতবারাকাতুহুমকে। তিনি  মাওলানা আশরাফ আলী কুমিল্লাভী ( রহ.) এবং আল্লামা কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ ( রহ.) এর শাগরেদ।  এই তো কয়েকবছর আগের কথা, মাওলানা আশরাফ আলী কুমিল্লাভী (রহ.) তখন হজ থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। ঢাকা এয়্যারপোর্টে আল্লামা মাসঊদ এর সঙ্গে দেখা। সঙ্গে সঙ্গে ফরীদ সাহেব প্রিয় উস্তাদকে অত্যন্ত আদব- ইহতেরামের সাথে ধরে নিয়ে গন্তব্যেো পৌঁছাতে  সাহায্য করলেন। অথচ আল্লামা মাসঊদ তখন নিজেই অসুস্হ। কিন্তু  যতই অসুস্হ হোন, আপন উস্তাদ যখন নিজের সামনে চলে আসেন তখনতো আমাদের আকাবিরগণ নিজের অসুস্হতার কথা ভুলে যান। ঠিকই সেরকম এক অবিশ্বাস্য কাজ করে তিনি দেখিয়েছিলেন। ঘটনাটি সে সময়ে  সাংবাদিকদের ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল।

ফরীদ ঊদ্দীন মাসঊদ সাহেবকে দেখেছি আল্লামা কাজি মু’তাসিম বিল্লাহ (রহ.) এর প্রতি ভক্তি- ভালবাসা। কাজী সাহেব যতদিন বেঁচে ছিলেন তাঁর কাছে গেলে ব্যক্তি ফরীদ সাহেব আর “ফরীদ’ থাকতেন না। সাধারণ ছাত্রের মত হয়ে যেতেন।  মনে পড়ে জামেয়া শারইয়্যাহ মালিবাগের কিছু   দুর্দিনের কথা। যে সময় কাজি সাহেব সন্ত্রাসী বাহিনী কর্তৃক আতঙ্কিত ছিলেন। সেই দুঃসময়ে আল্লামা মাসঊদ নিজের ঘুমকে হারাম করে গভীর রাতে উস্তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেন।

কওমী মাদ্রাসা আদর্শ মানুষ তৈরীর কারখানা।  এটা সম্ভব হয়েছে উস্তাদের প্রতি ভক্তি- ভালবাসার কারণে

আমাদের দেওবন্দী ওলামায়েকেরামের হাজারো দৃষ্টান্ত রয়েছে উস্তাদ ভক্তির। উস্তাদের সন্মান- ইজ্জত যেন ভূলুণ্ঠিত না হয়, কখনো কোন শিক্ষক বেহুরমতি না হন এরকম চেষ্টা করে থাকেন।

কওমী মাদ্রাসা আদর্শ মানুষ তৈরীর কারখানা। এটা সম্ভব হয়েছে উস্তাদের প্রতি ভক্তি- ভালবাসার কারণে। যেখানে শিক্ষক সন্মানিত সেখানেই আদর্শবান মানুষ তৈরী হয়। কওমী  মাদ্রাসার বড় পুঁজি এটা। এটাকে পুঁজি করেই কওমী মাদ্রাসাগুলো শতশত বছরধরে এগিয়ে চলেছে। যেখানে শিক্ষকের সন্মান নেই, যে প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক লাঞ্চিত- অপমানিত, সেখানে কখনো  আদর্শান ছাত্র তৈরী হয়না। যার হাজারো প্রমাণ আমাদের সামনে রয়েছে। রাষ্ট্রের শতশত কোটি টাকা বাজেট করা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আজ আদর্শবান মানুষের অভাব। এর একমাত্র কারণ  শিক্ষকের মর্যাদা নেই। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক অবরুদ্ধ, কোথাও কোথাও লাঞ্চিত হচ্ছে। যে কারণে সত্যিকার মানুষ তৈরী হচ্ছেনা।

বড় দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে লিখতে হচ্ছে। কওমী মাদ্রাসা এখন সেই দিকেই যাচ্ছে। সেই  সোনালী ইতিহাস- ঐতিহ্য ভুলুণ্ঠিত করে আমাদের সন্তানেরা এখন কোনদিকে যাচ্ছে? কোনদিকে  যাচ্ছে কওমী মাদ্রাসা? ইদানিংকালে কওমী তথা দেওবন্দী ধারার  কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে যেসব  অঘটনের জন্ম হচ্ছে সত্যি সেটাতে বুক কেঁপে ওঠে। আজ আমরা কোথায়? কোথায় আমাদের সন্তানেরা?  কয়েকবছর আগে এদেশের উম্মুল মাদারিস খ্যাত হাটহাজারীতে যা ঘটে গেল  তাতে সেসময় থেকে মনে দাগ পড়ে আছে। এদেশের আপামর জনতা এবং ওলামায়েকেরামের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। কেউ কোনদিন কল্পনাও করতে পারেনি একজন শতবর্ষি আলেমের সাথে ছাত্ররা এমন কাজটি করবে।  পুরো দেশের মানুষ যেন হতবাক হয়ে তাকিয়েছিল হাটহাজারির দিকে।

হাটহাজারির ঘটনার দাগ মুছতে না মুছতেই আরেক ঘটনা ঘটে গেল পটিয়াতে। মানে দেশের শীর্ষ দুপ্রতিষ্ঠানই দুষ্ট ছাত্রদের মাধ্যমে কুলুষিত হল।

হাটহাজারির ঘটনার দাগ মুছতে না মুছতেই আরেক ঘটনা ঘটে গেল পটিয়াতে। মানে দেশের শীর্ষ দুপ্রতিষ্ঠানই দুষ্ট ছাত্রদের মাধ্যমে কুলুষিত হল। লাঞ্চিত আর অপমানিত হলেন উস্তাদগণ। বড় আফসোসের বিষয়! আমরা এটা কল্পনাও করিনি কওমী মাদ্রাসাতে এমন ঘটনা ঘটবে। শত শত বছরের ইতিহাসকে তারা কলঙ্কিত করল। কওমী মাদ্রাসার আদর্শ এবং ঐতিহ্যে তারা আঘাত করল। বড় দুঃখজনক।

আসলে দেওবন্দী মাদ্রাসার কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান এর কিছু শিক্ষক এবং ছাত্র আদর্শচ্যুত হয়েছে। যে আদর্শে এই দেওবন্দী ইদারাগুলোর যাত্রা, সে আদর্শ থেকে দূরে সরে গেছে। যে কারণে কোথাও কোথাও এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনার অবতারণা হচ্ছে।  আজ দেওবন্দী দাবি করলেও দেওবন্দীয়্যাত নেই।  কওমী মাদ্রাসার সন্তান দাবি করলেও কওমী মাদ্রাসা কোন ধারায় প্রতিষ্ঠিত সেটার  ধারেকাছে তারা নেই।  তাছাড়া তরবিয়্যাত বিহীন কিছু ছাত্র সংগঠন এবং মুরুব্বীবিহীন কিছু ইজমে বিশ্বাসি ছাত্র এবং বাকপটু লোকের জন্ম হয়েছে কওমীতে। ওরা আমাদের সন্তানদের  মিসগাইড করে যাচ্ছে।

কিছু বাকপটু মানুষ যারা ইতিহাস- ঐতিহ্যের তোয়াক্কা করেনা। ওরা মানেনা আকাবির- আসলাফের বাতলানো পথ। বাকপটু মানুষের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ছুটে চলে উদ্দশ্যহীন গন্তব্যে। পথে পথে তারা নিজেরা হোঁচট খাচ্ছে। সেই সাথে সঙ্গীন করে দিচ্ছে এ মহান ধারাকে। প্রশ্নবিদ্ধ করছে শত শত বছরের পরিচালিত প্রাণের প্রতিষ্ঠানগুলোকে।

হাল-যামানার মুরুব্বীদের প্রতি আরজ, কওমীতে আরো তরবিয়্যাত বাড়ানো সময়ের দাবি।  পাশাপাশি  ছদ্মবেশী লোকের আনাগোনা মুক্ত করতে হবে এ প্রতিষ্ঠান থেকে। দেওবন্দী চিন্তাধারাকে যারা লালন করে না, যারা মুরুব্বীবিহীন, তাদের থেকে দুরুত্ব বজায় রাখা সময়ের চাহিদা।

আল্লাহ তায়ালা সকল দেওবন্দীধারার প্রতিষ্ঠানগুলো হেফাজত করুন। আমিন।

লেখক, শিক্ষক ও কলামিস্ট

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *