পাথেয় রিপোর্ট : আগামী জাতীয় একাদশ নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। তোরজোড় করে মাঠে নেমে গেছে সব রাজনৈতিক দলই। তবে এবারের নির্বাচনে দেশের দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কাছ থেকে বিভিন্ন আসনে ছাড় পাওয়ার আশায় রয়েছে ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন দল। ভোটের মাঠে স্পষ্ট হয়ে উঠছে ইসলাম ধর্মভিত্তিক দল ও সংগঠনগুলোর তৎপরতা। এই দলগুলোর একক শক্তিতে ভোটের বৈতরণী পার হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তাই তারা বড় দলের সমর্থন ব্যবহারের চেষ্টা করছে। এসব দলের অধিকাংশই আওয়ামী লীগ এবং এর মিত্র জাতীয় পার্টির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
‘নৌকা’ ও ‘ধানের শীষ’ নিয়ে নির্বাচন করতে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে যে প্রতিযোগিতা চলছে, তাদের একটি অংশ আবার গত দুটি জাতীয় নির্বাচনে ছিল বিএনপির বলয়ে। এবার তারা নৌকায় উঠতে চাইছে। এবার ভোটের রাজনীতিতে সক্রিয় আছে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলিয়ে ৭০টি ইসলামি দল ও সংগঠন। এর মধ্যে ২৯টি দল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে। ৩২টি দল আছে জাতীয় পার্টির সঙ্গে, যারা ভোটের মাঠে সরকারের সহায়ক হিসেবে কাজ করবে। আর বিএনপির সঙ্গে আছে ৫টি দল।
এই দলগুলোর নেতারা আবার আলোচিত ধর্মভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামীতে আছেন। অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ভোট নিয়ে কোনো মাথাব্যথা না থাকার কথা বললেও তাদের সংগঠনের নেতাদের প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে নজর রাখবে।
২০১০ সালের মার্চে আল্লামা আহমদ শাহ শফির নেতৃত্বে ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন দলের নেতারা গঠন করেন হেফাজতে ইসলাম। এই সংগঠনের নেতারা ইসলামী ঐক্যজোট, নেজামে ইসলাম পার্টি, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম, খেলাফতে আন্দোলন, খেলাফতে মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফতে মজলিস ও খেলাফত ইসলামীরও নেতা।
তবে হেফাজত শুরু থেকেই দাবি করছে তাদের রাজনৈতিক পরিচয় বা অভিলাষ নেই। সংগঠনের যুগ্ম মহাসচিব এবং ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি মোহাম্মদ ফয়জুল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘নির্বাচনকেন্দ্রিক কোনো চিন্তা হেফাজতে ইসলামের নেই। হেফাজত নির্বাচন করবে না। হেফাজতভুক্ত রাজনৈতিক দলগুলো দলগত ও জোটগতভাবে নির্বাচনের চিন্তা-ভাবনা করছে। আর হেফাজত হলো অরাজনৈতিক, ঈমানি, আত্মশুদ্ধির একটি সংগঠন। হেফাজত রাজনীতি করে না, করবেও না।’
তবে এদের বাইরে দুটি দল—চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন ও বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন (আতাউল্লাহ) এখন পর্যন্ত কোনো দিকে যায়নি। তবে বিগত সিটি করপোরেশন নির্বাচনসহ তার আগে-পরে ইসলামী আন্দোলনের প্রতি সরকার কিছুটা নমনীয় ছিল। বিশেষ করে, ইসলামী আন্দোলন গত ১০ বছরে সারা দেশে ওয়াজ মাহফিলসহ নির্বিঘ্নে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়েছে। চরমোনাই পীরের অনেক মাহফিলে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সাংসদ ও প্রভাবশালী নেতাদের আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে থাকতে দেখা গেছে।
অবশ্য ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা ইউনুছ আহমাদ বলেন, ‘সব সময় আমরা সভা-মাহফিলের যে সুযোগ পাই, তা না। বিএনপি, জাতীয় পার্টিও সমাবেশ করে। তবে আমাদের প্রতি সরকারের একটা সুনজর থাকতে পারে এ কারণে যে আমরা হাঙ্গামা করি না। প্রশাসন আমাদের ঝুঁকি মনে করে না।’ তিনি বলেন, ‘সাময়িক সুবিধা পাওয়ার জন্য অনেকে অন্য জোটে যাচ্ছে। আমরা জোট, নোট, চোট এগুলোকে সতর্কভাবে এড়িয়ে চলছি।
এবার নৌকায় উঠছে বিএনপির সাবেক শরিকরা
১৭ বছরের সম্পর্কের ইতি টেনে ২০১৬ সালে ২০-দলীয় জোট থেকে বের হয়ে যাওয়া ইসলামী ঐক্যজোট এবার ‘নৌকা’ প্রতীকে ভোট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রয়াত নেতা মুফতি ফজলুল হক আমিনীর এই জোট এবার কমপক্ষে চারটি আসনে ছাড় চাইছে আওয়ামী লীগের কাছে।
জোটের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ নেজামীর জন্য নরসিংদী-৩ ও ঢাকা-৫, মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ জন্য চট্টগ্রাম-৭, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান মাওলানা আবুল হাসানাত আমিনীর জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসাইনের জন্য কুমিল্লা-১ আসন চাওয়া হয়েছে। এর মধ্যে হাসানাত আমিনীর আসন নিশ্চিত ধরে নিচ্ছেন তারা। কুমিল্লা-১ আসনও পাওয়ার সম্ভাবনার কথা বলছেন তারা। এখন জোর চেষ্টা চলছে চট্টগ্রাম-৭ এবং নরসিংদী-৩ আসনের জন্য।
ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ নেজামী বলেন, “দল ও জোটগতভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি আছে আমাদের। যদি ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সমঝোতা হয়, সে ক্ষেত্রে জোটগত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ইসলামী ঐক্যজোটের মজলিসে শুরার অনুমোদনে নৌকা প্রতীকে ভোট করা হবে। আর তা না হলে আমাদের নিজস্ব প্রতীক ‘মিনার’ নিয়েই নির্বাচন করব।”
২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে ধর্মভিত্তিক দল তরীকত ফেডারেশনকে চট্টগ্রাম-২ এবং লক্ষ্মীপুর-১ আসনে ছাড় দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এবার আরও বেশি আসন চাইছে তারা।
জাকের পার্টির দাবি আছে ফরিদপুর-২ আসন। সেখানে দলের চেয়ারম্যান মোস্তফা আমীর ফয়সল মোজাদ্দেদী প্রার্থী হতে চান। সবুজ সংকেত পাওয়ার দাবি করছেন নেতাকর্মীরা, যদিও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এখনো আসেনি।
বিএনপির সঙ্গে আছেন যারা
২০-দলীয় জোটের শরিক খেলাফত মজলিস বিএনপিকে চিঠি দিয়ে ১০টি আসন চেয়েছে। দলের মহাসচিব আহমাদ আবদুল কাদের বলেন, ‘জোট ও দলগতভাবে নির্বাচনে অংশ নেবে খেলাফত মজলিসের প্রার্থীরা। জোট থেকে যাদের মনোনয়ন দেয়া হবে, তারা জোটগতভাবে নির্বাচন করবে। আর কয়েকজন দল থেকেও প্রার্থী হবেন। বিষয়টি নির্বাচন কমিশনকে জানানো হয়েছে।’
আবদুল কাদের বলেন, ‘আমরা ১০-১২টা আসন চেয়েছি। জোটের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া এলেও সংখ্যাটা নিয়ে এখনো দেনদরবার চলছে।’
বনিবনা না হলে জোট ছাড়ার কোনো চিন্তা আছে কি না, এমন প্রশ্নে সরাসরি ‘না’ বলেন আহমাদ আবদুল কাদের।
২০ দলের আরেক শরিক জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আফেন্দি বলেন, ‘আমাদের ৫২ আসনে প্রার্থী দেয়ার প্রস্তুতি রয়েছে। সেখান থেকে বাছাই করা ১৫-২০ জন প্রার্থীর তালিকা জোটের কাছে জমা দিয়ে আমরা অপেক্ষা করছি। জোটের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সময় হলে ডাকা হবে।’
সরকারের সমর্থনে নতুন ইসলামী জোট
সর্বশেষ সম্মিলিত ইসলামী জোট নামে নতুন একটি জোটের আত্মপ্রকাশ হয় ৩ নভেম্বর। এই জোটের শরিক দল আটটি। এই জোটের চেয়ারম্যান মাওলানা জাফরুল্লাহ খান দীর্ঘদিন প্রয়াত মাওলানা মোহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব ছিলেন। সম্প্রতি তিনি ওই দলের মহাসচিবের পদ হারান। এরপর তিনি খেলাফত আন্দোলনের একাংশ নিয়ে নতুন দল করেন। এত দিন তাঁর অবস্থান ছিল সরকারের বিরুদ্ধে। চলতি মাসে জাফরুল্লাহ খান আটটি অনিবন্ধিত সংগঠন নিয়ে সম্মিলিত ইসলামী জোট গঠন করেন। তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচন করতে চায়। জোটের নেতারা গত শুক্রবার ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে বৈঠক করেন।
বৈঠকের বিষয়ে সম্মিলিত ইসলামী জোটের কো-চেয়ারম্যান মুফতি ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ১০টি আসনের প্রার্থী তালিকা দিয়েছি। ওবায়দুল কাদের সাহেব বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে আমাদের জানাবেন।’
মুফতি ফখরুলও খেলাফত আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। এখন তিনি বাংলাদেশ জনসেবা আন্দোলন নামে নতুন দল গঠন করেছেন।
গত সেপ্টেম্বর মাসে ১৫টি দল নিয়ে সরকারের সমর্থনে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (আইডিএ) নামের আরেকটি জোটের আত্মপ্রকাশ হয়। এর চেয়ারম্যান বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমান চৌধুরী, কো-চেয়ারম্যান লক্ষ্মীপুর-১ আসনের তরীকত ফেডারেশনের সাংসদ এম এ আউয়াল। এই দুজন দীর্ঘদিন থেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আছেন। এই জোট সাতটি আসন চেয়ে সরকারের কাছে তালিকা দিয়েছে।
এম এ আউয়াল বলেন, ‘আমরা জাকের পার্টি, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ (বাহাদুর শাহ), সাইফুদ্দীন মাইজভান্ডারীর দল সুপ্রিম পার্টিসহ আরও কয়েকটি দলকে অন্তর্ভুক্ত করে জোট পুনর্গঠন করছি। আশা করছি পাঁচ থেকে সাতটি আসন পাব।’