নবভোর, কতদূর

নবভোর, কতদূর

নবভোর, কতদূর

ইয়াছিন নিজামী ইয়ামিন : মানুষ যে কত অসহায়, তা যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে এই করোনা ভাইরাস। শতবর্ষের এমন দুর্যোগের দেখা মেলেনি মানবজাতির। হঠাৎ যেন থমকে গেছে সব, কর্মহীন হয়ে ঘরবন্দী মানুষ। উচ্চবিত্তদের কাছে এ সময়টা বড় ছুটি মনে হলেও, মহা দুর্বিপাকে পড়েছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মানুষগুলো। “কাজ নেই তো খাদ্য নেই “এমন অবস্থা যাদের, কিংবা যারা দিনমজুর, তাদের তো যারপরনাই অবস্থা। তাদের ভারাক্রান্ত চেহারায় তাকালে হৃদয়টা হাহাকার করে ওঠে। কিন্তু দুর্ভোগ! আমাদের দেশে এমন নিদারুণ দুর্যোগকালেও মানুষ অনৈতিক মুনাফা খোঁজে এবং পুঁজির সর্বতায়নের মোক্ষম সুযোগও মনে করে।

এমন বৈশ্বিক বিপর্যয় কে কবে দেখেছে, সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন! কিন্তু প্রকৃতি আমাদের এমন এক পরিস্থিতির সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে, যার থেকে নিস্তার পেতে হলে একতাবদ্ধ হয়ে মোকাবেলা করা ব্যতিরেকে আমাদের দুসরা কোন পথ নেই। তাই এই মুহূর্তে আমাদের করণীয় হল, সাময়িক একটু কষ্ট বরদাস্ত করে হলেও প্রশাসন কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান যে নির্দেশনা আমাদের দিবে বা দিচ্ছে, সেগুলো অবলীলায় মেনে নেয়া। তবে প্রাকৃতজনদের এগুলো কে বোঝাবে?

সরকার শৃঙ্খলা বজায় রাখতে দেশের সর্বোচ্চ বাহিনীকে মাঠে নামিয়েছে, কিন্তু জনসাধারণ এদের সাথেও তর্কে বিতর্কে লিপ্ত হচ্ছে। অথচ তারা এই দুঃসময়ের প্রাগ্রসর যোদ্ধা। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে করোনায়ও আক্রান্ত হচ্ছে। আমাদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই কাজ করে চলেছেন তারা। ইতিমধ্যে ডাক্তার, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, পুলিশ, আনসার, সাংবাদিকসহ সাধারণ স্বেচ্ছাসেবকদের আক্রান্তের সংখ্যা আজকে ( ২৮-০৪-২০ইং) পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে ৭ শতাধিক। তারপরও সেই মানুষগুলো আমাদের প্রতি তাদের সদ্ভাব বজায় রেখেছে। শত ঊর্ধ্ব বিষয় হচ্ছে, সামনে বাংলাদেশ যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে, তাতে আরো কঠোর হতে হবে প্রশাসন এবং সরকারকে। দেশের আপামর জনসাধারণের স্বার্থে অসচেতন মানুষগুলোকে সুললিত ভাষায় প্রজ্ঞা পূর্ণ বাণী আওড়ানোর সময় এখন নয়।

এদিকে সরকার প্রান্তিক কৃষক শ্রমিক ও নিম্নবিত্তের সাহায্যের জন্য গঠন করে যাচ্ছে লক্ষ্য কোটি টাকার তহবিল। কিন্তু পরিতাপ! যা গরীব দুস্থ মানুষদের একটু কষ্ট-দুঃখ নিবারণের প্রয়াস চালানোর কথা ছিল, তার প্রায় পুরোটাই পকেটস্থ হচ্ছে জনপ্রতিনিধি সেজে থাকা অর্থগৃধ্নদের হাতে। আর এদের অর্থগৃধ্নতা বৈভব লিপ্সার যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে অভাবী মানুষগুলোর আর্তি। এমন দুর্যোগকালে মানুষ যেমন উদারতা অর্জনের মধ্য দিয়ে মহামান্বিত হয়ে উঠতে পারে, তেমনি মানুষ এই পার্থিব জগতের লিপ্সার কারণে হয়ে উঠতে পারে নিষ্ঠুর, আবিলতায় ক্লোদপ্রোথিত। এদের কাছে খাদ্যাভাবে মানুষের হাহাকার তুচ্ছ হয়ে উঠেছে সামান্য পণ্য সামগ্রীর বিবেচনায়। না হয় এমন কীভাবে হতে পারে? ত্রাণের সামগ্রী ছিনিয়ে নিতে উদরে ছুরির আঘাত পড়ে, কিংবা দেশজুড়ে যখন খাদ্যাভাব, মানুষজন পেটের তাগিদে রাস্তায় বসে পড়ছে, ওই মূহুর্তেও সংবাদ পাওয়া যায়, সমাজের উঁচুতলার মানুষগুলোর কাছ থেকে পুলিশ একে একে উদ্ধার করেই চলেছে গুদামজাত করা চাল, পেঁয়াজ,আদা, তেল প্রভৃতি সামগ্রীর ভান্ডার। এই বিপর্যস্ত ক্রান্তিকালে এদের জন্য দয়া ও সহিষ্ণুতা ছাড়া আমাদের আর কী বা করার আছে! এই অসভ্যতার শাস্তি তাদের কোন না কোনদিন পেতেই হবে।

তবে আশার কথা হচ্ছে সম্প্রতি এমন একটি বাস্তব গল্প তৈরি হয়েছে যাতে রয়েছে অর্থগৃধ্নু সমাজের জন্য জানুলগ্ন হয়ে শিক্ষার সুযোগ, আর সহিষ্ণু দয়ার্দ্র ব্যক্তির জন্য রয়েছে আরও উদার হওয়ার বার্তা। আসলে প্রতিটা ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর বিষয়ে রয়েছে মানুষের জন্য শিক্ষা, তাই তো পরম করুণাময় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বার বার চিন্তা করার আদেশ করেছেন। এবং চিন্তাশীলদের জন্যই রয়েছে নিদর্শন।” ইন্না ফী যালিকা লা’আয়াতিল লিক্বওমিয়্যাতাফাক্কারুন”।

শেক্সপিয়ারের একটি উক্তি বলা যায়, অনেক সময় পোশাক মানুষকে প্রকাশ করে। তবে এটা যে সব সময় সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, তেমনটি প্রমাণ হল আবার, মেঘ যেমন সব সময় বৃষ্টির খবর দেয় না, তেমনি বাহ্যিক বেশভূষা অনেক সময় মনের নিরূপক হয় না। এমনটাই প্রমাণ করেছেন শেরপুর জেলার গান্ধিগাঁও গ্রামের বাসিন্দা নজিমউদ্দীন। রোজগারেরর উৎস ভিক্ষাবৃত্তি। বয়স ৭০ এর বেশি।এক টাকা, দু টাকা করে, নিজেকে তিলে তিলে ক্ষয় করে তিন বছর যাবৎ জমা করেছেন দশহাজার টাকা, ঘরটা মেরামত করবেন বলে। কিন্তু এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে তার কাছে ঘর মেরামত করার চাইতে মানুষকে সাহায্য করাটাই অধিক মানবিক মনে হয় বলে সঞ্চায়িত দশহাজার টাকা তুলে দেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হাতে মানবসেবায়।

তিনি বিশ্বাস করেন, তার এই টাকা দিয়ে বেশ কিছু পরিবার উপকৃত হবে। এটাই আজকে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয়।

ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বলেছিলেন, পাঁচটি কারণে একটি দেশের কিংবা একটি জাতির অস্তিত্ব বিলীন হতে পারে।
এক : দেশের বিধানজন লোভী হয়ে উঠবে
দুই : দেশের নেতারা ঐশ্বর্যের পিছনে ছুটবে
তিন : দেশের ব্যবসায়ীরা অসাধু হয়ে উঠবে
চার : দেশের সৈন্যদলগুলোকে শোভাবর্ধন করা হবে
পাঁচ : দেশের প্রশাসন বিভাগীয় কর্মচারীরা এবং ন্যায়দণ্ডধারী বিচারকমণ্ডলীরা দায়িত্বহীন হবে। আজকের এই দিনে উপরোক্ত পাঁচ কারণ থেকে কোন কারণটা ঘটতে বাকি আছে সেটা বিবেকবান মানুষ মাত্রই বুঝতে পারবেন।

এই চলমান সঙ্কট আমাদের দীর্ঘ জীবনের অপকর্ম ও অনৈতিকতার অর্জিত ফসল। বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতি, ভ্রান্ত বিশ্বাসের উচ্ছ্বাস, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মানবজাতিকে বিলাস-ব্যসনের তুঙ্গে তুলে দিয়েছে। আমাদের জীবনাচারে এই অব্যবস্থাপনা, আমাদের এই পরিস্থিতির ফল।তাই অনুশোচনার অনলে দগ্ধ হয়ে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বিধাতার কাছে এর থেকে মুক্তি চাইতে হবে আমাদের পুরো মানবজাতির জন্য।

আমাদের প্রত্যাশা, আবারো কোন এক দিগন্তে উদয় হোক মানবতার নবঊষার, তার আলোয় ঝলসে যাক তাবৎ জগতের সব অবিলতা, উদ্ভাসিত হোক সুন্দর সব হৃদয়ের, চিত্রায়িত হোক এই কথার “মানুষ মানুষের জন্য”।

লেখক : মাদরাসা শিক্ষর্থী

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *