জাতীয় স্কুল মিল নীতি : শিক্ষায় পুষ্টিযোগ
মো. আব্দুল আলীম : প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার বৃদ্ধি, ঝরে পড়া হ্রাস এবং সারাবছর পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবার দিতে নীতিমালার অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এ কর্মসূচির আওতায় সব শিক্ষার্থীকে সপ্তাহে পাঁচ দিন রান্না করা খাবার এবং একদিন উচ্চ পুষ্টিমানসম্পন্ন বিস্কুট সরবরাহ করা হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে ১৯ আগস্ট, ২০১৯ মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে ‘জাতীয় স্কুল মিল নীতি ২০১৯’ এর খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বখাদ্য সংস্থা যৌথভাবে ২০১১ সাল থেকে স্কুল ফিডিং কার্যক্রম ১০৪ উপজেলায় বাস্তবায়ন করছে। এ কর্মসূচির আওতায় প্রায় ৩২ লাখ প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের মধ্যে দুপুরে বিস্কুট সরবরাহ করা হচ্ছে। বর্তমানে ৭৫ গ্রাম বিস্কুট সরবরাহ করা হচ্ছে এসব স্কুলে। এছাড়া বিশ্বখাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফও) সহযোগিতায় ২০১৩ সাল থেকে পরীক্ষামূলকভাবে তিনটি উপজেলায় (জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলা, বান্দরবানের লামা উপজেলা এবং বরগুনার বামনা উপজেলায়) দুপুরে খাবার হিসেবে রান্না করা খিচুড়ি দেয়ার কর্মসূচি প্রাথমিকভাবে চালু করা হয়। গত জুলাই থেকে আরও ১৬টি উপজেলায় চালু করা হয় দুপুরে খাবার দেওয়ার কর্মসূচি। এখন দেশের দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকার সব সরকারি প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রকল্পটি চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
স্কুল মিল কর্মসূচির কার্যক্রমের ধরণ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে গাইডলাইন সম্পর্কে বলা হয়েছে, প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় শক্তি চাহিদার ক্যালরির ন্যূনতম ৩০ শতাংশ স্কুল মিল থেকে নিশ্চিত করা হবে, যা প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ৩ থেকে ১২ বছরের শিশুদের জন্য প্রযোজ্য হবে। অর্ধদিবস স্কুলের ক্ষেত্রে দৈনিক প্রয়োজন অনুপুষ্টিকণার চাহিদা ন্যূনতম ৫০ শতাংশ, জাতীয় খাদ্য গ্রহণ নির্দেশিকা অনুযায়ী দৈনিক প্রয়োজনীয় শক্তির ১০ থেকে ১৫ শতাংশ প্রোটিন থেকে এবং ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ চর্বি থেকে আসা নিশ্চিত করা হবে। খাদ্য তালিকায় বৈচিত্র্য এনে পুষ্টি নিশ্চিত করা হবে। একই বিস্কুট বাচ্চারা প্রতিদিন খেতে চায় না। তাই খাবারে বিস্কুটের পাশাপাশি কলা ও ডিম রাখার চেষ্টাও চলছে। বৃহস্পতিবার অর্ধদিবসে শুধু বিস্কুট রাখা হবে।
দেশে ৬৬ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক কোটি ৪০ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে। দুপুরে স্কুল ফিডিং কর্মসূচির মাধ্যমে দেখা গেছে, রান্না করে খাবার দিলে ১১ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার বাড়ে। শুধু বিস্কুট দিলে উপস্থিতির হার বাড়ে ৬ শতাংশ। কর্মসূচির আওতাধীন এলাকায় ঝরে পড়ার হার ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে এবং শিশুদের শারীরিক অবস্থার অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। রান্না করা খাবার দেওয়া এলাকায় ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ এবং বিস্কুট দেওয়া এলাকায় রক্তস্বল্পতা কমেছে ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। এ বিবেচনায় জাতীয় স্কুল মিল নীতিমালা অনুমোদিত হয়েছে মন্ত্রিসভায়, যা সরকারের একটি অত্যন্ত সময়োপযোগী উদ্যোগ।
‘জাতীয় স্কুল মিল নীতি ২০১৯’ এর আলোকে ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে কর্মসূচির বাস্তবায়ন শুরু হবে এবং ২০২৩ সালের মধ্যে সারাদেশে সম্প্রসারিত করা হবে। সরকারি এ কার্যক্রমের সাথে স্থানীয় কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করা হবে। নীতিমালার খসড়া হিসেবে দেখা গেছে, শুধু বিস্কুট দিলে প্রতিদিন প্রতি শিক্ষার্থীর ৯ টাকা হারে বছরে দুই হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা, পাঁচ দিন রান্না করা খাবার ও এক দিন বিস্কুট দিলে শিক্ষার্থী প্রতি ১৭ টাকা হারে বছরে পাঁচ হাজার ৫৬০ কোটি ৮০ লাখ টাকা এবং বিস্কুট, ডিম, কলা ও রুটি দিলে ২৫ টাকা হারে খরচ হবে সাত হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা ব্যয় হবে।
জাতীয় স্কুল মিল কর্মসূচিতে চর, হাওর ও দুর্গম এলাকাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে জাতীয় স্কুল মিল কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার উপপরিচালক ও উপজেলা শিক্ষা অফিসার সম্পৃক্ত থাকবেন। এছাড়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে পার্বত্য জেলা পরিষদ ও স্থানীয় প্রশাসন কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত থাকবেন।
জাতীয় স্কুল মিল কর্মসূচি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি সেল বা ইউনিট কাজ করবে। প্রয়োজনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি পৃথক জাতীয় স্কুল মিল কর্মসূচি কর্তৃপক্ষ গঠনের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। নীতিমালা অনুযায়ী, স্কুল মিল উপদেষ্টা কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যেখানে সরকার মনোনীত উপযুক্ত ব্যক্তিরা থাকবেন। এই কমিটি বৃহৎ এ কর্মযজ্ঞের কর্মপরিধি, কার্যকারিতা, অর্থায়ন ও মূল্যায়ণে কাজ করবে।
জাতীয় স্কুল মিল কর্মসূচি সম্পর্কে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, এ উদ্যোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও প্রশংসনীয়। স্কুল মিলকে পুষ্টিমানের বিবেচনায় বিচার করতে হবে। দুপুরের খাবার শিশুকে শিক্ষায় মনযোগী করতে সাহায্য করবে। প্রত্যেক বিনিয়োগে লাভ-ক্ষতি থাকে। কিন্তু এ বিনিয়োগে কোনো ক্ষতি নেই। এ বিনিয়োগ সমাজ, পরিবার, রাষ্ট্র ও বিশ্বের জন্য কল্যাণকর। এই শিশুরাই শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞান-গরিমায় পরিপূর্ণ হয়ে বেরিয়ে আসবে। কর্মসূচি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে স্কুলে শিক্ষার্থীর ঝরে পড়া বন্ধ হবে ও স্কুলে আসার প্রবণতা বাড়বে। স্কুলের পুষ্টিকর খাবার শিশুদের শারীরিকভাবে সুস্থ ও শিক্ষায় মনোযোগী করতে বিরাট ভূমিকা রাখবে।
শিশু শিক্ষার্থীদের পুষ্টি যোগানোর যেকোনো কর্মসূচিই ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক। প্রতিবেশী ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কাসহ প্রভৃতি দেশে এ ধরনের কর্মসূচি আছে এবং তারা এর সুফলও পেয়েছে। পেটে ক্ষুধা নিয়ে ভালোভাবে লেখাপড়া করা যায় না, বলেছেন নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন।
দেশের সব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে দুপুরের খাবার দেওয়া একটি বিরাট কর্মযজ্ঞ। এত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীদের খাবার দেয়া, খাবার পরিবেশন ও এর সুষ্ঠু তত্ত্বাবধান করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এই কর্মসূচির অভিভাবকদের সম্পৃক্ত করতে হবে। পরীক্ষামূলক কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীর মায়েদের সম্পৃক্ত করা হয়েছে, যারা সবচেয়ে ভালো জানেন সন্তানদের জন্য কী ধরনের খাবার দেওয়া প্রয়োজন। শুকনো কিংবা রান্না যে খাবারই হোক না কেন, তা স্বাস্থ্যসম্মত হতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ ও পুষ্টিবিদদের যুক্ত করা গেলে তা আরো ফলপ্রসূ হবে ।
বিল্ডিং যতই বড় হোক, ভিত্তি দুর্বল হলে তা যেমন টিকবে না, তেমনি ভবিষ্যত নির্মাণের বুনিয়াদ আজকের শিশুরা যদি পুষ্টিহীনভাবে বেড়ে ওঠে তাহলে আমরা উন্নত বাংলাদেশ উপহার দিতে পারব না। শরীর ও মেধা বিকাশের সূচনা হয় প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই। এ সময়টাতে শিশুর শারীরিক ও মানসিক গঠন যথাযথ হওয়া জরুরি। ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা যে উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি, তা বাস্তবায়ন করতে জাতীয় স্কুল মিল কর্মসূচি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশের সুযোগ নিশ্চিত করে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সরকারের পাশাপাশি প্রত্যেকের ভূমিকা রয়েছে। সরকারের এই মহতী উদ্যোগে সকলের সম্পৃক্ততা ও সহযোগিতা দেশের জন্য কল্যাণ ও সুফল বয়ে আনবে, এতে কোনো দ্বিমত নেই।