কাউসার মাহমুদ : রমজান চলছে এখন। রোজাও রাখা হচ্ছে ঠিকঠাক। এ মাস ইবাদতের যেমন বসন্তকাল। তেমনি ভোজন রসিক যারা আছেন তাদের জন্যও পরম আনন্দের। রসনা বিলাসের তৃপ্তিসাধনায় ডুবে যেতেই মানা কই! ইফতারে হোক না ভুরিভোজ। দু’চারটে মুরগী বিভিন্ন পদের কাবাবা আর খাশির রেজালা খেয়ে অস্থির উদরান্নে স্বস্তি ফিরিয়ে আনুন তারাবীহর পর। ইফতারে আনা এসব খাঞ্চা ভরা সুস্বাদ খাানাদানা প্রস্তুত থাকে মধ্যরাত অবধি। অথবা বেরিয়ে পড়তে পারেন পুরাণ ঢাকার গলিতে গলিতে। নবাবী আমলের জৌলুশ ছাপ কিছুটা হলেও দেখে আসা যাক তাদের অন্দরমহলে। চলুন ঘুরে আসি ইফতার ঐতিহ্যে ভরা আদি বাঙলার সেই পুরণো ঢাকর শহর—ইফতারির মোঘলী আয়োজনে ভরপুর যার গলি ঘুপচি। ডেগ ডেগচী আর খান্দানী সব পিতলের মহা সিন্দুকে ভরা আজিমুশশান খাবার… ইফতারিতে নবাবিয়ানা আয়োজন দেখতে প্রথমেই আপনাকে ঢুকতে হবে পুরান ঢাকার চকবাজারে।
চক আদিকাল থেকেই বিভিন্ন কিছুর জন্য বিখ্যাত। সেই বিখ্যাত প্রসঙ্গে চকের ইফতারও এক অতি বিশেষ অনুষঙ্গ। বলা হয়, ঢাকার চারশো বছর। ‘বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলি’। বোধকরি সেই তেপ্পান্ন গলির কয়েকটি গলি হয়তো চকের’ই ছিলো। মূল কথায় ফিরি। ইফতারির নানারকম মুখরোচক আর চোখ পটকে যাওয়া খাবার দেখতে পারবেন চক বাজারে। এখানকার বিখ্যাত দোকানি যারা আছেন,তারা অধিকাংশই পুরনো রেওয়াজ মেনেই ইফতারের পসরা সাজান। যারা খান্দানি তারা তাদের এ বংশীয় রেওয়াজকে গর্বের মনে করেন। তাই এইকালে এসেও ঐতিহ্যের সবটা মুছে ফেলেননি ঢাকাইয়্যারা। চকবাজার ইফতারিপাড়া মোঘল ঐতিহ্যের ধারক। এখানকার ইফতারির মধ্যে উল্লেখযোগ্য আস্ত মুরগির কাবাব, মোরগ মুসাল্লম, বটিকাবাব, টিকাকাবাব, কোফ্তা, চিকেন কাঠি, শামিকাবাব, শিকের ভারী কাবাব, সুতিকাবাব, কোয়েল পাখির রোস্ট, কবুতরের রোস্ট, জিলাপি, শাহি জিলাপি, নিমকপারা, সমুচা, আলাউদ্দিনের হালুয়া, হালিম, দইবড়া, সৌদি পানীয় লাবাং, কাশ্মীরি সরবত, ইসবগুলের ভুসি, পুরি এবং ৩৬ উপকরণের মজাদার ‘খাবার বড়বাপের পোলারা খায়’সহ কতনা পদ।
এত বাহারি সব আয়োজনের মধ্যেও রমজান মাসে চকবাজারে ইফতার কিনতে গেলে যে কথাটি সবচেয়ে বেশি শোনা যায় তা হচ্ছে, ‘বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙা ভইরা লিয়া যায়’—- এটি তৈরিতে ডিম, গরুর মগজ, আলু, ঘি, কাঁচা ও শুকনো মরিচ, গরুর কলিজা, মুরগির মাংসের কুচি, মুরগির গিলা কলিজা, সুতি কাবাব, মাংসের কিমা, চিড়া, ডাবলি, বুটের ডাল, মিষ্টি কুমড়াসহ ১৫ পদের খাবার আইটেম ও ১৬ ধরনের মসলা প্রয়োজন। আর মোট ৩১টি পদের যে মিশ্রণ তৈরি হয়, তার নামই ‘বড় বাপের পোলায় খায়’। একটি বড় গামলায় এই ৩১ ধরনের পদ দুই হাতে ভালোভাবে মাখিয়ে তারপর ঠোঙায় করে বিক্রি করা হয়। এটি কিনতে ছোট-বড় সব বয়সী রোজাদারের মধ্যে রীতিমতো কাড়াকাড়ি লেগে যায়। কেবল এই আইটেমটির জন্য রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ক্রেতারা ছুটে যান চকবাজারে। এখনো পুরান ঢাকার এমন অনেক পরিবার আছে, যাদের এটি ছাড়া ইফতার জমেই না, পূর্ণতা পায় না তাদের ভোজন বিলাসে। নতুন ঢাকার বাসিন্দারাও দিন দিন এই খাবারটির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছেন।
বর্তমানে মূল্য প্রতি কেজি ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা পর্যন্ত। বিকেল হতেই কথার তুবড়ি ছোটে ‘বড় বাপের পোলা ‘নিয়া : এই লিয়া যান যান। ‘ছব ছেশ, ছব ছেশ’ বলে ডাকতেই থাকা দোকাীরা। ৭৫ বছরের পুরনো এই খান্দানী খাবারের ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়ে দেখা যায়, যার হাত দিয়ে এই আইটেমটির উৎপত্তি তিনি হলেন পুরান ঢাকার বাসিন্দা দাতা মোহাম্মদ কামাল মাহমুদ, যিনি কামেল মিয়া নামে পরিচিত ছিলেন। বরাবরই ছিলেন একজন ভোজনরসিক মানুষ বেচারা কামেল। নানা ধরনের মুখেরোচক খাবার তৈরি করতে জানতেন লোকটা। এই খাবারটিও তারই সৃষ্টি। প্রায় ৭৫ বছর আগে তিনিই প্রথম এই মুখরোচক খাবারটি তৈরি করে এখানে বিক্রি শুরু করেন। বটপাতার ডালায় করে তিনি বিক্রি করতেন ‘বড় বাপের পোলায় খায়’। সেই থেকে আজও পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের কাছে এটি বেশ জনপ্রিয়। তাদের দিলখোশ হয় পাতে ভরা ইফতারী থাকলে। বড় বাপের পোলা যখন মধ্যিখানে সেজে বসে থাকে। তিন পুরুষ পেরিয়ে মোহাম্মদ কামালের বংশধররা এখনো হাল ধরে রেখেছেন এই ঐতিহ্যবাহী খাবারটির। তার মৃত্যুর পর ছেলে জানে আলম মিয়া বড় বাপের পোলায় খায় নামক এই খাবারটি বিক্রি করতেন। ইতোমধ্যে তিনিও গত হয়েছেন।
২৫ বছর ধরে তার বংশধররা এই মুখরোচক আইটেমটি বিক্রি করছেন। সাম্প্রতিককালে মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে এই ইফতার আইটেমটি সম্পর্কে অন্যান্য মানুষ জানতে পেরেছে। এর আগে তারা শুধু জানতেন এই নামে একটি ইফতার আইটেম আছে। প্রকৃতপক্ষে অন্যান্য ইফতারি আইটেমের তুলনায় এটি সম্পূর্ণ আলাদা এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ। যা পাওয়া যায় শুধু চকবাজারে। এখন বিচ্ছিন্নভাবে আরও দু’একটি জায়গায় পাওয়া গেলেও গুণে-মানে সে রকম নয়। কারণ আদি উদ্ভাবকের রহস্যময় মিশ্রণের ফর্মুলাটি সেই পরিবারের মধ্যেই শুধু রয়ে গেছে বিধায়, সেটা আদৌ ‘বড় বাপের পোলায়’ না খেলেও এ নামে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এমন ইতিহাসের পেছনেও নাকি আরেক ইতিহাস আছে। এই খাবার সম্পর্কে অনুসন্ধানে নামলে অন্য খবরও মিলে যায়। বলে না ইতিহাস চরকার মতো ঘুরে।
পুরাণ ঢাকার খবর যখন জড়িয়ে থাকে ঐতিহ্যে তখন ব্যাপারটা কেমন বুঝতেই পারছেন। হেহে! পুরান ঢাকাইয়্যা একজন তার ব্লগে ব্যাপক ইতিহাস টেনে এনে ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ সম্পর্কে লিখে : ”এটা একটা মিথ্যা ডায়লগ। আমার জন্মা পুরান ঢাকায়। পুরান ঢাকার ইফতার ঐতিহ্যের সঙ্গে আমার পারিবারিক যোগসূত্রও আছে। সে হিসেবে জানি অনেককিছুই। বড় বাপের পোলায় খায়’ এ উদ্ভট খাবারটি আসলে এসেছে ২০০০ সনের পরে। এর আগে আমরা এ খাবারের নামও শুনিনি। আপনি বিশ্বাস না করলে আদি ঢাকাইয়্যা যারা আছে,তাদের থেকে খোঁজ নিয়ে আসুন। মূলত: এক মুড়ি বিক্রেতা মুড়ি মাখিয়ে বিক্রি করতো।তার উর্বর মস্তিস্ক থেকেই এ নামের উৎপত্তি। এমন তত্ত্ব-তালাশের পর একরকম চিন্তা চলে আসে। এমন মুখরোচক একটা খাবারকে ঐতিহ্য ছেড়ে চলে যাবে মানতে কেমন আহা! আহা! লাগে। আরেকটু ব্যাপার হাতড়ে যখন দেখি,তখন এ বেচারার কথাটা অতটা পোক্ত মনে হয়নি আর। সে ভিন্ন কথা। খবর যাইহোক। ভোজন ভিলাসী যারা আছেন তাদের অত ভাবনার কারণ নেই। বড় বাপের পোলায় খায়’ খাওয়া তো যেতেই পারে। মানা তো আর নেই। আর তা ছাড়া খাবার সময় একটু ইতিহাস-ইতিহাস, ঐতিহ্য -ঐতিহ্য মনে করে খেলেই হলো। ব্যাস! ল্যাঠাও চুকে গেল। উদর পূর্তিও হলো জমজমাট। ঢাকাইয়্যা খাবার কিন্তু বেশ উমদা। তো এবার হবে নাকি একচোট!?? আর যারা প্রথম খেতে যাবেন, তারা এসে অবশ্যই গিন্নিকে চিঠি লিখবেন মুজতবা আলীর ভাষায় ”বহুকাল পর চকের ইফতার ও বড় বাপের পোলায় খায়’ খেয়ে বিমলানন্দ উপভোগ করলুম। নজির হোসেন’র কিংবদন্তির ঢাকা পড়লে আরও বিস্তর জানতে পারবেন আপনি।
ঢাকা শহরকে নিয়ে লেখা অমন একখানা বই দ্বিতীয়টি কিন্তু আর নেই আমাদের এ তল্লাটে। সেখানেই পাবেন মোঘলী আমলের সেই জাঁকজমকপূর্ণ ইফতার সমাচার। এ ছাড়াও চকের ইফতারির কিছু বিবরণ রেখে গেছেন আবু যোহা নূর আহমেদ। তিনি লিখেন, সে সময় খাবারগুলো ছিল_শিরমলি, বাকেরখানি চাপাতি, নান রুটি, কাকচা, কুলিচা, নানখাতাই, শিক কাবাব, হান্ডি কাবাব, মাছ ও মাংসের কোফতা, শামী ও টিকা কাবাব, পরাটা, বোগদাদী রুটি, শবরাতি রুটি, মোরগ কাবাব, ফালুদার শরবত ও নানারকম ফল। এসব শাহী খাবারের সামান্যও না পান,কিঞ্চিত কিন্তু এখনও পাবেন চকের গলি-ঘুপচিতে। পুরান ঢাকার বংশালের আল রাজ্জাক রেস্টুরেন্ট, আল-নাসের, রায়সাহেব বাজারের ক্যাফে ইউসুফ, আল-ইসলাস, মতিঝিল ঘরোয়া স্টার ঐতিহ্যের মিশেলে তাদের মানসম্মত খাবারের সম্ভার সাজায় রোজার প্রথম দিন থেকেই। ঈদানিং কয়েকবছর যাবৎ ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরায়ও (আইসিসিবি) শুরু হয়েছে ইফতারির বিশাল আয়োজন। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বাহারি ইফতার নিয়ে আয়োজন করা হয় ইফতার বাজার। আরেকটা কথা যারা শুধু খাবার জন্যই বেঁচে থাকেন তাদের ব্যাপারে একটা মন্ত্র মনে পড়ে গেলো।তা কথাটা এ লেখায় অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু ওই ব্যাটা- রসের হাড়ী, মুজতবা আলী তার ‘আহারাদি’ লেখায় লিখেছেন: ‘বৈদ্যরাজ বলেছেন, দীর্ঘজীবী হয়ে যদি বহুকাল ধরে উদরমার্গের সাধনা করতে চাও, তবে বীজমন্ত্র হচ্ছে ‘জীর্ণে ভোজনং’। অর্থাৎ হজম না করা পর্যন্ত পুনরায় আহারে বসবে না।