প্রবাসের ডায়েরী (পর্ব-২) 

প্রবাসের ডায়েরী (পর্ব-২) 

(পর্ব-২) 

প্রবাসে আপনি আপনার দেশের আপনজনকে সবচাইতে বেশি মিস করবেন কখন জানেন? অসুস্থ অবস্থায়। একবার আমি এমনই এক করুণ মুহুর্তের সম্মুখীন হলাম। রমজান মাসের কিছুদিন আগে আমি মসজিদে ঢুকেছিলাম। রমজানকে কেন্দ্র করে তারা মসজিদে নানারকম সাজসজ্জা করে। রঙবেরঙের আলোকসজ্জায় মসজিদের ভেতর বাহির রঙিন করে ফেলে। ছাদে তৈরী করে কৃত্রিম চাঁদ-তারা। আমার মসজিদও সেভাবে সাজানো হলো। রাতের আধাঁরে পাহাড়ের উপরে আলো ঝলমলে একটি মসজিদ, উপরে মাহে রমযানের চাঁদ এই দৃশ্যটা কেমন লাগে ভাবুন তো!

রমজান মাস শেষ হলো। ঈদের পরে মদজিদের ছাদে টাঙানো কাঠের তৈরী সেই চাঁদ তারার ফ্রেম খুলে ফেলার দায়িত্ব এলো আমার কাঁধে। ছাদে উঠে একটা শুকনো কাঠের উপর ভর করে সবকিছু খোলার পর যখন নামতে যাই তখনই কাঠটা ভেঙ্গে যায় এবং আরেকটা ভারি কাঠের টুকরো আমার ডান হাতের কনুইর উপরে ঢুকে যায়। হাসপাতালে গিয়ে সেই টুকরো বের করতে হলো।

ঘটনা এতটুকুতে হলে আর ঝামেলা হতো না। আসল সমস্যা টা শুরু হলো এর পর । সেদিন রাত থেকেই প্রচণ্ড জ্বর আর শরীর ব্যথা। কারণ, আমি হাসপাতাল থেকে শুধু কাঠের টুকরো বের করে চলে এসেছি কোনো ওষুধ আনিনি। ভেবেছিলাম এমনিতেই সেরে যাবে। ধীরে ধীরে জ্বর ও ব্যথা বেড়েই চলছে। টানা তিন দিন রুম থেকে বের হতে পারিনি। দুনিয়ার কোনো খোঁজ খবরও ছিলো না আমার কাছে। ছিলো না কোনো সিম কার্ড বা ইন্টারনেট কানেকশন। মসজিদের সামনে মুসল্লির বাসার ওয়াইফাই ব্যবহার করেই দুই তিন মাস কাটিয়ে দিয়েছিলাম। বাহিরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই দেশের মানুষের সঙ্গে ফোনে কথা বলতাম। এই অসুস্থ অবস্থায় বাইরে যাওয়া তো দূরের কথা মসজিদেই যেতে পারিনি। তিনটা দিন মরার মতো পড়েছিলাম রুমের ভেতরে। কোনো খাবার নেই, শুধু পানি খেয়ে অসুস্থতার দিনগুলো পার করছিলাম।

একদিন অনেক কষ্টে দুটো সাদাভাত রান্না করি তা দুইদিন পর্যন্ত খাই। তিন চারদিন কেবল পানি আর সাদাভাত খেয়ে বেঁচে ছিলাম। হঠাৎ একদিন দেখি পাশের দোকানে কাজ করা কুমিল্লার রাজু খাবার নিয়ে আমার রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকে দেখে প্রাণ ফিরে পেলাম। বড় করে শ্বাস নিলাম। মনে হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে যেনো ফেরেশতা পাঠানো হয়েছে। সে কিছু শুকনা খাবার দিয়ে গেলো আর বলল, আপনার যা লাগে আমাদের কে বলবেন আমরা ব্যাবস্থা করবো। সে বাজার করে আনে আর তার সাথেই খাওয়া দাওয়া করি। এভাবেই কয়েক মাস কেটে যায়।

আমার এই অসুস্থতার সময়ে অঝোরে কান্না ছাড়া আর কিছুই করতে পারিনি। মনে হচ্ছিলো এই পৃথিবীতে আমার কেউই নেই। না আছে বাবা-মা, না আছে ভাই-বোন, আত্বীয়-স্বজন। মনে হয়েছিল পুরা দুনিয়াতে যেন আমি একা, যার নিজের অস্তিত্ব ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।

আল্লাহর মেহেরবানীতে সুস্থ হই। আবার পুরোদমে কাজ শুরু করি। নানান দেশের নানা রকম মানুষের সাথে মেলামেশা। আমি তখন মসজিদে ইমামতির পাশাপাশি আসর এবং মাগরিবের পর দুইটা টিউশনী শুরু করি। আর এশার পর থেকে ফজর পর্যন্ত একটা দোকানে কাজ নেই। পুরো দোকানটা আমি একাই সামলে নিতাম। তবে সেখানে যাওয়া আসাটা ছিলো খুবই কষ্টকর।

দোকানটা ছিলো আমার মসজিদ থেকে প্রায় তিন চার কিলো দূরে। রাস্তাটা ভয়ংকর। পথিমধ্যে পড়ে একটা ভাঙ্গা গাড়ির ‘গোরস্তান’। মানে সেখানে সব পুরাতন আর মামলায় ফেঁসে যাওয়া গাড়ি জমা করা হতো। সেখানে দুই একজন পাহারাদার ছিলো কিন্তু তারা রাতের বেলায় বাইরে থাকতো না। সেখানে পঁচিশ- ত্রিশটা কুকুর ছিলো খুবই ভয়ানক। ঘেউঘেউ করতে কররে একদম পায়ের কাছে চলে আসতো। সামনে পিছে, ডানে বামে সকল দিক থেকে ঘিরে ধরতো। কুকুরকে মোকাবেলা করেই প্রতিদিন পার হতে হতো সেই পথ। আমার মসজিদের পাশেই দুটো ছেলে ছিল সজীব রাজু দুই ভাই। তারা আমার এদিকে আসতো তাদের দোকান বন্ধ করার পর রাত দুইটার দিকে। একবার যখন ওই কুকুরের এলাকা দিয়ে আসতে থাকে সেসময় কুকুরের কবলে পড়ে যায়। তখন তারা দুই ভাই ভয়ে আর আতংকে প্রায় অজ্ঞান হওয়ার অবস্থা। কোনোরকম একটা গাড়ির সাহায্যে রক্ষা পায়। কিন্তু ভয়ে সজিবের মারাত্বক জ্বর চলে আসে।

আর এই পথ দিয়েই আমি প্রায় প্রতিদিনই যেতাম এবং শেষ রাতে এই রাস্তা দিয়ে আসতাম। এই কুকুরের যায়গাটা পার হওয়ার পরে এক পাহাড়ের পাশ ধরে হাঁটা ধরতাম। নির্জন এই পথ আমার গ্রামের ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনতে শুনতে ধান ক্ষেতের আল ধরে হাঁটার কথা মনে করিয়ে দিতো। দুই পাহাড়ের উপত্যকা পার হওয়ার সময় পাহাড়ের উপর থেকে কুকুরের ঘেউঘেউ ডাকে কলিজা শুকিয়ে যেতো। তারপরেও দোকানের কাজটা ছেড়ে দেইনি। এর একমাত্র কারণ ছিলো আমার আঞ্চলিক আরবী ভাষার খুব দ্রুত উন্নতি হচ্ছিলো।

এভাবেই তিন মাস কাজ করি সেই দোকানে। বলতে গেলে সেখান থেকেই আমার প্রবাস জীবনের মোড় ঘুরে যায়। যদিও এই তিন মাসে আমাকে বিভিন্ন সময় ডাকাতের খপ্পরে পড়তে হয়েছিলো। একবার তো এক বন্ধুকধারী এসে বুকে তাক করে টাকা পয়সা লুট করে নিয়ে যায়। আরেকবার গাড়িতে জিনিসপত্র উঠিয়ে দেওয়ার পর টাকা না দিয়েই লোকটা গাড়ি টান দেয়, তখন গাড়ির স্টেয়ারিং ধরার চেষ্টা করলে আমাকে প্রায় বিশ ত্রিশ গজ দূরে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যায়। এসমস্ত কাজ করতো নেশাগ্রস্ত মাঝবয়েসী সৌদিয়ানরা। কোনো ভীনদেশীরা এসব করার সাহস পেতোনা। কষ্টের বিষয় কি জানেন? এই দোকানে টানা তিন মাস কাজ করার পরেও এক রিয়ায়লও বেতন পেলাম না। বাধ্য হয়েও কাজটা ছেড়ে দেই এবং নিজেই একটা দোকান খোলার চিন্তা করি।

আমার মসজিদের পাশেই এক মুসল্লির সাথে মিলে একটা দোকান খোলার প্রস্তুতি নেই। এই ব্যসবসার মধ্য দিয়েই আমি একটু আধটু সফলতার মুখ দেখতে শুরু করেছিলাম। তখন আমার দোকানের মালামাল কিনতে আমি মক্কা যাই। এবং জীবনের প্রথম বারের মতো উমরাহ আদায় করি।

বায়তুল্লাহ শরীফে গিয়ে যখন কালো গিলাফে আবৃত খানায়ে কা’বা-কে স্বচক্ষে দেখি তখন নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না। আমি কি সত্যিই এখানে আসতে পেরেছি? আমার কাছে মনে হচ্ছিলো এই জীবনে আর কিছুই চাওয়া পাওয়ার নেই।

আল্লাহ আমাকে ছোট্ট এ জীবনে অনেক কিছু দান করেছেন তার মধ্যে মক্কার এই সফরটা ছিল আমার কাছে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ দান। আল্লাহর ঘর যিয়ারত করে এসে দোকান চালু করি নভেম্বর মাসের ৭ তারিখে। আলহামদুলিল্লাহ বেশ ভালই চলছিলো। আমার অধিকাংশ কাস্টমারই ছিলো ইয়ামেনী ইথুপিয়ান ইরেত্রীয় আর সৌদীর বাচ্চা ছেলে-মেয়েরা। এরই মধ্য দিয়ে শুরু হয় আমার প্রবাস জীবনের এক নতুন পথচলা।

(চলবে…) 

লেখক, মাওলানা আল আমীন শাহ (জিঝান, সৌদী আরব) 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *