চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও আলেম সমাজের প্রস্তুতি

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও আলেম সমাজের প্রস্তুতি

  • মুফতী ফয়জুল্লাহ আমান

সমাজ ও সভ্যতা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তন কখনও ধীরলয়ে কখনও প্রবল বন্যার বেগে। ধীরলয়ের পরিবর্তনকে বিবর্তন বলে। দ্রুত গতির পরিবর্তনকে বলে বিপ্লব। পৃথিবীতে যত বিপ্লব এসেছে এর মাঝে সবচেয়ে বড় বিপ্লব ছিল রাসূল সা.-এর আবির্ভাবের মাধ্যমে। খুব সল্প সময়েই বিশ্ববাসীর মাঝে বিরাট এক পরিবর্তন এনেছিল সেই বিপ্লব। সেসময় তথ্যপ্রযুক্তি ছিল না, বিমান বা বাস ট্রেনও ছিল না, ছিল না বিদ্যুত ও অন্যান্য আধুনিক প্রাযুক্তিক সুবিধা। কিন্তু পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে রাসূল সা.-এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল অভাবনীয় দ্রুতগতিতে।

এই উদাহরণ থেকেই বিপ্লব শব্দের ধারণা নেওয়া সহজ হবে। মূলত পরবর্তী প্রতিটি বিপ্লবে এর একটা প্রত্যক্ষ প্রভাব উপলব্ধি করা যায়। কারণ রাসূল সা. জ্ঞান বিজ্ঞানের বন্ধ দরজা খুলে দিয়েছিলেন। বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক সব পরিবর্তনে সমভাবে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহ যে ভূমিকা রেখেছে তার মূলে রাসূল সা.-এর সীরাত ও সুন্নাহ ক্রিয়াশীল।

আমাদের নিকট অতীতে চিন্তাগত বিপ্লবের দুটি বড় দৃষ্টান্ত রয়েছে, ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯) ও রুশ বিপ্লব (১৯১৭)। এ দুটির প্রত্যক্ষ প্রভাব ইউরোপের বিশেষ অঞ্চলে সীমাবদ্ধ, নিঃসন্দেহে ইসলামের মত সর্বব্যাপী সর্বপ্লাবি নয়। কিন্তু বিপ্লব কেবল ধর্ম দর্শন ও চিন্তাচেতনায় নয়, প্রযুক্তিগত বিপ্লবও ঘটে মানব সভ্যতায়। এই শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভ্যুলেশন প্রথম ব্যবহৃত হয় ১৮৮০ সালে ইংরেজ ঐতিহাসিক আর্নল্ড টয়েনবির একটি গ্রন্থে। সেখানে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব ঘটার কারণগুলো বিশ্লেষণ করা হয়।

আমরা এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কালে প্রবেশ করেছি। এর অর্থ এরআগে পৃথিবীতে আরও তিনটি শিল্প বিপ্লব ঘটে গেছে। প্রযুক্তিগত প্রথম বিপ্লব ঘটে বাষ্পিয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে। ১৭৬০ থেকে ১৮৪০ এর মাঝে এই বিপ্লব সংঘটিত হয়। ১৮১৯ সালে প্রথম ইঞ্জিন চালিত জাহাজে সাগর পাড়ি দেওয়া হয়। ১৮৩০-এর দশকে রেলগাড়ি আবিস্কার হয়। ১৮৪০-এর দশকে আবিস্কার হয় টেলিগ্রাফ। ১৮৭০ সালে বিদ্যুৎ আবিষ্কারের মাধ্যমে দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের সূচনা হয়। ঊনবিংশ শতকের শেষ ও বিংশ শতকের শুরুর দিকে মানব সভ্যতায় যার ফলে বিপুল পরিবর্তন দেখা যায়। বিদ্যুতের সাথে সাথে টেলিফোন, সিনেমা, বাই সাইকেল, মটর কার এবং উড়োজাহাজ আবিস্কৃত হয় কাছাকাছি সময়ে। এসময় সংবাদপত্রেরও উদ্ভব ঘটে।

তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের কাল ধরা হয় বিংশ শতকের শেষ ও একবিংশ শতকের শুরু। ১৯৬০এর দশকে কম্পিউটার এবং ৯০এর দশকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে এই বিপ্লব সাধিত হয়। এভাবে শিল্পবিপ্লবের বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে আমরা প্রবেশ করেছি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে। এ বিপ্লব আমাদের উৎপাদন, পেশা, সম্পদ বণ্টন এমনকি আমাদের সত্তারও ব্যাপক পরিবর্তনের ইঙ্গিত প্রদান করছে। এর পরিধি, গতি ও প্রভাবের গভীরতা ও ব্যাপকতা আগের যে কোনো বিপ্লবের চেয়ে অধিক।

প্রযুক্তির বিকাশের ইতিহাস লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এ জগতের নতুন নতুন উদ্ভাবন মানুষের চারপাশকে পরিবর্তন করছে। শক্তিশালী প্রযুক্তির আবিষ্কার পরিবর্তনের গতিকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। আগের সব আবিস্কারে মানুষ তার চারপাশকে পরিবর্তন করেছে। এখন যে যুগে বাস করছি সেখানে স্বয়ং মানুষের সত্তায় বিরাট পরিবর্তনের ইঙ্গিত রয়েছে। মানুষ তার নিজের বিকল্প তৈরি করছে। যেটাকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বলা হচ্ছে। মানুষকে হাইওয়ানে নাতিক তথা বুদ্ধিমান প্রাণী বলা হয়, এখন একটি জড় যন্ত্র আবিস্কারের দ্বার প্রান্তে আছি আমরা, যেটা জড় হওয়া সত্ত্বেও মানুষের মতই বুদ্ধির অধিকারী হবে। ইতোমধ্যেই এমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট আবিস্কৃত হয়েছে।

এছাড়া স্বয়ং চালিত ড্রোন, চালকবিহীন গাড়ি এবং যন্ত্র চালিত বিভিন্ন প্রোগ্রাম ইতোমধ্যেই যাত্রা আরম্ভ করেছে বিভিন্ন দেশে, যা সামনের দিনগুলোতে আরও অগ্রসর হতে যাচ্ছে। ন্যানো প্রযুক্তি, বিগ ডাটা, ত্রিমাতৃক প্রিন্টার ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নতুন এক বিপ্লবের সূচনা করবে। এখন যেভাবে কোনো একটি লেখার ডকুমেন্টে ক্লিক করে কাগজ বের করে আনা যাচ্ছে; একইভাবে নতুন থ্রি ডি প্রিন্টারে যে কোনো পণ্যই এক ক্লিকে তৈরি করা যাবে। একটা সুন্দর প্লেট বা গ্লাস বা যে কোনো পণ্য আপনার পছন্দ হলো, আপনি কম্পিউটারে সেটির ছবিতে ক্লিক করবেন আর সাথে সাথে আপনার প্রিন্টার থেকে তা বের হয়ে আসবে স্বল্প সময়ে।

অবিশ্বাস্য সব ভাবনা নিয়ে এগিয়ে চলেছে একবিংশ শতকের বিজ্ঞানীরা। এর সূচনা বলা চলে করোনা ভাইরাসের সময়েই হয়ে গেছে। ২০১৬ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের নির্বাহী সভাপতি জার্মান প্রকৌশলী অধ্যাপক ক্লাউস শোয়াব সর্বপ্রথম এই যুগকে চিহ্নিত করেন। তারপর অন্য অনেকেই সেটির বর্ণনা দিয়েছেন। ২০১৬ সালে এর বিকাশের সময় ধরা হয়েছে ২০২৫ সাল। তবে উপমহাদেশের মত অনুন্নত দেশে কিছু বিলম্ব তো হবেই।

কিন্তু ২০৩০ সালের ভেতরেই বিশ্বব্যাপী এই বিপ্লবের বিকাশ ঘটার বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করা যায়। কারণ দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের প্রভাব যেসমস্ত অঞ্চলে পৌঁছেনি সেসব অঞ্চলেও তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের প্রভাব পৌঁছে গেছে, বিদ্যুৎ নেই যেখানে সেখানেও ইন্টারনেট আছে, আছে আন্তর্জালের সুবিধা। একই রকম গতিতে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বময়। বরং ভবিষ্যতের পরিবর্তনগুলো আরও অধিক দ্রুতগতির হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। একটি প্রযুক্তি আরও দশটি প্রযুক্তি আবিস্কারে সহায়ক হবে। একেকটি পরিবর্তন আরও আরও পরিবর্তনের দরজা খুলে দিবে।

নতুন প্রজন্মের উপর ইন্টারনেটের প্রভাব বুঝতে এম আইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শেয়ি টার্কলের গবেষণা দেখুন। তিনি বলেন, ৪৪% টিন এজার্সরা কখনই ইন্টারনেট থেকে সংযোগ কাটে না। এমনক খেলাধুলার সময় কিংবা খাওয়ার সময়ও তারা অনলাইন থাকে। সামনা সামনি বসে গল্প গুজবের দিন ক্রমেই শেষ হয়ে আসছে। পুরো প্রজন্ম এখন সোস্যাল মিডিয়ায় ব্যস্ত, একমুহূর্তের জন্য সেখান থেকে চোখ তুলতে প্রস্তুত নয়। চোখ সরালেও মনোযোগ থাকছে সেখানেই। এরা কাছের লোকের কথা শুনতে নারাজ। এমনকি চোখে চোখ রেখেও কথা বলতে চায় না। টার্কল আরও কয়েকটা গবেষণার কথা উল্লেখ করেছেন।

তিনি দেখছেন যে, দুটো মানুষ একসঙ্গে বসলেও কথা বলছে ইন্টারনেট নিয়ে। এ থেকেই আপনি এই প্রযুক্তির প্রভাব সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারবেন। টার্কল বা অন্য কোনো গবেষকের গবেষণার প্রয়োজনও আসলে নেই, বাস্তবতা আমাদের সবার চোখের সামনেই আছে। আমরা এর ভেতর দিয়েই সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। আপনি দেখবেন ধর্মীয় অঙ্গনের কোনো বক্তা বলেন, রাজনৈতিক নেতা বলেন বা বড় মুফতী ও মুহাদ্দিস, তাদের সবার হাতে সর্বক্ষণ মোবাইল সেট রয়েছে। পত্রপত্রিকা বা সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের যেসব ছবি প্রকাশ পায় সেগুলোতে দেখুন, শতকরা দশভাগ ছবিতে হয়ত হাতে মোবাইল দেখা যাবে না। এছাড়া ৯০% স্থির চিত্রে মোবাইল হাতে নিয়ে আছেন স্কলাররা। হাতে না থাকলেও অবশ্যই সামনের টেবিলে থাকবে।

হয়ত একজন ধর্মীয় আলোচক কোনো অনলাইন লাইভ প্রোগ্রাম করছেন তার হাতে সার্বক্ষণিক মোবাইল সেট রয়েছে। অনেক সময় ওয়াজের মাঝেই মোবাইল খুলে রেফারেন্স চেক করতেও দেখা যায়। এটা বিরাট পরিবর্তনেরই স্পষ্ট দলিল। এরচেয়েও অধিক প্রভাব নিয়ে আমাদের আঙিনায় হাজির হতে যাচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। প্রসংগত বলে রাখি ইন্টারনেটে সীমাতিরিক্ত ব্যবহারের ক্ষতি সম্পর্কে আলেম সমাজের স্পষ্ট ধারণা থাকা উচিত। তরুণ আলেমরা কিতাবাদি না পড়ে সারাদিন অনলাইনেই সময় দিচ্ছেন। এভাবে অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের ফরে তাদের দক্ষতা দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

নিকোলাস গাড়ি প্রযুক্তি নিয়ে লেখেন। তিনি বলছেন, ডিজিটাল সাগরে আপনি যত বেশি ডুব দেবেন, আপনার জানার ও শেখার ক্ষমতা তত বেশি কমবে। ইন্টারনেটের ডিজাইনটাই এমন যে, সেটা আপনার মনোযোগ নষ্ট করবেই করবে। ঘন ঘন ইন্টারনেটে ডুব দিলে চিন্তা ভাবনার ক্ষমতা কমবে, মনে রাখার শক্তি কমবে, আর আপনাকে সহজেই টেনশনে ফেলবে। জরুরি বিষয়গুলো আপনি কাজের সময় মনে করতে পারবেন না। সেই ১৯৭১ সালে অর্থনীতিতে নোবেল জয়ী হার্ভার্ড সাইমন বলেছিলেন, আপনার তথ্য সম্ভার আপনার মনোবিবেশ করার ক্ষমতায় দারিদ্র্য আনবে।

এখনকার সময়ে এই অবস্থা আরও খারাপ। এত ব্যাপার মাথার মধ্যে নিলে সমস্যা তো হবেই। বিশেষ করে অদরকারী তথ্য নিয়ে মাথা ভর্তি করলে টেনশন বাড়তে বাধ্য। কেবল গতি নয়, স্থিরতা দরকার আমাদের। পি ডি এফ ফাইল বা সফট কপি না পড়ে হার্ড কপি পড়তে অভ্যস্ত হোন। পিকো আয়ার বলেন, আমি অনেক বিশ্বনেতাদের বলতে শুনেছি, আমাদের আর দম ফেলবার ফুরসত নেই। তাদেরকে আমাদের তরফ থেকে বলতেই হয়, একটু থামুন। একটু চিন্তা করুন। ইন্টারনেটের বিরাট গবেষণার পাশাপাশি বই বা কিতাব থেকে প্রতিদিন সামান্য হলেও পড়ুন। নেটের জ্ঞান চর্চা করতে গিয়ে কুরআন যেন পরিত্যক্ত না হয়ে সে বিষয়ে মুসলিমদের অবশ্যই ভাবা উচিত। এমন যেন না হয় সারা দিনে একটিবারের জন্যও আপনি কুরআন খোলার সময় পেলেন না।

আন্তর্জালের নেতিবাচক দিকগুলো সামনে রেখেই ইতিবাচক দিক সম্পর্কে আলোচনা করতে হবে আমাদেরকে। সবচেয়ে বড় কথা ইতিবাচক হোক কি নেতিবাচক এর প্রভাব থেকে আমাদের কারও পক্ষেই মুক্ত থাকা সম্ভব নয়। বিশেষত আমরা নতুন যে পরিস্থিতির সম্মুখিন হতে যাচ্ছি সেসম্পর্কে আমাদের স্পষ্ট ধারণা রাখতে হবে। তা না হলে এই পরিস্থিতি মুকাবেলা করা আমাদের পক্ষে মোটেও সম্ভব হবে না।

যতই দিন যাচ্ছে আমরা যেন এক কল্পিত জগতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। একই সাথে জীববিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান ও ডিজিটাল জগতের অনন্য সম্মিলন ঘটাচ্ছে এই চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। আসছে মুদ্রা ব্যবস্থায় পরিবর্তন। ভার্চুয়াল বা ডিজিটাল মুদ্রা হিসেবে বিভিন্ন ক্রিপ্টো কারেন্সি ইতোমধ্যেই চালু হয়েছে বিভিন্ন দেশে। বিট কয়েন এমনই একটি ক্রিপ্টো কারেন্সি। বিট কয়েনের মত ক্রিপ্টো কারেন্সি কতটা অগ্রসর হবে বলা না গেলেও কারেন্সির ডিজিটালাইজেশন এক নিশ্চিত বাস্তবতা। আমাদের দেশেও বিকাশ, নগদ ও অন্যান্য মোবাইল ব্যাঙ্কিংয়ের পথচলা শুরু হয়েছে ইতোমধ্যেই। সামনের দিনগুলোতে তা আরও বৃদ্ধি পাবে নিঃসন্দেহে। একসময় হয়তো হাতে কোনো টাকা পয়সার লেনদেনই হবে না।

এককথায় রাজনৈতিক সামাজিক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে এক বিরাট পরিবর্তন আমাদের ঘরের কড়া নাড়ছে। সামরিক ক্ষেত্রেও আন্তর্জালিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে। অস্ত্রের যুদ্ধের চেয়ে সাইবার যুদ্ধ এখন কঠিন হয়ে উঠছে। বড় সমস্যা দেখা দিচ্ছে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিয়ে। অবাধ তথ্য প্রবাহ মানুষের প্রাইভেসির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার না শিখলে সেই হুমকি আরও প্রগাঢ় হয়ে দেখা দিবে।

স্বাস্থ ক্ষেত্রে ডাটার ব্যবহার হলে স্বাস্থ সুরক্ষা আগের চেয়ে অনেক সহজ হবে। প্রত্যেকের শারীরিক অবস্থা যন্ত্রের মাধ্যমে নিরীক্ষণ করা হবে। অতীতে কি কি মেডিসিন গ্রহণ করেছে, এবং কি ধরনের সেবা গ্রহণ করেছে তার সব তথ্য সংরক্ষিত থাকবে আন্তর্জালে। জিন পরিবর্তনের মাধ্যমে অনেক রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব হবে। এভাবে জিন পরিবর্তন করে মানুষের স্বভাব পরিবর্তনের চেষ্টাও ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। জেনেটিক প্রকৌশলী ডিজাইনার ইচ্ছামত বাচ্চা তৈরি করবে। তার ফল দাঁড়াচ্ছে এই যে, মাতৃত্ব আর পিতৃত্ব এক ধরনের ভোক্তা-ক্রেতা।

বাচ্চা কেমন চাই সে বিষয়ে তারা জেনেটিক গবেষণাগার আর কোম্পানিতে অর্ডার দিতে পারবে। বাবা মা বলে দিবে এমন একটা বাচ্চা চাই, সাদা হবে, নাক টা খাড়া হবে, গালে টোল পড়বে, চটপটে হবে, বাবা মা দোকানে অর্ডারের সময় বলবে বাচ্চাটা যেন সুন্দর হয়, ভালো হয়। বরং বাবা মাকে বলতেও হবে না। আমাজন ও নেটফ্লিক্সের মতো কোম্পানি ইতোমধ্যে ভোক্তাদের চাহিদা বুঝতে শিখে গেছে। আপনি কি পছন্দ করেন, কি ধরনের বই পড়তে ভালোবাসেন, এবং অবসরে আপনার কি ভালো লাগে খুব সাধারণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তা বলে দিতে পারবে।

মাদ্রাসা শিক্ষা ইসলামী সমাজের জন্য অবিচ্ছেদ্য অংশ। মাদ্রাসা ধর্মীয় শিক্ষার কেন্দ্র। ধর্ম ও নৈতিকতা শিক্ষা মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করে। মাদ্রাসা শিক্ষার প্রভাব ধরে রাখা এজন্যই খুব জরুরি। মানুষ নিত্য নতুন প্রযুক্তি আবিস্কার করবে। প্রযুক্তি শারীরিক অসুখ দূর করবে, নষ্ট টিস্যু মেরামত করে দেবে, বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিবে; কিন্তু প্রযুক্তি মানুষকে ভালো মানুষে রূপান্তরিত করতে পারবে না।

মানুষ সত্যিকার মানুষ বা ইনসানে কামিল হবার জন্য ফিরতে হবে ধর্ম ও নৈতিকতা শিক্ষায়। কুরআন ও সুন্নাহর মাধ্যমে সেই শিক্ষা অর্জন করতে হবে মুসলিম উম্মাহকে। শেখাতে হবে বিশ্ব মানবতাকে। মুসলিমদেরকে অবশ্যই মানবজাতির শিক্ষক ও প্রশিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। মাদ্রাসার ছাত্রদেরকে সেজন্য আগামী দিনে যথেষ্ট প্রস্তুত থাকতে হবে। বিশ্ব মানবতাকে শেখাতে হলে আগে প্রস্তুত করতে হবে নিজেদেরকে। আত্মিক মানসিক স্থিতিশীলতার পাশাপাশি তাদের প্রযুক্তিগত বাহ্যিক সার্বিক ব্যবস্থাপনাতেও হয়ে উঠতে হবে দক্ষ প্রাজ্ঞ।

আসহাবে কাহফ তথা সাত গুহাবাসীর ইতিহাস নিয়ে মিসরের বিশিষ্ট সাহিত্যিক তাওফিক আল হাকীম একটি নাটক রচনা করেন। সেখানে দেখা যায় তিনশতাধিক বছর পর ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে গুহাবাসী সাত যুবক যখন তাদের সমাজে আসলো, সেখানে সব কিছু ততদিনে বেশ পরিবর্তন হয়ে গেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে তারা বেচে থাকার আগ্রহ হারিয়ে ফেললো। একই কথা আমাদের এই নতুন সময় নিয়ে। আমরা যদি সময়ের পালস ধরতে না পারি তাহলে সমাজে চরমভাবে অপাংক্তেয় হয়ে থাকতে হবে আমাদেরকে। ইমাম আবু ইউসুফ রহ. বলেন, যে ব্যক্তি তার যুগ সম্পর্কে ধারণা রাখে না সে মূর্খ। আমাদের অর্জিত ইলমকে সমাজে বাস্তবায়ন করতে হলে সমাজের সম্পর্কে রাখতে হবে স্পষ্ট ধারণা। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ থেকে নিজেদের পিছিয়ে রাখলে সাধারণ সমাজে কাজ করা হয়ে যাবে কঠিন।

ইতোমধ্যেই মাদ্রাসার ছাত্রদের রুচি ও মানসিকতায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। দশ পনের বছর আগেও হাদীস ও তাফসীরের কিতাবগুলো পুরনো হাতের লেখা কপি সংগ্রহ করতো ছাত্ররা। উস্তাদরা বলতেন, কম্পিউটার কম্পোজ করা কিতাবাদি কিনলে আকাবিরদের সেই বরকত থেকে মাহরুম থাকতে হবে। এক দেড়শ বছর আগের ছাপা কিতাব কিনত মাদ্রাসা ছাত্ররা। কয়েকজন প্রকাশক কম্পোজ করে কিতাব ছেপে চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন সেসময়। কিন্তু এখন প্রতিটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে কম্পোজ করে পাঠ্যপুস্তক ছাপানো হচ্ছে।

তরুণ শিক্ষার্থীরা পুরনো ছাপার কিতাব খুব কমই কিনছে। কয়েক বছরেই হয়ত বাজার থেকে পুরনো ছাপার কিতাবগুলো একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই পরিবর্তন হচ্ছে মাদ্রাসা অঙ্গনেও। একসময় মোবাইল ফোনের উপর যে বিধি নিষেধ ছিল মাদ্রাসার অভ্যন্তরে তা কিছুটা শিথিল হওয়া শুরু হয়েছে। স্যোশাল মিডিয়ায় অসংখ্য তরুণ শিক্ষক ও শিক্ষার্থি একটিভ আছেন। কিন্তু ফেসবুককেই অনলাইন এক্টিভিটির একমাত্র ক্ষেত্র বানিয়ে নিয়েছে অধিকাংশ মাদ্রাসা ছাত্র।

আন্তর্জালের সামগ্রিক ও ব্যাপকতর ক্ষেত্র নিয়ে ভাবনা খুব কম তালিবুল ইলমের মাঝেই আছে। অবশ্য এর জন্য আমাদের কেন্দ্রসমূহ থেকে কোনো দিক নির্দেশনা এখনও আসেনি। নতুন সময়ের চাহিদা সামনে রেখে মাদ্রাসাবোর্ডগুলোর নীতি নির্ধারকদের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট নীতিমালা ও নির্দেশনা আসা অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। নতুন সময় সামনে রেখে কারিকুলাম ও পাঠ পদ্ধতির পরিবর্তন নিয়েও নেই কোনো প্রয়াস।

দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা কাসিম নানুতুবি রহ.কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, দেওবন্দি মাদ্রাসা থেকে বের হয়ে একটা ছেলে কী করবে? সরকারি চাকরি তো পাবে না? কাসিম নানুতুবি রহ. বলেছিলেন, উপার্জনের জন্য মোট ক্ষেত্র চারটি, কৃষি, শিল্প, ব্যবসা ও চাকরি। মাদ্রাসার ছেলেরা সরকারি চাকরির সুযোগ না পেলেও অন্য তিনটি ক্ষেত্রের মাধ্যমে উপার্জন করতে সক্ষম হবে। কিন্তু বর্তমান সময়ে শিল্প কৃষি ও ব্যবসা প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রযুক্তির বিপুল ব্যবহার রয়েছে। নবপ্রযুক্তি সম্পর্কে একাডেমিক শিক্ষা ছাড়া কোনো পেশাতেই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা যাবে না।

আরবি ভাষা আমাদের এক বড় সম্পদ। আধুনিক সময়ের শ্রম বাজারেও এর চাহিদা রয়েছে। কিন্তু প্রাচীন আরবির পাশাপাশি আধুনিক আরবিও জানতে হবে। আধুনিক আরবিতে দক্ষ হতে হলে ইংরেজি ভাষাটাও শিখতে হবে। কারণ আধুনিক আরবির এক বিরাট অংশ জুড়ে ইংরেজি শব্দের ছড়াছড়ি। একসময় কেবল ইংরেজি শেখা যথেষ্ট ছিল। এখন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের আরও কিছু ভাষা শেখার প্রতি জোর দেওয়া প্রয়োজন। বিশেষত চাইনিজ, কোরিয়ান, রুশ, স্পানিশ ও ফরাসিতে দক্ষ হতে পারলে বিশ্বকে বোঝা সহজ হবে। এছাড়া কম্পিউটারের ভাষা শিখতে হবে। কোডিং ও প্রোগ্রামিং শেখা অনেক সহজ হয়ে গেছে। ডাটার ব্যবহারগুলো শেখার জন্যও অনলাইন অফলাইন অনেক কোর্স রয়েছে।

মাকতাবায়ে শামেলার ব্যবহার মাদ্রাসাগুলোতে এক যুগের বেশি সময় ধরে আছে। গুগল সার্চ দিয়ে হাদীস ও তাফসীরের কিতাব ঘাটার চলও পুরো মাত্রায় চলমান। আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন দ্রুত সময়ে একটি মাসআলায় বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন আলেমের বক্তব্য ঘেটে বের করা যায়। অন্তর্জালের এসব ব্যবহার বিশেষ উসুল মেনে যেন হয়, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে তরুণ গবেষকরা নৈতিক পদস্খলের স্বীকার হচ্ছে অহরহ। কপি পেস্ট করে অন্যের ইলম নিজের নামে চালিয়ে দেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। অনেক তরুণকে দেখা যাচ্ছে হাজার পৃষ্ঠার কিতাব লিখে ফেলছেন, যার পুরোটাই কপিপেস্ট। এই নৈতিক সংকটও মুকাবেলা করতে শিখতে হবে এই সময়ে।

আজ থেকে দুই যুগ পূর্বেই দারুল উলুম দেওবন্দে কম্পিউটার ও ইংরেজি শিক্ষার জন্য পৃথক শাখা খোলা হয়েছে। যুগের চাহিদা মেটাতে দেওবন্দে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন সব সময় হয়ে এসেছে। সেই তুলনায় আমাদের দেশের কাওমি মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষা কারিকুলামে পরিবর্তন খুব ধীরগতির। অনেক ক্ষেত্রে এসব বিষয়ে কোনো বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া অসম্ভব প্রায়। নীতিনির্ধারকরা অগ্রসর না হলেও এজন্য শিক্ষার্থীদের নিজেদেরই কিছুটা সচেতন হতে হবে। সেই প্রত্যাশা রাখা ছাড়া আপাতত আর কিছু করার নেই। চিন্তাশীল নেতৃবৃন্দ এ বিষয়ে সামগ্রিক পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করতে থাকলে আশা করা যায় নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাবে। দারুল উলুম দেওবন্দের দোহাই দিয়ে জ্ঞান বিজ্ঞানে পিছিয়ে থাকা হবে অন্যায়। দেওবন্দ কখনও জ্ঞান বিজ্ঞানের বিরোধিতা করেনি।

একসময় ইংরেজি ভাষা শেখার ব্যাপারে দেওবন্দি আলেমদের নামে নানান অপপ্রচার চালানো হয়েছে। যার ফলে পিছিয়ে পড়তে হয়েছে সমাজের চালু স্রোত থেকে। একইভাবে বর্তমান সময়ে প্রাযুক্তিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে থেকে পশ্চাতপদতার জন্য দেওবন্দকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হবে অন্যায়। পশ্চাতপদতা কোনো সমাধান নয়। ভবিষ্যতের সমাজ ও সভ্যতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে অবশ্যই দ্বীনি চিন্তা চেতনার সাথে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের প্রতিও আগ্রহী হতে হবে। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সফটয়্যার তৈরি হচ্ছে। নবপ্রযুক্তির নানান প্রোগ্রাম আসছে আন্তর্জালে। কেবল নির্দিষ্ট কয়েক বছর নয়; আমাদেরকে প্রস্তুতি নিতে হবে জীবনব্যাপী শিক্ষার জন্য। দ্রুত পরিবর্তনশীল এই সময়ে শিখতে থাকতে হবে, এবং দ্বীনী দাওয়াতের প্রতিটি ক্ষেত্রকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করতে হবে সুনিপুণ দক্ষতায়।

মনে রাখতে হবে নতুন প্রজন্ম থেকে হাজার মাইল পেছনে থেকে তাদেরকে দ্বীনী চেতনায় আকৃষ্ট করা আমাদের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। সে জন্য প্রতিনিয়ত প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে চলতে পারার প্রাথমিক দক্ষতাগুলো আমাদের শিখে রাখতে হবে একাডেমিকভাবেই। একসময় নির্দিষ্ট অঞ্চলের জন্য ইলম শিখলে তা যথেষ্ট ছিল। এখন আমাদের শিখতে হবে সারা বিশ্বের মানুষের জন্য। আমাদের নবীজী সা.কে সারা বিশ্বের নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। সে হিসেবেও আমাদের সামনে থাকতে হবে সমগ্র বিশ্বের সমগ্র মানবতা। আপনি কারও খবর না রাখলেও আপনার খবর অন্যদের কাছে থাকছে। তথ্যই শক্তি। তথ্যই আগামি দিনে রাজত্ব করবে।

গত দশকে উইকিলিকসের তথ্য ফাঁস কি পরিমাণ প্রভাব বিস্তার করেছিল তা কারও অজানা নয়। আপনি চোখ বন্ধ করে থাকলেই প্রলয় বন্ধ থাকবে না। আপনার ঘরের একান্ত বিষয়াদিও আপনার পক্ষে গোপন রাখা সম্ভব হবে না। এমতাবস্থায় আপনি যদি চিন্তা করেন আপনি কোনো কিছু জানতে বা বুঝতে চেষ্টা করবেন না, তাহলে আপনাকে যে কোনো মন্দ কাজে ব্যবহার করা যাবে খুব সহজেই। কারণ আপনি কি পছন্দ করেন, আপনার রুচি ও মানসিকতা সব কিছুর ডেটা সংরক্ষিত আছে। আপনার চেয়ে আপনার সম্পর্কে অধিক ধারণা রাখবে যন্ত্র।

কাজেই আপনার নিয়ন্ত্রণ আপনার হাতে থাকবে না, সবসময় আপনি কেবল ব্যবহৃত হবেন, ব্যবহৃত যে হচ্ছেন সে বিষয়টিও আপনি একেবারেই বুঝতে পারবেন না। আপনি ইসলাম পছন্দ করেন, তাহলে আপনাকে ইসলামের কথা বলেই ব্যবহার করা হবে চরম অনৈসলামিক কাজে। এভাবে আপনার মাঝে শয়তানি সব চিন্তা ও কাজ সমন্বিত হয়ে যাবে। আর আপনি এসবের কিছুই বুঝতে পারবেন না আপনার পরিবেশ ও বাস্তব পরিস্থি না বোঝার কারণে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সময়ের চ্যালেঞ্জগুলো আরও গুরুত্বের সাথে নিতে হবে আমাদের আলেম সমাজকে। এমনটা আগে কখনওই হয়নি। আজকের সরকার ও আন্তর্জাতিক নীতি নির্ধারকরাও নতুন নতুন ঘটনার সাথে তাল মেলাতে পারছেন না। সংবাদ সংস্থাগুলো চব্বিশ ঘণ্টাই সংবাদ পরিবেশন করছে। আগে দৈনিক পত্রিকাগুলোর কাজ ছিল দিনে একবার সংবাদ প্রস্তুত করে ছাপাখানায় পাঠিয়ে দেওয়া। এখন সেখানে অনলাইন পোর্টালে সব সময় সংবাদ সম্পাদনা চলছেই। ইলেক্টনিক মিডিয়াতেও সার্বক্ষণিক সংবাদ পরিবেশন চলছে। যখনই যে ঘটনা ঘটছে ঠিক তখনই তা প্রচার করতে হবে। তা না হলে বাসি সংবাদ সংবাদপত্র বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মান নষ্ট করবে। যে কোনো সংবাদ শুনেই আপনাকে মন্তব্য করতে হচ্ছে। আপনার কাছে মন্তব্য চাওয়া হচ্ছে। আপনি যাচাই করে বুঝে শুনে মন্তব্য করবেন সে সুযোগ থাকছে না। ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ আপনার কাছে আসার আগেই আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। তা না হলে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারছেন না।

এর বড় এক দৃষ্টান্ত হেফাজতের সম্মানিত আমীর মাওলানা আহমদ শফী রহ.-এর মৃত্যুর আগ মুহূর্তের ঘটনাবলি। সেসময় উলামায়ে কেরামের নেতৃস্থানীয়রা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন। এর মাঝেই একদল বিপথগামী ছাত্রের বিদ্রোহ এমন পর্যায়ে পৌঁছলো যে, আহমদ শফী সাহেবকে যথা সময়ে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেওয়া বাধাগ্রস্ত হলো। খুব সহজেই বুঝতে পারছেন, বর্তমান প্রাযুক্তিক উৎকর্ষের ভালো দিক যেমন আছে, রয়েছে এর বিভিন্ন সংকট। এই সব কিছুর জন্যই আমাদের প্রস্তুত করতে হবে জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় নতুন নীতিমালা। হাত থেকে স্মার্টফোনগুলো ফেলে দিলেই এসব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এমন ভাবলে আপনি ভুল করবেন।

অতীত ঐতিহ্যের সাথে সঙ্গতি রেখেই আপনাকে নির্ধারণ করতে হবে আগামির পথচলা। ইসলামের সৌন্দর্য এখানেই। যুগ যতই পরিবর্তন হোক, কুরআন সুন্নাহয় অবশ্যই এর উপযোগী যথার্থ নির্দেশনা রয়েছে। যুগ অনুসারে সেসব জরুরি বার্তা খুঁজে বের করা উলামায়ে কেরামের কর্তব্য। প্রতিটি বিষয়ের ইসলামী সমাধান মানুষকে দিতে হবে। তা না হলে পরিস্থিতির উপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা যাবে না। ফলে ইসলামের সঠিক চর্চা হয়ে পড়বে সুকঠিন। নানান বিভ্রান্তি আপনাকে জড়িয়ে ধরবে আষ্টেপৃষ্ঠে।

আন্তর্জালের মাধ্যমে সবার কাছে ইসলামের বার্তা পৌঁছে দেওয়া সহজ হয়ে গেছে বর্তমান সময়ে। কেবল অফ লাইনে নয় অন লাইনেও ইসলামের কাজ করতে আপনি একপ্রকার বাধ্য হয়ে পড়েছেন। মানুষ অভ্যস্ত হয়ে গেছে হাদীস কুরআন ও মাসআলা মাসায়েলের ক্ষেত্রে আন্তর্জাল ব্যবহারে। যে কোনো বিষয়ের জন্যই তারা গুগল ও ইউটিউব ব্যবহার করে। সাধারণ মানুষের চাহিদা মেটাতে আপনাকে ওয়েব সাইট খুলতে হচ্ছে, ইউটিউবে লেকচার দিতে হচ্ছে, বিভিন্ন এপস ব্যবহার করতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। দ্বীনের কাজে আপনি প্রযুক্তি ব্যবহার করুন, খুব ভালো কথা। কিন্তু নতুন প্রযুক্তি কেবল ব্যবহার করলেই হবে না, সবসময় ভাবতে হবে এর সামগ্রিক দিক পরিবর্তন করা যায় কিভাবে।

এই সব প্রযুক্তিকে কিভাবে সর্বোতভাবে মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করা যায়। এর ধরণকে ইসলামী করণের প্রয়াস আমাদেরকে অবশ্যই অব্যাহত রাখতে হবে। সেজন্য কেবল এর ব্যবহারকারী নয়, নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় যাওয়ার চেষ্টা আবশ্যক। আমাদের সেই প্রস্তুতি সূচিত হোক। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা তাওফিক দান করুন। আমীন।

  • লেখক: শিক্ষক, খতিব, প্রাবন্ধিক ও গবেষক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *