জীবনগল্প: শাইখুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ | ২

জীবনগল্প: শাইখুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ | ২

  • দ্বিতীয় পর্ব
  • ইয়াছিন নিজামী ইয়ামিন

দুপুরের ক্লাস শেষ হলো। সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কেউ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় মনোযোগী হলো, কেউ বিশ্রামের জন্য বিছানা পেতেছে, কেউ বা দুপুরের খাবারের বন্দোবস্ত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ক্লাস শিক্ষকের খাবার ক্লাসের একজনের মাধ্যমে প্রতিদিন বাড়ি থেকে নিয়ে আসা হয়। তবে সেদিন ছেলেটিকে অন্য এক কাজে গেলো। তাই তাকে দিয়ে আজ খাবারটা আনা যাবে বলে মনে হচ্ছে না। কাউকে ডাকা দরকার, যে বাড়ি থেকে খাবারটা নিয়ে আসবে। কিন্তু সবাইকে দিয়ে যে সব কাজ হয় না, এটাও এক বড় সমস্যা। কাকে দিয়ে খাবারটা আনানো যায় সেটাই ভাবছেন শিক্ষক।

আশেপাশে তাকাতেই সেই সৌম্য-শান্ত বালকটিকে চোখে পড়লো। এতদিনে তার ব্যবহার, আচার-আচরণ আদব-লেহাযে এই মাদরাসার সকল ছাত্র-শিক্ষক তো বটেই, এলাকার ময়-মুরব্বীদেরও প্রিয় হয়ে উঠেছে। সকলেই দিন দিন তার প্রতি মুগ্ধতা প্রকাশ করছে। কেননা কোনোদিনেই মুরুব্বীদের কোন কারণে তাকে শাসন কিংবা বকাঝকা করতে হয়নি।

শিক্ষকরা তাকে শাসন করা তো দূরের কথা, ধমকও দেয়নি কোনো দিন। আসলে দিতে হয়নি। ভেতরে ভেতরে নিশ্চয়ই তারা কোনো একটা প্রাপ্তি, প্রশান্তি কিংবা এই বিরল প্রতিভার অদম্য শক্তির অস্তিত্ব টের পেতেন। শিক্ষক ডাকলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, তার বাড়িতে গিয়ে খাবারটা টিফিনক্যারিতে নিয়ে আসতে পারবে কিনা? সুবোধ বালকটি মাথা নেড়ে সায় জানালো। হুম, সে পারবে।

কিছুক্ষণ পর বালকটি চলে গেলো খাবার আনতে এবং খাবার নিয়ে সময়ের আগেই চলে এলো। কিন্তু এরপর দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো। অথচ তখনও খাবার শিক্ষকের কাছে পৌঁছেনি। ছাত্রদের মধ্যে অনেককে পেরেশান দেখা যাচ্ছে। এর কারণ, তাদের শিক্ষক যে আজ খাবার খায়নি। শিক্ষকের কপালে কিঞ্চিৎ চিন্তার ভাঁজ। যাকে পাঠিয়েছেন তার আবার কিছু হয়নি তো? নাকি বাড়ি চিনতে ভুল করেছে! এমন তো হওয়ার কথা না কিংবা এমন ভুল করার মতো ছেলেও সে নয়।

তিনি বাড়িতে খোঁজ পাঠালেন। কয়েকজন ছাত্র ছুটলো শিক্ষকের বাড়ির দিকে। খবর নিয়ে ফিরলো, অনেক আগেই মাসঊদকে খাবার দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এ খবর শিক্ষকের কাছে পৌঁছানোতে তার চিন্তা যেন খানিকটা হ্রাস পেলো। চিন্তামুক্তির ঈষৎ আনন্দের ঝিলিক ছড়িয়ে পড়ল তার মুখাবয়বে। যেহেতু ফিরেছে, তার মানে বিপদের কোনো শঙ্কা নেই। সে এভাবে এর আগেও হারিয়েছে, এই হারানোর জায়গাটা সবার জানা। শিক্ষকের স্মৃতির আলোতে অতীতের ঘটনাগুলো বার-বার ভেসে উঠতে লাগলো, যে সুখস্মৃতি জুড়ে ছড়িয়ে আছে মাসঊদের পাঠের আগ্রহ-উদ্দীপনা ও আকুলতার খন্ড-অখন্ড চিত্রাবলী।

এই বিদ্যাপিঠের প্রিন্সিপাল তৎকালীন যুগের প্রশাসনের গণ্যমান্য ব্যক্তিত্ব, প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদের এম.এন.এ এবং এম.পি। তার এম.পিত্বের সুবাদে দেশের কতো বাঘা-বাঘা আর নামি-দামি মানুষের যাতায়াত এখানে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। অনেকেই স্বাভাবিক ও স্বভাবজাত নিয়মের আগ্রহেই ছুটে যান সেই ব্যক্তিদের দর্শনে। অনেকেই যোগ দেন মিছিল-মিটিংয়ে। কেউ বোঝে-শোনে, কেউ বা হুজুগে। আনন্দ-উল্লাস আর উত্তেজনার আয়োজন সমাপ্তে তাদেরকে অনেক ঘটা করেই চা-নাস্তা পরিবেশন করা হয়।

দেশের রাজনীতিতে বিপুল পরিবর্তন। ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই তাদের গুরুর রাজনৈতিক চিন্তাধারার বাহক হতে সচেষ্ট। সবাই কতোশত রঙিন স্বপ্নের পেছনে ছুটছে। কতো আবেগ-উচ্ছ্বাসের প্রকাশ ঘটছে। দেশে রাজনৈতিক চরম অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা। কোন দিকে যাচ্ছে এদেশের ভবিষ্যৎ। একজন আলেম-বুজুর্গ নেতৃত্ব দিচ্ছেন, এতেই সবাই খুশি। সবাই বিজ্ঞদের মতো কথাবার্তায় বলছে, রাজনৈতিক বিশ্লেষণ চলছে। অথচ, এগুলোর প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই বালকটির। সারাদিন লাইব্রেরীতে গিয়ে বই পড়ে।

প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ-তনয় এই প্রতিষ্ঠানেরই শিক্ষার্থী। তবে সে মাসঊদের নিচের ক্লাসে পড়ে। তাদের উভয়েরই খানিকটা পরিচয় আছে। বাবা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত থাকায় ছেলের লেখাপড়ার তেমন একটা খোঁজ-খবর নিতে পারছেন না। তবে অধিকাংশ সময়ই খোঁজ করে তাকে মাদরাসায় পাওয়া যায় না। বাবাও বুঝতে পারছেন, ছেলে কিছুটা দুষ্টুমিতে জড়িয়ে যাচ্ছে। শাসন করেছেন বারকয়েক। এবার বোধহয় কিছুটা ভালো হয়েছে, ধারণাটা তাঁর বাবার। কেননা, প্রতিবারের মতোই একবার তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, সারাদিন কোথায় ছিলে?

ছেলে সহজভঙ্গিতে উত্তর দিলো, মাসঊদের সাথে ছিলাম। বাবা কিছু বলেননি। নতুন কিছু জিজ্ঞাসাও করেননি। তিনি জানেন, মাসঊদ কোথায় থাকে, কি করে? তিনি তার ভরসার জায়গা থেকে স্বস্তিবোধ করলেন। পরবর্তীতে এই একটি বাক্যই হয়ে উঠেছিলো তার বাবার শাসন থেকে আত্মরক্ষার হাতিয়ার! তবে পরবর্তীতে সময় গড়ানোর সাথে সাথে সেই বন্ধুত্বের সম্পর্কটা গভীর হয়েছে ক্রমান্বয়ে।

শিক্ষক খানিকটা গাম্ভীর্য ভাব নিয়ে ছাত্রদের বললেন এভাবে সারাদেশ খুঁজলেও মাসঊদকে পাওয়া যাবে না, যদি না লাইব্রেরীতে না খোঁজো। লাইব্রেরিতে যাও, ওখানেই পাবে মাসঊদকে। কয়েকজন ছুটলো। লাইব্রেরীর দ্বার ঠেলে ভেতরে প্রবেশ মাত্রই দেখা গেলো পাঠ-অধ্যায়নের গভীর সাগরতলে ডুবে আছে সে। হাতের কাছেই পড়ে আছে টিফিনক্যারী বাটিটা।

পাঠ-অধ্যায়নের এমন বিরল নজির তিনি দেখিয়েছেন যা গ্রন্থপল্লবে রচিত কাল্পনিক রূপগল্পকে জীবন্ত করে তুলেছেন। অধ্যায়নে কতটুকু মনোযোগী ও অধ্যাবসায় থাকতে হয়, তার দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন। তাই দেখা যায়, তাঁর সমসাময়িককাল সহ প্রচলিত এমন হেন ক্ষেত্র নেই, যে সম্পর্কে জানাশোনা তাঁর জ্ঞানের ঝুলতে নেই, কিংবা তাঁর জানার আড়ালে রয়ে গেছে। তাই ছোটদের প্রতি তার আদেশ ছিলো, যা পড়বে কিংবা জানবে, তার তল-গভীরতাসহ জানবে। এবিষয়ে কেউ যেন তোমাকে বিভ্রান্ত ও বিচলিত না করতে পারে।

দৈনিক পত্রিকাগুলোর প্রতি তার পাঠের মুগ্ধতা ছিল দেখার মতো। প্রত্যেকটা সংবাদ, কলাম-ফিচারগুলো এমনভাবে পড়তো যে এর খুঁটিনাটি বিষয়গুলো তার মাথায় গেঁথে যেতো। অথচ তার বিন্দুমাত্র প্রভাব বাহিরে পরিলক্ষিত হতো না। বাইরে থেকে ঠিক এ যেন শান্ত নদী, অথচ ভেতরে খরস্রোতা ঢেউ। ফলওয়ালা বৃক্ষ যে সর্বদাই নত থাকে!

যেখানে পাঠ-অধ্যায়নের সুযোগ পেয়েছেন, সেখানকার সকলকেই মুগ্ধ করেছে তার পাঠ-অধ্যায়ন। বাদ যায়নি ইসলামী বিশ্বের সর্ববৃহৎ ও মাকবুলিয়্যাতপ্রাপ্ত বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দের লাইব্রেরীও। পরবর্তী সময়ে দেওবন্দের বাংলাদেশি ছাত্রদের মুখে শোনা যায়, এত বছর পরেও দেওবন্দ লাইবেরিয়ানের সামনে কোন বাংলাদেশী ছাত্র পড়তেই কিংবা পরিচয় জানলেই তাকে সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করতেন, ‘মাওলানা ফরীদকে চেনো?’ ওই লাইব্রেরিয়ানের সাথে কোন বাংলাদেশী ছাত্রের পরিচয় হয়েছে অথচ তাকে মাওলানা ফরীদের কথা জিজ্ঞাসা করেনি, এমনটাও নাকি খুব বিরল। সেই লাইব্রেরিয়ানের সাক্ষাৎপ্রাপ্ত দেওবন্দ ফেরা কোনো বাংলাদেশি ছাত্রই বোধহয় এটা অস্বীকার করতে পারবে না!

পাঠ্যবইয়ের বাইরের পাঠে আল্লামা মাসঊদ যেমন ছিলেন পারঙ্গম, ঠিক ক্লাসে বা দরসেও তার কৃতিত্ব ছিলো অসাধারণ। ছাত্র জীবনের শুরু থেকেই মেধাতালিকায় প্রথম স্থানকেই যে আপন করে নিয়েছেন, জীবনের শেষ ক্লাস পর্যন্ত সেই অর্জনকে নিজের করে রেখেছেন। সেটা দেশের ভেতরে যেমন, বাইরেও।

সেইরূপকথার গল্পকে জয় করা বিস্ময় বালকটিকে আজ আমরা তাঁর সাফল্যমণ্ডিত জীবন সায়াহ্নে মুগ্ধতা আর আকুল হয়ে দেখি। এই দেখার চলতে থাকুক অবিরত, অনন্তকাল।

  • yasinnizamiyamin123@gmail.com
  • মতামত বিভাগে প্রকাশিত লেখার দায় লেখকের

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *