সচেতনতা। সাঈদা সুলতানা
প্রসঙ্গ ডে-কেয়ার সেন্টার, কর্মজীবীর ভরসা
দেশসেবায় নারীর অংশগ্রহণ ও অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে রোল মডেল। সরকারি, বেসরকারি চাকরি থেকে শুরু করে দেশের সকল কর্মক্ষেত্র- পুলিশ, সামরিক বাহিনী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, গার্মেন্টস, কৃষি, শিক্ষা, ব্যবসা, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজকর্ম, ক্রীড়াঙ্গন, সাংস্কৃতিক-অঙ্গন, সাংবাদিকতা, এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে নারীর প্রত্যক্ষ অবদান নেই। এইতো সেদিন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র নাসায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মাহজাবীন হক। এমনি আরো অংসখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে আমাদের চারপাশে।
দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও নারী শিক্ষা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে নারীর ক্ষমতায়ন বেড়েছে। এর ফলে কর্মজীবী মায়ের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সকল নারীতো বটেই, একজন কর্মজীবী নারীও যখন মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহণ করেন তখন তার আনন্দের সীমা থাকে না। কিন্তু সেই আনন্দের সঙ্গে মিশ্রিত থাকে সবার আগে সন্তানের জন্য ভয়, উদ্বেগ। উদ্বেগের মূল কারণ হলো বাচ্চাকে কোথায় রেখে অফিসে যাবেন। পৃথিবীর সকল অর্জন একজন কর্মজীবী নারীর ভা-ারে জমা হলেও তার এই পিছুটান থেকেই যায়, কারণ তিনি একজন মা।
বিশেষ করে, তার শিশু সন্তানটির গোসল, খাওয়া, ঘুমানো, পড়ালেখা, হোমওয়ার্ক-এ নিয়ে সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা থাকে মার। মাতৃত্বকালীন ৬ মাসের ছুটি শেষ হওয়ার সাথে সাথেই শুরু হয় শিশু সন্তানটিকে লালন-পালন করার কঠিন সময়। সংসারের স্বামী সন্তানকে রাখার ক্ষেত্রে সময় দিতে পারেন না সংগত করণেই। অনেক কর্মজীবী মা সন্তানকে রাখার জন্য তার বাবা-মা, শশুর-শাশুড়ি, ভাই-বোন, চাচা-মামা, খালা-ফুপুর দ্বারস্থ হন। যার এ সুযোগ নেই তাকে নির্ভর করতে হয় গৃহকর্মীর উপর। আবার এ যুগে বিশ্বস্ত গৃহকর্মী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার, আর যার সে ব্যবস্থাও নেই, তাদেরকে অবশ্যই অসহায় বলা যায়। তাই কর্মস্থল বা বাড়ির আশপাশে ডে-কেয়ার সেন্টার থাকলে কর্মজীবী মায়েরা চিন্তামুক্ত থাকতে পারতেন।
বাড়িতে ছোট শিশুর যখন তখন বিপদ হতে পারে। বাড়ির আশপাশে পুকুর, ডোবা থাকলেতো কথাই নেই। এছাড়া চুলার আগুন, গরম পানি, ধারালো জিনিস ইত্যাদি থেকে পদে পদে বিপদের আশঙ্কা থেকেই যায় শিশুর জন্য। তাই শিশুকে সার্বক্ষণিক একজন বিশ্বস্ত মানুষের তত্ত্বাবধানে রাখতে পারলে সবচেয়ে নিরাপদ থাকা যায়। আর আত্মীয় পরিজন না থাকলে ডে-কেয়ারই ভরাসা। অনেক মা আছেন সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবে শেষ পর্যন্ত চাকরিটাই ছেড়ে দেন।
ঊনিশ শতকের শুরুর দিকে বিশ্বের প্রথম ডে-কেয়ার সেন্টারটি গড়ে উঠেছিল ফ্রান্সে। তবে বাংলাদেশে ডে-কেয়ার সেন্টারের প্রচলন শুরু সত্তরের দশকে। বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর একটি এবং রাজধানী ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে বর্ধনশীল মেগাসিটিগুলোর মধ্যে অন্যতম। কিন্তু এখানে জনসংখ্যা বিবেচনায় রয়েছে ডে-কেয়ার সেন্টারের অপ্রতুলতা তারপর যেটুকু আছে তাও প্রচার ও পেশাদারিত্বের অভাবে ব্যাপকহারে এ সেবা কার্যক্রমের প্রসার ঘটানোও সম্ভব হয়নি।
বর্তমান সরকার কর্মজীবী নারীর অগ্রযাত্রা সুসংহত করতে ইতোমধ্যেই রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ব্যাপক কাজ করে যাচ্ছে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়াধীন মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের প্রকল্পের অধীনে দিবাকালীন সেবা প্রদানের জন্য ঢাকা শহরে নিম্নবিত্তদের জন্য ৭টি এবং মধ্যবিত্তদের জন্য ৪টি, মোট ১১টি ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। রাজস্ব বাজেটের আওতায় ঢাকায় ৭টি ও ঢাকার বাইরে ৫টি বিভাগীয় শহরে ৫টিসহ মোট ১২টি ডে-কেয়ার সেন্টার নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশুদের জন্য পরিচালিত হচ্ছে। সমাজসেবা অধিদফতরের শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের সংখ্যা ১টি। এছাড়া মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের আওতায় ঢাকা শহরে মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুদের জন্য ৬টি ডে-কেয়ার সেন্টার এবং জেলা পর্যায়ে শ্রমজীবী মায়েদের শিশুদের জন্য ১৪টি জেলা শহরে ১টি করে ডে-কেয়ার সেন্টার পরিচালিত হচ্ছে।
সারাদেশে আরও ৬০টি ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপনের কাজ প্রক্রিয়াধীন। মহিলাবিষয়ক অধিদফতর ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য একটি প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে। এর আওতায় ঢাকা মেট্রোপলিটন সিটিতে ১০টি এবং জেলা সদরে ১০টি মোট ২০টি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে।
বর্তমান সরকার মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়াধীন জাতীয় মহিলা সংস্থার অধীনে গার্মেন্টস ও কারখানার নারী শ্রমিকদের ১৩৫০ জন শিশুকে দিবাকালীন সেবা প্রদানের জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার কর্মসূচি চালু করেছে, যার বাস্তবায়নকাল জানুয়ারি ২০১৮- ডিসেম্বর ২০২০। এছাড়া, সরকার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ শহরের বড় বড় ভবনের নিচে একটি করে ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপনের প্রভিশন রাখতে প্রয়েজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে।
আমরা যদি জার্মানির বার্লিনের দিকে তাকাই-সেখানে বসবাসরত অভিভাবকদের শিশুদের ডে-কেয়ার সেন্টারে পাঠানোর জন্য বাড়তি কোনো টাকা দিতে হয় না। জার্মানির আরো কয়েকটি রাজ্য একই পথ অনুসরণ করতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার যদি অদূর ভবিষ্যতে কর্মজীবী মায়েদের সুবিধায় এমন উদ্যোগ গ্রহণ করে, তবে অবশ্যই তা একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হবে।
অপ্রতুলতা থাকার পরও কর্মজীবী মায়েদের শিশুদের কথা বিবেচনা করে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারিভাবেও দেশে বিশেষ করে ঢাকায় অনেক ডে-কেয়ার সেন্টার গড়ে উঠেছে। রাজধানীসহ সারাদেশে কর্মব্যস্ত বাবা-মার উদ্বেগহীন অফিস করার জন্য ডে-কেয়ার সেন্টারগুলো অবশ্যই নির্ভরযোগ্য এবং প্রয়োজনীয় বলে প্রমাণিত হচ্ছে। অথচ এর সুফল আমরা অনেকই নানা কারণে ভোগ করতে পারছিনা। প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডে-কেয়ার সেন্টারের অপ্রতুলতার পাশাপাশি যানবাহনের অপ্রতুলতাও ডে-কেয়ার সেন্টারের সুযোগ গ্রহণ করতে না পারার পেছনে একটি বড় কারণ।
গার্মেন্টস কারখানার শ্রমিকদের ছেলে-মেয়েসহ শহরের দরিদ্র পরিবারের শিশুদের জন্য ডে-কেয়ার, স্কুলপূর্ব শিক্ষা ও প্রি-স্কুল সেন্টার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে সংস্থা ইউনিসেফ। সরকারের নীতিমালার আওতায় বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ সংশোধনীতে ৯৮ ধারায় শিশু-কক্ষ বিষয়ক আইন যুক্ত করা হয়। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, একটি অফিসে ৪০ জন বা এর অধিক নারী কর্মরত থাকলে এবং তাদের ছয় বছরের কম বয়সী শিশু সন্তান থাকলে তাদের সুবিধার্থে কর্মক্ষেত্রে একটি শিশু-কক্ষ স্থাপন করতে হবে। রাজধানী ঢাকায় বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ডে-কেয়ার সেন্টারের মধ্যে রয়েছে দরিদ্র শিশুদের জন্য মারিয়া ক্রিস্টিনা ফাউন্ডেশন, তৈরি পোশাক কারখানায় কর্মরত মায়েদের শিশুদের জন্য ফুলকি, মধ্যবিত্তদের জন্য ঢাকার বনশ্রী এলাকায় আছে চাইল্ড চিয়ার ইত্যাদি।
শিশুকে ডে-কেয়ার সেন্টারে রাখলে এর অনেক সুফলও রয়েছে। ডে-কেয়ার সেন্টারে অবস্থান করায় শিশুর সামাজিক দক্ষতা বাড়ে। ডে-কেয়ার সেন্টারে যাওয়ার ফলে পরিবারের বাইরের অন্যান্য শিশু ও অভিভাবকদের সঙ্গে মেলামেশার মাধ্যমে শিশু অনেক কিছু শিখতে পারে। তার সামাজিক দক্ষতা এবং অন্যের সাথে মেলামেশার দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
কর্মক্ষেত্র ছাড়াও কর্মজীবী মায়েরা যে জায়গায় বসবাস করেন, তার আশেপাশে পাড়া-মহল্লায় ব্যাপক হারে ডে-কেয়ার সেন্টার গড়ে তোলা জরুরি। কর্মক্ষেত্রে ডে-কেয়ার সেন্টারে সন্তানকে রাখতে মা যেমন সময় পেলেই শিশু সন্তানকে দেখাশোনার সুযোগ পাবেন, তেমনি বাসস্থানের পাশে ডে-কেয়ার সেন্টারে হলে সময় সুযোগে বাবাসহ নিকট আত্মীয়রাও শিশুর খোঁজখবর নিতে পারবেন।
সৎ, সাহসী, পরিশ্রমী যে কোনো ব্যক্তিই হতে পারে ডে-কেয়ার সেন্টারের একজন সফল উদ্যোক্তা। ডে-কেয়ার সেন্টারের প্রধান কাজ হচ্ছে শিশুর পিতা-মাতার আস্থা ও বিশ্বস্ততা অর্জন করা। শিশুদের পরিচ্ছন্ন রাখা, প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা, সুষম খাবার প্রদান, প্রাকস্কুল শিক্ষা প্রদান, ইনডোর খেলাধুলা ও চিত্তবিনোদনের সুবিধা প্রদানের পাশাপাশি তাদের শিষ্টাচার, পরিবেশ ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জ্ঞান প্রদান করা এবং শিশুদের মাতৃস্নেহে লালন-পালন করার সুবন্দোবস্ত করতে হবে এসব ডে-কেয়ার সেন্টারে। এছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথেও পরিচয় করিয়ে দিতে হবে তাদের শিশুকাল থেকেই। সেবাধর্মী এই ব্যবসা স্বল্প পুঁজিতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে গড়ে তোলা সম্ভব। এতে করে একটি ডে-কেয়ার সেন্টারে একাধিক লোকের কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হবে। দেশের অর্থনীতিতেও তা অবদান রাখতে সক্ষম হবে।
সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি মালিকানায় ঘনবসতিপূর্ণ পাড়া-মহল্লায় তৈরি করতে হবে বিশ্বস্ত ডে-কেয়ার সেন্টার, গড়ে তুলতে হবে সামাজিক বিপ্লব। পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলোর মতো সেবার মানে থাকতে হবে পেশাদারিত্বের ছোঁয়া। তবেই কর্মজীবী নারীদের অগ্রযাত্রায় সংসার ও সন্তান অন্তরায় না হয়ে তারা থাকবে সহায়ক ভূমিকায়। নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠিত হবে আরো সফলভাবে। এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ আরো অনেক বেশি অপ্রতিরোধ্য গতিতে। বিশ্ব তাকিয়ে দেখবে এ দেশের কর্মজীবী নারীদের দুর্দমনীয় অগ্রযাত্রা।
লেখক : কলামিস্ট