৯ই জুন, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ , ২৬শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ , ১৯শে জিলকদ, ১৪৪৪ হিজরি
সালটা মনে নেই। তবে নব্বই দশকের শুরুর কথা। আমি তখন জামেয়া শাইরইয়্যাহ মালিবাগ পড়ি। মাঝে মাঝে একজন বালককে মাদ্রাসার সরু পথ দিয়ে ছোট্ট একটা ব্যাগ হাতে বাজারে যেতে দেখতাম। ছেলেটির চোখে-মুখে প্রতিভার ছাপ। মনে হত এ কোনো সাধারণ বালক নয়। নিশ্চয়ই সে বিস্ময়কর কোনো বালক। কারো সাথে তেমন কথা বলত না। শুধু সালাম বিনিময় হতো। মনে অনেক কৌতুহল সৃষ্টি হলো কে এই বালক? কী তার পরিচয়?
একদিন জানতে পারলাম বালকটি শাইখুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ সাহেবের জ্যেষ্ঠ সাহেবজাদা। নাম সদরুদ্দীন মাকনুন। সেই থেকে আমরা মাকনুনকে আদর-স্নেহের চোখে দেখতাম।
জামিয়া শারইয়্যাহ থেকে ফারেগ হয়ে দারুল উলুম দেওবন্দ চলে গেলাম। দেওবন্দ থেকে ফিরে কর্মজীবন শুরু হলো। এর মধ্যে অবশ্য মাকনুন সাহেবের সাথে তেমন দেখা সাক্ষাত হয়নি। ২০১৪ সনের দিকে একবার জমিয়াতুল উলামার মিটিং- এ দূর থেকে দেখেছিলাম তাঁকে।
২০১৯ সনে হজের সফরে গেলাম। একদিন দুপুরে গেলাম মক্কাসহ বাংলাদেশ হজ মিশনে। সেখানে দেখা হলো প্রিয় উস্তাদ মাওলানা ওয়াহিদুজ্জামান সাহেবের সাথে। তিনি আমাকে দেখে বললেন, ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ সাহেব এখানে আছেন, চলো-তাঁর সাথে দেখা করে আসি।
বাংলাদেশ হজ মিশনের লিফট ধরে উপরে চলে গেলাম। হযরতের কামরার সামনে গিয়ে নক করা হলো। বেরিয়ে এল সেই বালক। অবশ্য তখন তো আর বালক নয়। সম্ভবনাময় যুবক। স্বেতশুভ্র বসন। চোখে মুখে নুরানী আভা লেগে আছে। স্মিত হাসি দিয়ে সালাম বিনিময় করলেন। আমরা তাকে বললাম, হুজুরের সাথে দেখা করতে চাই। তিনি বললেন, হুজুর তো দুপুরের খানা খেয়ে বিশ্রামে আছেন। একটু অপেক্ষা করুন।
আমরা পাশের রুমে অপেক্ষা করতে লাগলাম। একটু পরেই মাকনুন সাহেব বললেন, ভিতরে আসুন! তিনি ভিতরে নিয়ে হুজুরের সাথে দেখা করালেন। সেদিন মাকনুন সাহেবের বিচক্ষণতা নজরে পড়ল। আমরা অনেক কষ্ট স্বীকার করেই হুজুরের কামরা পর্যন্ত পৌঁছে ছিলাম। দেখা করতে না পারলে মনটা খারাপ হতো। কিন্তু মাকনুন সাহেবের দুরদর্শিতায় সব কিছু ঠিক হয়ে গেল। অথচ বহু সাহেবজাদা এরকম অবস্থায় বড্ড ভুল করে ফেলেন। আগত মানুষের অবস্থার দিকে নজর করে না কখনো। কিন্তু মাকনুন সাহেব একজন দুরদর্শি আলেম, সেদিন অনেকখানি আন্দাজ করে নিলাম।
কয়েকবছর আগে খুলনা জামেয়া মাদানীয়া (নিজখামার) মাওলানা এমদাদুল্লাহ কাসেমী সাহেবের মাদ্রাসায় আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ সাহেবের ইসলাহী ইজতেমা হয়েছিল।সেখানে গিয়ে হাজির হলাম। সেদিন অনেক কাছ থেকে দেখলাম মাওলানা সদরুদ্দীন মাকনুন সাহেবকে। বড় মজার বিষয় হলো, সেখানে বিভিন্ন মাদ্রাসার বড় বড় উলামায়ে কেরাম উপস্থিত ছিলেন। কেউ মুহদ্দিস, কেউ শাইখুল হাদীস, কেউ মুহতামিম, কেউ পরিচালক, তবে এঁরা সকলেই মাকনুন সাহেবকে ‘মিয়া ভাই’ বলে সম্বোধন করছেন। অনেক বড় শায়েখ, কিন্তু তাঁরাও মিয়া ভাই বলে সম্বোধন করছে। খুব ভালো লাগল আমার কাছে। কেননা শায়েখের ছেলে সন্মানের স্থানে। সে হিসাবে উলামায়ে কেরামের এমন আখলাক দেখে আভিভূত হলাম।
অবশ্য এই কাজে বড়দের দলিল পাওয়া যায়। যেমন আল্লামা তাজাম্মুল আলী সিলেটী (রহ.), আল্লামা কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ (রহ.) এসকল ব্যক্তিগণ দেওবন্দে লেখাপড়া করেন, তখন ফেদায়ে মিল্লাত সাইয়্যেদ আসআদ মাদানী ( রহ,) অনেক ছোট ছিলেন। বিশেষ করে তাজাম্মুল আলী সাহেব ফেদায়ে মিল্লাতকে অনেক ছোট দেখেছেন। কাজী সাহেব দেখেছেন নওজোয়ান আসআদ মাদানী। আর আরশাদ মাদানী দামাত বারাকাতুহুম এবং আসজাদ মাদানী দামাত বারাকাতুহুমকে অনেক ছোট দেখেছেন তাঁরা। কিন্তু শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমাদ মাদানী (রহ.) এর ইন্তেকালের পরে যখন ফেদায়ে মিল্লাত জানেশীন হলেন, তখন তাঁকে শায়েখ তাজাম্মুল আলী সাহেব এবং আল্লামা কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ সহ হাজারো আলেম এবং খোলাফাবৃন্দ ছারে তাজ মনে করতেন। বাংলাদেশে আসলে তাঁকে মাথায় উঁচু করে রাখার চেষ্টা করতেন। কেননা, তিনি তো উস্তাদের ছেলে, শায়েখের ছেলে, সে হিসাবে ইজ্জতের অন্ত ছিল না।
আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ আকাবির-আছলাফের অনুসারী। তাঁর ভক্ত-অনুরক্তগণ সেই আকাবিরের অনুসারী। এজন্য বড় আখলাক গ্রহণ করেছে তাঁর শাগরেদগণ। এখন সদরুদ্দীন মাকনুন সাহেব আমাদের ‘মিয়া ভাই’। আমরা তাঁকে শায়েখের সন্তান হিসাবে আল্লাহরওয়াস্তে ভালোবাসি। ‘মিয়া ভাই’ বলে সম্বোধন করি। মাওলানা সদরুদ্দীন মাকনুন একজন প্রতিভাধর আলেম। সম্ভবনাময় যুবক। যার কাজে-কর্মে বোঝা যায় তিনি পিতার বাতলানো রাস্তায় ছুটে চলেছেন। তিনি পুর্বসূরীদের মত চতুর্মুখি খেদমতে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন। শুধু মাদ্রাসার চার দেয়ালের মধ্যে নয়, বরং সর্বত্র দৌড়াচ্ছেন তিনি। বিশেষ করে পিতার সংস্পর্শে নিজেকে পাকাপোক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। বাংলাদেশের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সফর করে থাকেন।
বড় অবদান রেখেছেন অসহায় রোহিঙ্গাদের খেদমত করে। সেই দুঃসময়ে রোহিঙ্গাদের জন্য বুক চিতিয়ে দিয়েছিলেন। মজলুম মানুষদের জন্য খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, বিভিন্ন কায়দায় তাদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বাংলাদেশ জমিয়াতুল উলামা এবং জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের আগত মেহমানদের সাথে তিনি সার্বক্ষনিক ময়দানে ছিলেন। বর্তমানে বাংলাদেশ জমিয়াতুল উলামার পক্ষ থেকে দেশের অসহায়-দরিদ্র মানুষদের পাশে সব সময় তাঁকে দাঁড়াতে দেখা যায়।
তাছাড়া তাঁর যোগ্যতা এবং দক্ষতার কোন জুড়ি নেই। শাইখুল ইসলাম ফরীদ উদ্দীন মাসউদ এর বিভিন্ন কার্যক্রমে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। জামিয়া ইকরাার বিভিন্ন কার্যক্রম, সাংগঠনিক কার্যক্রম, ইসলাহী প্রোগ্রাম এর সব কিছুর প্রধান মুখপাত্র সদরুদ্দীন মাকনুন সাহেব। তাড়াইলের বেলংকাতে বিশাল ইসলাহী ইজতেমা হয়, সেখানেও তাঁর বড় ভূমিকা। মোটকথা যোগ্য পিতার যোগ্য সন্তান। একজন মেধাবী আলেমেদ্বীন, তারুণ্যের আইডল বলা হয় সদরুদ্দীন মাকনুন সাহেবকে।
বর্তমানে আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ সাহেব এই বড় সাহেবজাদা মাওলানা সদরুদ্দীন মাকনুনকে তাঁর জানেশীন ঘোষণা করেছেন। তাঁর অবর্তমানে সংগঠন, জামিয়া এবং ইসলাহী কার্যক্রম মাকনুন সাহেব পরিচালনা করবেন। একটা সঠিক সিদ্ধান্ত। সম্ভবনায়ী এই যুব আলেম তিনি বিদ্যুৎবেগে ছুটে যাবেন। দ্বীন ইসলামের তরক্কী হবে। আমাদের মিয়া ভাইজান জাতির খেদমতে নিজেকে বিলীন করে দিবেন। এই আশা রাখি।
আল্লাহ তায়ালা সব কিছু সহজ করুন। মাওলানা সদরুদ্দীন মাকনুন সাহেবের উজ্জল ভবিষ্যত কামনা করি। তাঁর খেদমতের পরিধি বেড়ে যাক। আল্লাহতায়ালা তাঁর নেক হায়াত দান করুন। আমিন।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিষ্ট
আরও পড়ুন: আল্লামা মাসঊদের লিগ্যাসি ও কিছু কথা