আদিল মাহমুদ : সর্বপুণ্যময় ভূমি, পৃথিবীর কেন্দ্রস্থল, মক্কা নগরীতে মা আমেনার নয়নমনি, সাহাবায়ে কেরামদের পরশমনি, দু’জাহানে শিরমনি, আমার নবীজি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি এমন এক মানব, যাকে নিয়ে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি কথা হয়েছে, আলোচনা হয়েছে, লেখালেখি হয়েছে। তাঁর ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন এবং সামগ্রিক জীবন নিয়ে লেখা হয়েছে লাখো লাখো পৃষ্ঠা।
তিনি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব। শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি। মানবকুলের সর্দার। আশ্চর্য চরিত্রের অধিকারী। অতুল সৌন্দর্যমণ্ডিত রহমাতুল্লিল আলামীন। তাঁর জন্মের প্রাক্কালে ও জন্মের পর এই ধরনীতে সংঘঠিত হয়েছে অনেক আশ্চর্যজনক আলৌকিক ঘটনা। এই অলৌকিক ঘটনাগুলো থেকে কিছু তুলে ধরছি-
১. সততা, আমানতদারীতা, বিশ্বস্ততা ও সত্যবাদীতার জন্য সাদিক উপাধী পাওয়া নবীদের বংশে জন্ম নেয়া হযরত ইমাম সাদিক বলেছেন, শয়তান বা ইবলিস অতীতে সপ্তম আকাশ পর্যন্ত যেতে পারতো, অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে জানার জন্য সে সপ্তম আকাশে যেত। কিন্তু হযরত ঈসা আ.এর জন্মের পর থেকে চতুর্থ আকাশের উপরে ওঠা শয়তানের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এরপর যখন আমাদের নবী, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জন্মগ্রহণ করলেন তখন তার জন্য সব আকাশই নিষিদ্ধ হয়ে যায়। শয়তানকে আকাশের দরজাগুলো থেকে ধূমকেতু দিয়ে বিতাড়ন করা হয়।
২. পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ভোর, যেই ভোর বেলায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আগমন করলেন এই ধরনীতে, সেদিন বিশ্বের সবগুলো মূর্তি মাটির দিকে নত হয়ে পড়েছিল।
৩. সেদিনই ইরানের রাজার বিশাল প্রাসাদের বারান্দা কেঁপে ওঠেছিল এবং ছাদের ১৪টি প্রাচীর ধসে পড়েছিল।
৪. সেদিনই ইরানের সভে অঞ্চলের হ্রদটি তলিয়ে শুকিয়ে যায়। বহু বছর ধরে এই হ্রদের পূজা করা হত। (হ্রদ হল ভূ-বেষ্টিত লবণাক্ত বা মিষ্টি স্থির পানির বা জলের বড় আকারের জলাশয়। হ্রদ উপসাগর বা ছোট সাগরের মতো কোন মহাসমুদ্রের সাথে সংযুক্ত নয়, তাই এতে জোয়ার ভাটা হয় না।)
৫. সামাভে অঞ্চলে (কুফা ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী) পানির প্রবাহ সৃষ্টি হওয়া। অথচ বহু বছর ধরে সেখানে কেউ পানি দেখেনি।
৬. ইরানের ফার্স অঞ্চলের (বর্তমান যুগের শিরাজ শহর সংলগ্ন) অগ্নি উপাসনালয়ের আগুন সেই রাতে নিভে যায়। অথচ ওই আগুন এক হাজার বছর পর্যন্ত প্রজ্বলিত ছিল।
৭. ইরানি সম্রাটের প্রাসাদের খিলান আকৃতির তোরণ ভেঙে যায় মাঝখান দিয়ে। ফলে তা দুই টুকরো হয়ে গিয়ছিল।
৮. রাসূলের জন্মদিনের রাতে বেলায় হিজাজ বা বর্তমান সৌদি আরব থেকে একটি আলো দৃশ্যমান হয় এবং তা পূর্বাঞ্চলসহ সারা বিশ্বের ছড়িয়ে পড়েছিল।
৯. সেই ভোরে বিশ্বের সব সম্রাটের সিংহাসন উল্টে পড়েছিল।
১০. সেই দিন বিশ্বের সব রাজা বোবা হয়ে পড়েছিলেন। অর্থাৎ তারা কথা বলতে পারছিলেন না।
১১. সেই দিন গণকদের সব জ্ঞান লুপ্ত হয় এবং জাদুকরদের জাদুগুলো অকার্যকর হয়ে পড়েছিল।
রাসূল সা.এর মাতা মা আমিনা বলেছেন, আল্লাহর কসম, আমার পুত্র জন্ম নিয়েই তাঁর হাতগুলোকে মাটিতে রেখে মাথা আকাশের দিকে তোলে এবং চারদিকে তাকায়। এরপর তাঁর থেকে একটি নূর বা আলো ছড়িয়ে পড়ে ও সেই আলোয় সব কিছু দৃশ্যমান হয়। সেই আলোয় আমি সিরিয়ার (রোমানদের) প্রাসাদগুলো দেখলাম এবং সেই আলোর মধ্যে একটি শব্দ শুনলাম, শব্দটা হলো, সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষকে জন্ম দিয়েছো, তাই তাঁর নাম রাখ ‘মুহাম্মাদ’।
বর্ণনায় এসেছে, রাসূল সা.এর জন্মের সময় (বড় ও মূল) শয়তান তার সন্তানদের মধ্যে আর্তনাদ করে ওঠে। যার কারণে সবগুলো শয়তান তার কাছে এসে বলে, তুমি কেন এত পেরেশান বা উদ্বিগ্ন হয়েছে? সে বলল, তোমাদের প্রতি আক্ষেপ! রাতের প্রথম থেকে এ পর্যন্ত দেখছি যে আকাশ ও জমিনের অবস্থা বদলে গেছে। ভূপৃষ্ঠে ঘটে গেছে এক বিরাট ঘটনা। ঈসা আ. ঊর্ধ্ব আকাশে চলে যাওয়ার পর আর কখনও এত বড় ঘটনা ঘটেনি। সবাই গিয়ে খোঁজ-খবর নাও, কি ঘটেছে আজ।
শয়তানরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো এবং ফিরে এসে বললো, আমরা কিছুই তো দেখলাম না। বড় শয়তান বা শয়তানদের নেতা তখন বললো, এ বিষয়ে খোঁজ-খবর নেয়া আমারই কাজ।
এরপর সে পবিত্র মক্কার কাবাঘর সংলগ্ন অঞ্চলে এলো। সে দেখল যে ফেরেশতারা কাবাঘরের চারদিক ঘিরে রেখেছেন। শয়তান সেখানে ঢুকতে চাইলে ফেরেশতারা হুংকার দিলেন। ফলে সে ফিরে আসে ও চড়ুই পাখির মতো ছোট হয়ে হেরা পর্বতের দিক থেকে সেখানে প্রবেশ করে। জিবরাইল আ. বললেন, ফিরে যা ওরে অভিশপ্ত! সে বললো, হে জিবরাইল (ফেরেশতা), আমার একটা প্রশ্ন আছে, বলতো আজ রাতে কি ঘটেছে।
জিবরাইল আ. বললেন, সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদ সা. আজ রাতে জন্ম নিয়েছেন।
শয়তান আবার প্রশ্ন করলো, তাঁর মধ্যে কি আমার কোনো (কর্তৃত্বের) অংশ আছে?
জিবরাইল আ. বললেন, না।
শয়তান আবারও প্রশ্ন করলো, তাঁর উম্মতের মধ্যে কি আমার কোনো কর্তৃত্বের অংশ আছে?
জিবরাইল আ. বললেন, হ্যাঁ।
ইবলিস বলল, আমি সন্তুষ্ট হলাম।
হযরত আলী রা. বলেছেন, রাসূল সা.এর জন্মের রাতে পুরো দুনিয়া আলোকিত হয়। প্রতিটি পাথর ও মাটির টুকরো এবং বৃক্ষ বা গাছ হেসে ওঠেছিল, আকাশ ও জমিনের সব কিছু আল্লাহর তাসবিহ প্রশংসা জ্ঞাপন করেছিল।
লেখক : সহসম্পাদক, পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম
সম্পাদনা : মাসউদুল কাদির