তিরমিযি শরীফের আরবী ভাষ্যগ্রন্থ আলআরফুযযাকী একটি অনন্য কাজ

তিরমিযি শরীফের আরবী ভাষ্যগ্রন্থ আলআরফুযযাকী একটি অনন্য কাজ

তিরমিযি শরীফের আরবী ভাষ্যগ্রন্থ আলআরফুযযাকী একটি অনন্য কাজ

তিরমিযি শরীফ : আবদুল্লাহ মারুফীর আরবী ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ

যায়েদ আল মুস্তাকিম : তিরমিযী শরীফ। সুনানে আরবাআর একটি হলেও “জামে তিরমিযী” নামে পরিচিতি। বহুমুখী ও নানাবিধ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কারণে কিতাবটি সর্বমহলে সমাদৃত। শত শত বছর ধরে দরসিয়্যাতের অঙ্গনে কিতাবটির মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতা বরাবরের মতোই অনন্য। অপূর্ব এই মাকবুলিয়্যাত , নিরুপম বৈশিষ্ট্য আর স্বতন্ত্র স্বকীয়তার ফলে যুগে যুগে প্রাজ্ঞ ও বিদগ্ধ আলেমদের বড়ো একটি দল কিতাবটির ব্যখ্যা- বিশ্লেষণে কলম ধরেছেন। সংক্ষিপ্ত ও বিস্তর পরিসরে আরবি, উর্দু, ফারসি, বাংলাসহ বহু ভাষায় তারা এর অনুবাদ ও ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচনা করেছেন।

তিরমিযি শরীফের মূল্যবান ব্যখ্যাগ্রন্থগুলোর মাঝে যুগান্তকারী সংযোজন হিসেবে অপূর্ব, নতুন আরো একটি নাম — “العرف الذكي”। যা মূলত যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী রহ. এর দরসী ইফাদাতের অনবদ্য সংকলন। তদুপরি কিতাবটি বহুবিধ অনুপম স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। নানাবিধ সৌন্দর্য আর নতুনত্বে ভরপুর। রচনা করেছেন- দারুল উলুম দেওবন্দের তাখাসসুস ফিল হাদীস বিভাগের সুনামধন্য উস্তাদ ও মুশরীফ হয়রত মুফতি আব্দুল্লাহ আল মারুফী দা, বা,।

কিতাবটি এযাবত পাঁচ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। আবওয়াবুত তাহারাত থেকে আবওয়াবুস সওম পর্যন্ত।১ম খণ্ডে আছে তাহারাতের পূর্ণ বর্ণনা। প্রকাশকাল — ১৪২৮ হিজরী। ২য় খণ্ড থেকে আবওয়াবুস সালাতের শুরু। অধ্যায়টি অনেক দীর্ঘায়িত। তাই কেবল শুরু থেকে ১৯১ নাম্বার অধ্যায় পর্যন্ত স্থান পেয়েছে দ্বিতীয় খণ্ডে। প্রকাশকাল — ১৪৩৩ হিজরী।

৩য় খণ্ডে স্থানন পেয়েছে- ১৯২ অধ্যায় থেকে ২৮৯ নাম্বার অধ্যায় পর্যন্ত। ৪থ খণ্ডে স্থান পেয়েছে — ২৯০ নাম্বার অধ্যায় থেকে ৩৯২ নাম্বার অধ্যায় পর্যন্ত। ৫ম খণ্ডে স্থান পেয়েছে –সালাতের অবশিষ্ট অংশ, আবওয়াবুয যাকাতের পূর্ণ বর্ণনা এবং আবওয়াবুস সওমের শুরু থেকে ৩৬টি অধ্যায়। আর এই তিনটি খণ্ড একত্রে প্রকাশিত হয়েছে ১৪৪০ হিজরীর পবিত্র রমযান মাসে।

প্রথম খণ্ডের শুরুতে সন্নেবেশিত হয়েছে তৎকালীন দারুল উলূম ওয়াকফ দেওবন্দের শাইখুল হাদিস ও সদরুল মুদাররেসীন হযরত মাওলানা মুহাম্মদ আনজার শাহ কাশ্মীরী রহ. এর জ্ঞানগর্ভ ভূমিকা , যাতে তিনি হযরতুল আল্লাম মাওলানা মুহাম্মদ আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ. এর জীবন চরিতের আলোকউজ্জ্বল নানাবিধ বিষয় এবং “العرف الذكي” এর পরিচিতি , গ্রন্থ সংকলনের প্রেক্ষাপট , কর্মনীতি নিয়ে সম্যক ধারণা দেবার চেষ্টা করেছেন। সেই সাথে রয়েছে দারুল উলুম দেওবন্দের প্রবীণ ও প্রখ্যাত মুহাদ্দিস বাহরুল উলুম হয়রত মাওলানা নেয়ামাতুললাহ আজমী দা. বা. এর মূল্যবান অভিমত, যাতে তিনি তুলে ধরেছেন আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ. এর দরসে হাদীসের অনুপম বৈশিষ্ট্য আর অপূর্ব সৌন্দর্য ও নতুনত্বের নানাবিধ বিষয়। এরপর রয়েছে লেখক মহাদয়ের শুরুর কিছু কথা। যাতে উঠে এসেছে তিরমিযী শরীফ সম্পর্কিত উলামায়ে কেরামের কিছু অমর বাণী, কিতাবটিকে কেন্দ্র করে লিখিত প্রসিদ্ধ কিছু ব্যাখ্যাগ্রন্থের সম্যক পরিচিতি এবং আপন কিতাবের মানহাজ ও কর্মপদ্ধতির ব্যাপারে সবিস্তর আলোচনা। পরিশেষে রয়েছে আল্লামা কাশ্মীরী রহ.-এর জীবন চরিতের উপর রচিত শাইখ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্বাহ রহ.-এর কলমে আঁকা অনবদ্য সৃষ্টির সামান্য ঝলক।

কিতাবটির মৌলিক বিন্যাস করতে গিয়ে প্রথমে নিয়ে আসা হয়েছে তিরমিযী শরীফের মতন, এরপর মাঝের অংশে রয়েছে মতনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং প্রয়োজনীয় সব তাশরীহ ও তাওজীহ। আর নিচের ভাগে সংযোজন করা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একান্ত প্রয়োজনীয় টিকা, টিপ্পনী। নিম্নে সংক্ষিপ্তাকারে প্রতিটি বিষয়ের পরিচিতি ও বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

তিরমিযী শরীফের মতন :

কিতাবের এবারত থেকে আলোচ্য বিষয়ের সঠিক মর্ম অনুধাবন অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এর জন্য চাই বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য মতন। তবে তিরমিজি শরীফের প্রচলিত নুসখা সমূহের সনদ ও মতন উভয়টিতে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ভুল-ত্রুটি এবং নানা রকমের বিচ্যুতি ও অসঙ্গতি। চাই তা পাণ্ডুলিপি প্রস্তুতকারী , মুহাক্কিক , প্রকাশক কিংবা মুদ্রণকারী সহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের যে কারো অসতর্কতার কারণে হোক। তাই মুসান্নিফ দা. বা . শিক্ষার্থীদেরকে তিরমিজি শরীফের পরিশোধিত , পরিমার্জিত , সম্পাদিত , সহীহ ও বিশুদ্ধ মতন উপহার দেয়ার লক্ষ্যে নিম্নে বর্ণিত কর্মপন্থা অবলম্বন করেছেন।

এক . সংশোধন ও পরিমার্জনের জন্য নির্বাচন করেছেন ১. শাইখ আহমদ মুহাম্মদ শাকের রহ. এর কালজয়ী সংকলন দারু ইহয়াউত্বুরাসিল আরাবী প্রকাশিত ” আল জামেউস সাহীহ”। যা মূলত পাণ্ডুলিপি ও মূদ্রিত বিশুদ্ধ সাতটি নুসখা থেকে সংশোধিত ও পরিমার্জিত। ২. হিন্দুস্তানি নুসখা সমূহের মাঝে কুতুবখানায়ে রশীদিয়া দিল্লি প্রকাশিত “জামে তিরমিজি”। যার বিশুদ্ধতা ও নির্ভরযোগ্যতার বিষয়টি প্রসিদ্ধ। ৩. দারুসসালাম রিয়াজ প্রকাশিত মওসুআতুল হাদিসিস শরীফ আল কুতুবুস সিতত্বাহ। এটিও একটি নির্ভরযোগ্য ও পরিমার্জিত সংস্করণ। যা শাইখ সালেহ ইবনে আব্দুল আজিজ রহ. এর নিজস্ব সম্পাদনা ও তত্ত্বাবধানে রচিত। ৪. শাইখ বাশ্শার আওয়াদ মারুফ দা. বা. সম্পাদিত দারুল গারবিল ইসলামী প্রকাশিত “আল জামিউল কাবির”। প্রসিদ্ধ এই চারটি বিশুদ্ধ নুসখাকে সামনে রেখে তিরমিযী শরীফের ইবারতের সংশোধন , পরিমার্জন ও বিশুদ্ধকরণের সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন মুসাননিফ দা. বা.।

দুই . শিক্ষার্থীদের আলোচ্য বিষয়ের সঠিক মর্ম অনুধাবনের জন্য সহীহ হারাকাত – সাকানাত দিয়ে সুসজ্জিত করেছেন তিরমিজি শরীফের পূর্ণ ইবারতকে।
তিন . নুসখার ভিন্নতা বা আধিক্যতাকে “বায়নাল মাকুফাইন” তথা দ্বিতীয় বন্ধনীর মাধ্যমে চিহ্নিত করেছেন। ইবারত সংশ্লিষ্ট কোন কথা বা হাদীসের মূল মতনের সাথে সম্পৃক্ত অতিব প্রয়োজনীয় এমন সকল বিষয়, যা মূল ইবারতের সাথে লেখাটা সমিচীন নয়, সে গুলোকে হাশিয়াতে লিখেছেন।
চার . অধ্যয়নের ভারসাম্যতা ও সামঞ্জস্যতা ঠিক রাখতে বাক্যের মাঝে ব্যবহৃত চিহ্নরীতি তথা দাড়ি, কমা, কোলন , সেমিকোলন , ফুলস্টপসহ অন্যান্য রীতিনীতির যথাযথ প্রয়োগ করেছেন।

পাঁচ . নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখ নিঃসৃত বাণীগুলোকে “বায়নাল কাউসাইন” তথা প্রথম বন্ধনীর মাধ্যমে অন্যান্য কথার থেকে আলাদা করে উল্লেখ করেছেন।

ছয় . কিতাবের অনুচ্ছেদ সমূহের প্রতিটি অধ্যায়ে নাম্বার লাগিয়েছেন। পাশাপাশি শুরু থেকে প্রতিটি হাদীসের ধারাবাহিক নাম্বারও টেনে দিয়েছেন।
সাত .وفي الباب বলে ইমাম তিরমিযি রহ. কর্তৃক উল্লিখিত সাহাবীদের নামগুলোকে একত্রে আলাদা প্যারায় উল্লেখ করে দিয়েছেন। যাতে বিষয়টির স্বাতন্ত্র্যতা ও তাৎপর্যতা পরিলক্ষিত হয়। গুরুত্ব ও ব্যাপকতা দৃষ্টিগোচর হয়।

আট . قال أبو عيسى বলে বর্ণিত হাদীসের উপর ইমাম তিরমিজি রহ. এর অর্পিত হুকুম , কিংবা সনদে বর্ণিত রাবীদের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ কোন আলোচনাকে পৃথক প্যারায় উল্লেখ করেছেন।

নয় . হাদিস থেকে উৎসারিত মাসাআলার ব্যাপারে ইমামগণের বর্ণিত মতামত, কিংবা হাদিসের দুর্বলতার প্রতি ইঙ্গিতবহ কোন বিষয় উল্লেখকরণ সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় কথাবার্তা আলাদা আলাদা প্যারায় উল্লেখ করেছেন। যাতে শিক্ষার্থীদের বুঝতে সুবিধা হয়। এবং বিভ্রান্তি ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের শিকার না হয়।

দশ . সবশেষে পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত হওয়ার পর কয়েক দফায় পুনরায় সম্পাদনা ও তাসহীহ করণের মাধ্যমে জাতির সম্মুখে তিরমিজি শরীফের বিশুদ্ধ ও মানসম্মত একটি মতন উপহার দেয়ার জন্য মুসাননিফ দা. বা. সর্বোচ্চ চেষ্টা ও নিরলষ মেহনত করেছেন। তাই বলা যায় “আল আরফুয যাকী” কিতাবে স্থান পাওয়া তিরমিজি শরীফের ইবারতটি সমকালের সর্বাধিক পরিশোধিত, পরিমার্জিত, মানসম্মত ও নির্ভরযোগ্য।

মতনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ

” আল আরফূয যাকী” কিতাবটি মূলত আল্লামা মুহাম্মদ আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ. এর “ইফাদাতে হাদিসিয়্যাহ” তথা হাদিস বিষয়ক নানাবিধ উলূম ও মাআরিফের অনবদ্য সংকলন। পাশাপাশি এটি আল্লামা রহ. এর সংক্ষিপ্ত ও তাৎপর্যপূর্ণ এবং ইঙ্গিতবহ আলোকপাতের সহজ-সাবলীল, সাজানো – বিন্যস্ত একটি দারুণ প্রয়াস। সেই সাথে রয়েছে আল্লামা রহ. এর গৃহীত পন্থা ও অনুসৃত পদ্ধতির আলোকে “জামে তিরমিযী” এর নিগূঢ় রহস্য উদঘাটন , হাদীসে নববীর মাঝে গচ্ছিত উলুম ও মাআরিফের উৎসারণ, নানাবিধ আসরার ও হিকমতের উম্মোচন, আরো অনেক বিষয়ের সঠিক ও নির্ভুল সমাধান। রয়েছে আরো অভিনব কিছু বিষয়ের অবতারণা, যা মূলত ইলম পিপাসু পাঠকবৃন্দের চিন্তার জগতে নিয়ে আসবে আমূল পরিবর্তন। জ্ঞানের ভূবনে খুলবে আলোর নতুন দিগন্ত।

এক কথায় আল্লামা রহ. দরসি ইফাদাতের সহজীকরণ , মেধা ও বুদ্ধির নিকটবর্তীকরণের এর পাশাপাশি মূল কিতাব হল, সংশ্লিষ্ট মাসআলার সবিস্তর আলোকপাত, হাদিস, ফিকহ, উসূলে হাদিস, উসূলে ফিকহ সহ নতুন আরো অনেক বিষয়ের অবগতির ক্ষেত্রে সুন্দর, সুবিন্যস্ত, সমৃদ্ধ, আলোকোজ্জ্বল সুবিশাল এক রত্ন ভাণ্ডার। নিম্নে এই কিতাবের অনাবিল কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা তুলে ধরার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।

এক . আল্লামা কাশ্মীরী রহ. “ইফাদাতে হাদিসিয়্যাহ” তথা হাদিস বিষয়ক নানাবিধ উলুম ও মাআরিফের অনবদ্য সংকলন তৈরির লক্ষ্যে মুসাননিফ দা. বা. প্রতিটি অধ্যায় ও হাদিসের ব্যাখ্যা – বিশ্লেষণে আল্লামা রহ. এর দরসে হাদীসে অংশগ্রহণকারী ব্যাক্তিবর্গ কর্তৃক কয়েকটি হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপি এবং মূদ্রিত নুসখা গভীরভাবে মুতালাআ করেছেন এবং সেখান থেকে প্রতিটি অধ্যায় ও হাদিসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আলোচনাকে সংশ্লিষ্ট অধ্যায় ও হাদিসের অধীনে উল্লেখ করেছেন। নিম্নে সেই সকল হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপি আর মুদ্রিত নুসখাসমূহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলো –

১. কাজী নূর মুহাম্মদ ইবনে সীর মোহাম্মদ আল ফিনজাবী রহ. হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপি। যাতে রয়েছে আল্লামা রহ.-এর তিরমিযি শরীফের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পরিপূর্ণ দরসী তাকরীর।

২. হযরত মাওলানা আনোয়ারুল হক আজমী রহ. হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপি। এটিও তিরমিযি শরীফের দরসী ইফাদাত সম্বলিত। তবে তা অসম্পূর্ণ। তাঁরই রয়েছে আরো একটি পান্ডুলিপি। তাতে তিনি বুখারী শরীফের দরসী ইফাদাত একত্র করেছেন।

৩. হযরত মাওলানা মুবিন আল ফারুকী রহ. হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপি। যা মূলত আবু দাউদ শরীফের দরসী ইফাদাত সম্বলিত। তিনি নিজেই তার সম্পাদনা ও মুরাজাআত করেছেন। তবে তা অসম্পূর্ণ।

৪. হাকীমুল ইসলাম হযরত মাওলানা ক্বারী তয়্যব সাহেব রহ. হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপি। যা উর্দু ভাষায় রচিত তিরমিযি শরীফের সংক্ষিপ্ত একটি দরসী ইফাদাত।

৫. “العرف الشذي على جامع الترمذي” হযরত মাওলানা মুহাম্মদ চেরাগ আলী রহ. লিখিত তিরমিযী শরীফের অনন্য কিতাব। বর্তমানে তা আলাদাভাবে ছেপে এসেছে।

৬. “أنوار المحمود على سنن أبي داود” আল্লামা আব্দুল হাদী মোহাম্মদ সিদ্দিক নজিবাবাদী রহ. লিখিত মূল্যবান একটি গ্রন্থ। যা মূলত আকাবিরে দেওবন্দের প্রবীণ ও প্রখ্যাত চার ব্যাক্তিত্বের “ইফাদাতে হাদিসিয়্যাহ” এর অনবদ্য সংকলন। তাঁরা হলেন- শাইখুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দী রহ., আল্লামা মুহাম্মদ আনোয়ার শাহ কাশমীরী রহ., শাব্বির আহমদ উসমানী রহ., খলীল আহমদ সাহারানপুরী রহ.। তবে নজিববাদী রহ. অন্য তিন বুযুর্গের চেয়ে কাশ্মীরী রহ. এর ইলমী অবগাহন থেকে বেশি উপকৃত হয়েছেন। তাই কাশ্মীরী রহ. থেকে সংগৃহীত উলুম ও মাআরিফের সবকিছুই তিনি তার লিখিত কিতাবে যথোপযুক্ত জায়গায় উল্লেখ করেছেন।

৭. “فيض الباري شرح صحيح البخاري” আল্লামা বদরে আলম মিরেঠী রহ. লিখিত সহীহ বুখারীর দরসী ইফাদাতের অনবদ্য
সংকলন। সাথে রয়েছে সংকলকের সমৃদ্ধ মহা মূল্যবান টিকা “البدر الساري الى فيض الباري” যার অধিকাংশই আল্লামা কাশমীরী রহ. এর ইলমী ঝর্না থেকে উৎসারিত।

৮. “معارف السنن” আল্লামা মুহাম্মদ ইউসুফ বানুরী রহ. লিখিত কাশ্মীরী রহ. এর “ইফাদাতে হাদিসিয়্যাহ” এর আলোকে তিরমিজি শরীফের সমৃদ্ধ, ব্যাপক বিস্তৃত একটি ব্যখ্যাগ্রন্থ। তবে তা অসম্পূর্ণ।

৯. “أنوار الباري شرح صحيح البخاري” আল্লামা আহমদ রেজা বিজনুরী রহ. রচিত উর্দু ভাষায় সহীহ বুখারীর ইফাদাতে কাশ্মীরীর অনবদ্য সংকলন।
এছাড়াও আল্লামা কাশমীরী রহ. এর অন্যান্য কিতাব ও গবেষণালব্ধ বিভিন্ন রেসালা থেকেও মুসাননিফ দা. বা. বিভিন্ন বিষয় মুতালাআ করে যথোপযুক্ত জায়গায় উল্লেখ করে পাঠকবৃন্দের হাতের মুঠোয় ইফাদাতে কাশ্মীরীর সুবিশাল এক জগত একত্র করে দিয়েছেন।

দুই . ইফাদাতে কাশ্মীরীকে সহজীকরণ ও পাঠকবৃন্দের মেধা ও বিবেকের সহানুগামী করণের লক্ষ্যে মুসাননিফ দা. বা. নিজের পক্ষ থেকে সহজ- সাবলীল ও সুবিন্যস্ত ইবারতে মাসআলার আলোকপাত করেছেন। উপর্যুক্ত হস্তলিখিত বা মূদ্রিত কোন নুসখার ইবারতের অনুগত হননি।

তিন. বিভিন্ন কিতাবে ও নানান জায়গায় ছড়ানো- ছিটানো, বিক্ষিপ্ত কাশ্মীরী রহ. এর উলুম ও মাআরিফকে একত্র করে তার সামঞ্জস্যপূর্ণ জায়গায় ও নির্ধারিত অধ্যায়ে মুসাননিফ দা. বা. উল্লেখ করেছেন। যেগুলো খুঁজে খুঁজে একজন তালেবে ইলমের জন্য মুতালাআ করা বড়ই দুরূহ ও দুষ্কর।

চার . হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপি ও মুদ্রিত বিভিন্ন নুসখাসমূহ আল্লামা কাশ্মিরী রহ. এর দরসী তাকরীরের অনুকরণে লিখিত হওয়ায় মূল আলোচনার সঙ্গে নূন্যতম সম্পর্কের ভিত্তিতে অনেক গবেষণালব্ধ বিশ্লেষণমূলক অপ্রাসঙ্গিক বিষয়বস্তু লিপিবদ্ধ হয়েছে। পাঠকবৃন্দের সুবিধার্থে মুসান্নিফ দা. বা. সেই সকল বিষয়বস্তুকে তার প্রাসঙ্গিক সামঞ্জস্যপূর্ণ জায়গায় স্থানান্তর করেছেন। যাতে পাঠকবৃন্দ বিরক্তি ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের শিকার না হয়। এবং উদ্দিষ্ট স্থানে কাশ্মীরী রহ. এর তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা থেকে বঞ্চিত না হয়।

পাঁচ . এছাড়াও দরসী তাকরীরের অনুকরণে কখনও কখনও কোন গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্যবহ বিষয়ে লম্বা আলোচনা এড়াতে শুধু বড়ো বড়ো কিতাবের উদ্বৃতি দিয়েই ক্ষান্ত করা হয়েছে।

পন্থা অনুসারে মুসানিনফ দা. বা. লুগাত ও গরীবুল হাদীসের নির্ভরযোগ্য কিতাব থেকে মতনে হাদীসের মাঝে বিদ্যমান দুর্বোধ্য ও অপরিচিত শব্দগুলোর সঠিক ও হাদিসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ মর্মার্থ উদ্ধার করতে সর্বাত্মক প্রয়াস চালিয়েছেন। যাতে শিক্ষার্থীরা হাদিসের মতলব ও অন্তর্নিহিত রহস্য উদঘাটনে এখান থেকে ব্যাপক সহায়তা লাভ করতে পারে।

সাত . ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের প্রয়োজন এমন সব বাক্যকে قوله বলে আলাদা করে উল্লেখ করেছেন। কোন ফিকহী মাযহাবের অনুগত না হয়ে হাদীসটির অন্যান্য সনদে বর্ণিত সমস্ত শব্দমালা সামনে রেখে বিষয়টির অন্তর্নিহিত মর্ম উদঘাটনে যথাসম্ভব চেষ্টা করেছেন। হাদীসে বর্ণিত বাক্য মালার পরস্পর সম্পর্ক, পূর্বাপর প্রসঙ্গ, ব্যবহৃত শব্দ সমূহের আভিধানিক অর্থ এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখে হাদীসটির এমন যুৎসই ও চমকপ্রদ ব্যাখ্যা করেছেন, যা আরবি ভাষার রীতিনীতি ও মুতাকাল্লিমের মাকসাদের সাথে একেবারে সামঞ্জস্যপূর্ণ। একাধিক উক্তি বর্ণনার ক্ষেত্রে দলিলবিহীন অনর্থক উদ্ভট মতামতসমূহের পেছনে না পড়ে হাদিসের মূল বক্তব্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রমাণের ভিত্তিতে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত , ইশকাল ও এতেরায বহির্ভূত উক্তিসমূহকে বেছে বেছে উল্লেখ করেছেন।

আট . ফেকহী মাসায়েলের ক্ষেত্রে আল্লামা কাশ্মীরি রহ. এর অনুসৃত কর্মপদ্ধতির আলোকে মুসান্নিফ দা . বা. হাদিস থেকে উৎসারিত মাসালায় ইমামগণের মধ্যকার মতানৈক্যকে তথ্য- উপাত্ত এবং দলীল – প্রমাণের মাধ্যমে সুসজ্জিত করেছেন। পূর্ণ আদাব ও আখলাকের সাথে উসূলের ভিত্তিতে বিপক্ষ থেকে উত্থাপিত বিভিন্ন ইতেরাজ ও ইশকালের প্রতিউত্তর করেছেন। পাশাপাশি তাদের বর্ণিত দলিলের ত্রুটিপূর্ণ দিকগুলোও উল্লেখ করেছেন। সেই সাথে হানাফী মাযহাবকে অন্যান্য মাযহাবের সাথে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে অগ্রাধিকারের কারণ সমূহ উল্লেখ করার পাশাপাশি হাদীস ও আছারের ভিত্তিতে শক্তিশালী ও মযবুত করেছেন। পরস্পর বিরোধপূর্ণ হাদীসের ক্ষেত্রে তৎসংশ্লিষ্ট অন্যান্য সনদে বর্ণিত রেওয়ায়েতের শব্দমালা একত্র করে হাদীসটির বিশুদ্ধ ও মানসম্মত তাওজীহ করেছেন।

নয় . গায়রে মুকাল্লিদীন কিংবা অন্যান্য মতাবলম্বীদের সাথে বিরোধপূর্ণ মাসআলা সমূহের সবিস্তারে আলোচনা করেছেন। খুঁটি- নাটি বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে পাঠকবৃন্দের সামনে সঠিক ও বিশুদ্ধ চেতনাকে সুস্পষ্ট করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন।

দশ . তিরমিযী শরীফে বর্ণিত যে সকল মাসআলা তাহাবী শরীফেও আছে , সেগুলো কে ইমাম তাহাবী রহ. এর বরাতে মুসাননিফ দা. বা. সংশ্লিষ্ট অধ্যায়ে সবিস্তারে সুবিন্যস্তভাবে আলোচনা করেছেন। এতে করে বিষয়টি আরো প্রামাণিক ও হানাফী মাযহাবের মযবুতির কারণ হয়েছে।

প্রয়োজনীয় টিকা- টিপ্পনী 

মতন ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাঝে লিখিত কোনো বিষয়বস্তু বা আলোচনাকে আরো সুস্পষ্ট করা, এর সাথে পাঠকের অবগতির লক্ষ্যে বাড়তি কোনো কথা যোগ করা, কিংবা এতে বিদ্যমান সংশয় – সন্দেহ দূর করার জন্য মূলত এসকল টীকাটিপ্পনীর সংযোজন করা হয়। মুসাননিফ দা. বা. এই জাতীয় বিষয়ের পাশাপাশি টীকা – টিপ্পনীর মাঝে অন্যান্য নতুন নতুন এমন বিষয়ের অবতারণা করেছেন যা মূলত কিতাবের সৌন্দর্যকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। যার ফলে ইমাম তিরমিজি রহ. এর উৎকর্ষতা ও নৈপুণ্যতার বিষয়টি জাতির সামনে আরো সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আর ইলম পিপাসু শিক্ষার্থীদের জন্য অনুপম দিশারী রূপে পরিণত হয়েছে। নিম্নে টিকা -টিপ্পনিতে স্থান পাওয়া বিষয়াদির ব্যাপারে সম্যক ধারণা দেয়ার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।

এক . ইমাম তিরমিজি রহ. মূল কিতাবে সনদ ও মতন সহকারে হাদিস তাখরিজের পাশাপাশি وفي الباب এর শিরোনামে কেবল সাহাবীদের নাম উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বর্ণিত অন্যান্য হাদীসের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। যা ইমাম তিরমিজি রহ. এর স্বতন্ত্র ও গৌরবময় একটি বৈশিষ্ট্য। মুসাননিফ দা. বা. টিকার মাঝে ইঙ্গিতপূর্ণ সেসকল হাদিসের রীতিমত তাখরিজ ও হুকুম আলাল আসানীদও উল্লেখ করেছেন। যাতে পাঠকবৃন্দ এর থেকে ভরপুর ফায়দা লাভ করতে পারে , এবং সে সকল হাদিসকে মূলঅধ্যায়ে বর্ণিত হাদিসের সাথে মিলিয়ে নতুন নতুন বিষয় উদঘাটনে সক্ষম হয়।

দুই . ইমাম তিরমিজি রহ. এর অনুপম নৈপুণ্যতা আর পরিপূর্ণ উৎকর্ষতার সমুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো- তিনি কিতাবে বর্ণিত প্রতিটি হাদিসের মান নির্ণয়ের জন্য তৈরি করেছেন নিজস্ব ইসতেলাহ। এবং এর মাধ্যমে নির্ধারণ করেছেন প্রতিটি হাদিসের স্তর। বিজ্ঞ উলামায়ে কেরাম ইমাম তিরমিজি রহ. এর
হাদিসের স্তর নির্ধারণে বর্ণিত ইসতেলাহকে বিশেষ মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখেন এবং এর প্রতি গভীর আস্থা পোষণ করেন। তবে এসকল ইসতেলাহের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে উলামায়ে কেরামের দ্বিমত থাকলেও আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী রহ. এর তাহকীক হল- এগুলো ইমাম তিরমিজি রহ. এর নিজস্ব ইসতেলাহ।

তার রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ العلل الصغير এর মাঝে যে ব্যাখ্যা বর্ণিত হয়েছে , সেটিই এক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। মুসাননিফ দা. বা. আল্লামা রহ. এর এই দৃষ্টিকোণকে সামনে রেখে ইমাম তিরমিযী রহ. এর হাদিসের স্তর নির্ধারনে বর্ণিত প্রতিটি ইসতেলাহের توجيه القول بما يرضى به القائل এর পুংক্ষানূরুপে অনুসরণ করে বিস্তারিত তাহকীক , তাশরীহ , ও তাতবীক দিয়েছেন। ফলে হাদীস , উসূলে হাদিস , জরাহ , তাদীল , ইলালে হাদিস সহ উলুমুল হাদিসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে এসেছে মুসাননিফ দা. বা. এর এই “তাতবীক” শিরোনামের অধীনে। রচিত হয়েছে নতুন অপূর্ব একটি দিগন্ত। যোগ করেছে ইলমী অঙ্গনে নতুন চিন্তাধারার।

তিন . এছাড়াও টিকার মাঝে রয়েছে আলোচনায় বর্ণিত নতুন নতু হাদিসের সংক্ষিপ্ত তাখরীজ, গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথার হাওয়ালা প্রদান, পাঠকবৃন্দের অবগতির লক্ষ্যে বাড়তি কোনো কথা যোগকরণ।

চার . কিতাবে বর্ণিত টিকার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো — উসূলে হাদিস , উসূলে ফিকহ , জরাহ – তাদীল, ইলালে হাদিস সহ উলুমুল হাদিসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ, তাৎপর্যবহ বিষয়াদির মৌলিক সমাধান এতে স্থান পেয়েছে। যা পাঠকবৃন্দকে উল্লেখিত বিষয়ের জটিলতা ও দুর্বোধ্যতা থেকে রেহাই দিবে। সঠিক ও বিশুদ্ধ সমাধান দান করবে।

পাঁচ . পাশাপাশি এতে সন্নিবেশিত হয়েছে আল্লামা কাশ্মিরী রহ. এর ইফাদাতের ত্রুটিপূর্ণ কিছু বিষয়। যা পাঠকবৃন্দকে করবে সচেতন ও আরো চৌকস।

মোটকথা নানাবিধ বৈশিষ্ট্য আর নতুনত্বে ভরপুর এই কিতাবটি। চাই তা মতনের সাথে সংশ্লিষ্ট হোক বা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সাথে কিংবা টীকা – টিপ্পনীর সাথে। সেই সাথে ইফাদাতে কাশ্মিরী তো আছেই। প্রতিটি প্যারা আর অধ্যায়কে ঘিরে। মহান আল্লাহ তাআলার কাছে কিতাবটির সর্বব্যাপী মাকবুলিয়্যাত , এর কল্যাণ ও উপকারিতা সর্বস্তরে ব্যাপক হবার আশা করে লেখার ইতি টানছি।

দারুল উলুম দেওবন্দ, উত্তর প্রদেশ , ইন্ডিয়া থেকে

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *