- তৃতীয় পর্ব
- ইয়াছিন নিজামী ইয়ামিন
বিখ্যাত বিদ্যাপীঠ দারুল উলূম দেওবন্দের শতবার্ষিকী সমাবর্তন সমাবেশ। মঞ্চে উপবিষ্ট বিশ্ব বরেণ্য আলেম মাশায়েখ ও বিশিষ্ট পণ্ডিতগণ। সমকালীন ইসলামের আকাশে প্রত্যেকেই নিজ নিজ জায়গা থেকে একেকটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। জ্ঞানগরিমায় অনন্য, প্রজ্জ্বলিত আলোর দীপক। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, বিশিষ্ট আরবী-উর্দু সাহিত্যিক ইসলামি চিন্তক সর্বজনবিদিত বুযূর্গ আলেম সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.)৷ একজন অনারব ব্যক্তি আরবিদের ঝিমিয়ে পড়া চিন্তা-চেতনায় সত্ব পরিচয়ের অনল জ্বালিয়ে ছিলেন। নিজেদের ইতিহাস, সভ্যতা সংস্কৃতি, শক্তি সামর্থ্য বিস্মৃত হওয়া জাতিতে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে পরিচয় স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন।
আরও আছেন বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ ও বাগ্মী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, খ্যাতিমান বুযূর্গ আল্লামা মনযুর নোমানী (রহ.)। তিনি দারুল উলূম দেওবন্দের মজলিসে শূরা ও মজলিসে আমিলাহ (কার্যনির্বাহী)ও ছিলেন। এবং দারুল উলূম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ কাসেম নানুতাবি রহিমাহুল্লাহর দৌহিত্র এবং দেওবন্দের দীর্ঘদিনের মুহতামিম, আল্লামা কারী তৈয়ব সাহেব (রহ.) সহ আরো অনেকেই।
বক্তৃতার ডায়াসে অনেক বক্তা উঠছেন, বক্তৃতা করে নেমে যাচ্ছেন, এভাবেই চলছে। একজন বক্তার নাম ঘোষণা হলো। অপরিচিত নাম, তবে নামে বৈচিত্র্য আছে। সেই ঘোষণায় স্বল্প বয়সী এক যুবক উঠে এলো ডায়াসে। অনেকের চোখ বড় হয়ে গেলো, বিস্ময় নিয়ে দেখছেন। বক্তৃতা শুরু হলো। শ্রোতারা মুগ্ধতা নিয়ে আরো মনযোগী হলেন। দৃষ্টিও আটঁকে গেছে ডায়াসে দাঁড়ানো তরুণের প্রতি। তার কথায় যেন সোনা ঝরছে। জন-সাধারণ তো বটেই, পেছনে বসা বিজ্ঞ ও খ্যাতিমান আলেম—গবেষকরাও বিস্মিত হয়ে শুনছেন।
উর্দু ভাষায় কী প্রাণোচ্ছল প্রাণবন্ত আলোচনা! বক্তৃতার ভাষা, উপস্থাপনের দৃঢ়তা, শৈল্পিক বাচনভঙ্গি, অর্থবহ শব্দ চয়ন, ডায়াসে দাঁড়ানোর নির্ভারতা, সুস্পষ্ট উচ্চারণ, অসাধারণ অর্থান্তরন্যাস আর হাত দুটোর সুচারু উঠানামা! এই বক্তৃতার সুর-আন্দাজ ও ধরণ নিশ্চয়ই ভিন্নধর্মী, ব্যতিক্রম। কিন্তু এ ব্যতিক্রমটা আসলে কী, বুঝে উঠতে পারছেন না কেউ! রাসূলে কারীম সা. বলে গেছেন, ‘নিশ্চয়ই কিছু বক্তব্য জাদুময়’। এটাও কি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভাষ্যে বর্ণিত বক্তৃতাসমূহের একটি! পারে হয়তো। না হয় এতগুলো মানুষ যে তন্ময় আর মুগ্ধতা নিয়ে শুনছে, তা তো আর এমনি এমনি ঘটছে না। তাছাড়া সামনে উপস্থিত সবাই যে জনসাধারণ, ব্যাপারটা তেমনও নয়। আলেম, পন্ডিত, গবেষক এমনকি এমন অনেক মানুষজনও আছেন, যাদের কথা অন্যরা ভীষণ বিস্ময় নিয়ে তাড়িত হন, মুগ্ধ হন।
আয়োজন অনেক বড়। শুধু বাহ্যিক বিস্তৃতে নয়, এর তাৎপর্যতাও অনেক বিশাল। সেখানে অনেক নামিদামি-গুণী মানুষের মঞ্চে কথা বলার সুযোগ হচ্ছে না, সেখানে নাম-না-জানা অচেনা কেউ বক্তৃতা করার জন্য এত লম্বা সময় নেয় কীভাবে! সংক্ষিপ্ত সময়। সেই বালকটি তাই করলো। অল্পসময়ে স্বল্পদৈর্ঘ্যের বক্তৃতা শেষ করলো। কিন্তু শেষ হল তখন, যখন দর্শক-শ্রোতাদের মুগ্ধতার পারদ একেবারে তুঙ্গে! বক্তৃতা শেষ হয়েছে। মানুষের সেই বিস্ময় আর মুগ্ধতার রেশ শেষ হয়নি তখনো। সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহিমাহুল্লাহ বিস্ময়কে ঠেলে এক আয়োজককে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এই ছেলেটি কে? এতো সুন্দর বক্তৃতা করলো!’
আয়োজকদের পক্ষ থেকে জানানো হলো, এ হলো দারুল উলূম দেওবন্দের এক বাংলাদেশী ছাত্র! নাম ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ। আলী মিয়া সাহেব আরো বিস্মিত হলেন। কোনো বাংলাদেশি উর্দু ভাষায় এতো সুন্দর সাবলীল বক্তৃতা করে! উর্দু যাদের মাতৃভাষা, তাদের অনেকেই তো এতো সুন্দর ঘুচিয়ে কথা বলতে পারে না। আলী মিয়া নদভী (রহ.) সেই মঞ্চেই বাঙালী ছাত্রটিকে উষ্ণ সম্বর্ধনা ও অভিনন্দন জানালেন। বিশ্বনন্দিত একজন তুখোড় আলেমের ধারণাই পালটে গেলো এই দেশ আর দেশটির ছাত্রদের সম্পর্কে। সেই সুবাদে এখন মনে হচ্ছে বাঙালি ছাত্র হওয়াটা নিশ্চয়ই গৌরবের!
- অভিজ্ঞতা
জুমার নামাজের দোয়া শেষ। জুতা হাতে নিয়ে বের হচ্ছি মসজিদ থেকে। তখন এক বৃদ্ধকে ক্রোধান্বিত কন্ঠে বলতে শুনলাম, ‘হুজুর! আপনারা এমন করেন কেনো? আমরা কত দূর থেকে হুজুরের বয়ান শুনতে আসি, আর আপনারা দরজা বন্ধ করে রাখেন!’
আমার সাথে গুটিকয়েক মানুষের মেলামেশা, পরিচিতি। যাদের সাথে পরিচিতি, তাদের সবাইকে ভালো করেই চিনি। অচেনা কন্ঠ, তাই আমি ভাবতেও পারিনি কথাগুলো অচেনা কেউ আমাকে লক্ষ্য করে বলবেন। ঘাড় ফিরিয়ে দেখি, হুম! আমাকেই বলছেন। ভীষণ অবাক হলাম। বৃদ্ধকে বোধহয় এবার-ই প্রথম দেখলাম। তার সাথে সাত-আট বছরের একটি শিশু, নাতিই হবে সম্ভবত। কিন্তু তিনি আমাকে এগুলো বলছেন কেনো, সেটাই বুঝতে পারলাম না।
একটুখানি থেমে জিজ্ঞাসা করলাম, দুঃখিত চাচা! কিছু মনে করবেন না। মনে হলো আপনি আমাকে কিছু বলেছেন?
বৃদ্ধ কিছুটা স্বাভাবিকতা নিয়ে বলল, হ্যাঁ, মনে হলো আপনি এখানকার দায়িত্বশীলদের কেউ, তাই বললাম।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি যে বললেন, আমি দরজা বন্ধ করে রেখেছি। অথচ, আমি তো দরজার আশেপাশেই ছিলাম না।
তখন তিনি বললেন, বাবা ব্যাপারটা আসলে এমন না, আমরা কত দূর থেকে শুধু হুজুরের বয়ান শুনতে আসি। অথচ এসে দেখি দরজা বন্ধ। তখন কার ভালো লাগে শুনি!?
:কোত্থেকে এসেছেন? জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
:সেই মুন্সিগঞ্জ থেকে, বৃদ্ধের সরল জবাব।
আমি ভীষণ অবাক হলাম। মাত্র বিশ মিনিটের জুমার বয়ান শুনতে এতদূর থেকে মানুষজন আসে! সাথে খানিকটা আফসোসও হলো! এত কাছে থেকেও আমরা এতটা ব্যাকুলতা নিয়ে বয়ান শোনার আগ্রহ প্রকাশ করতে পারি না। আমি তাকে শান্তভাবে বুঝানোর চেষ্টা করলাম যে, অনেকেই তো হুজুরের বয়ান শুনতে কাছে কিংবা দূর-দূরান্ত থেকে আগেই চলে আসেন, যেহেতু এসি ছাড়া থাকে, তাই ভিতরে পরিপূর্ণ হয়ে গেলে দরজার সামনেও মানুষজন বসে পড়ে। তাই হয়তো পরে এসে দরজা খোলা পাওয়া যায় অথবা খোলাও যায় না।
বৃদ্ধ আমার কথা মানতে নারাজ। তার কথা, বুঝলাম মানুষজন আগে চলে আসে, তাই বলে দরজা বন্ধ করে দিতে হবে? একজনেরও জায়গা হবে না?
: আপনার মত অনেকেই এভাবে এসে দরজা বারবার খুলে ভেতরে ঢুকে। যখন জায়গা থাকে না তখন হয়তো ভেতর থেকে আর দরজা খোলা না।
: সবাই তো আমার মত এত দূর থেকে আসে না। আমাদের তো ঢুকতে দেওয়া উচিত!
বোঝা গেছে, ওনাকে বুঝিয়ে আর পারা যাবে না এখন! তাই বললাম, ‘কষ্ট করে যদি আরেকটু আগে চলে আসেন, তাহলে ইনশাল্লাহ জায়গা পেয়ে যাবেন।’
বৃদ্ধ কি বুঝলো, কে জানে! কি জানি একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। কথাটা তিনি পাড়লেন না। তার নাতিটা বলছে, ‘দাদা! সামনের সপ্তাহে আমরা আরও আগে চলে আসবো…’ বলতে বলতে তারা মিশে গেল মানুষের ভিড়ে। এভাবে আরো কতো মানুষ আমাদের বড়হুজুরের কথা শুনতে দূর-দূরান্ত থেকে এই ঝিল-মসজিদে আসে, তার খবরই বা কে রাখে!
- জীবনগল্প: শাইখুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ | ১
- জীবনগল্প: শাইখুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ | ২
yasinnizamiyamin123@gmail.com
মতামত বিভাগে প্রকাশিত লেখার দায় লেখকের