ফেরা | হানজালা ফিদা
ঘড়ির কাঁটা তখন ২.৩৮ এর ঘরে। আরিফুল বাড়ান্দায় এসে তখন লাইটার দিয়ে সিগারেটে আগুন ধরালো, এক হাত গ্রিলে রেখে সুখ টানদেয়। ওর সামনা সামনি তৃতীয় তলার বারান্দা থেকে হাসনাহেনা ফুলের গন্ধ ভেসে আসে। গলির মাথা থেকে একদল যুবক তরুণ গানের সুরে মানুষকে ঘুম থেকে জাগাতে ডাকছে। “উঠ হে মমিন ভাই, এগার মাস পরে এলো মাহে রমযান, ঘুমানোর আর যে সময় নাই” দলটা ডাকতে ডাকতে ওর সামনে দিয়ে চলে যায়। বাড়ান্দা থেকে যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণ তাকিয়ে থাকে, মনেমনে ভাবে আজ কত রমযান? তিনদিন পর বেতন দিবে ঈদের কেনাকাটা করে ফেলতে হবে। মা, বাবা, ভাই, বোন, ভাগিনা, দাদুর জন্য কী কী কিনবে তা আগেই মনে মনে ঠিক করে রেখেছে।
সকালে উঠে অফিসে যেতে হবে তাই সিগারেট আগুন ফেলে তাড়াতাড়ি বিছানার দিকে পা বাড়ালো। চোখ বন্ধ করে ঘুমুতে চেষ্টা করলো অন্য দিন শুলেই ঘুম চলে আসে আজ তা হচ্ছে না। বার কয়েক এপাশ ওপাশ করলো, হঠাৎ চোখের মাঝে ভেসে উঠলো একটা স্মৃতি, কাশের থালাবাটিতে পিটিয়ে একদল তরুণ পরিচিত একটা অন্ধকার পথে ডেকে চলছে। “উঠে যান মা বোন আর ঘুমানোর সময় নাই” চোখ বন্ধ করেই চিনতে চাইলো সামনের সেই তের চৌদ্দ বছরের ছোট্ট ছেলেটিকে। খুব চেনা চেনা লাগছে, কিছুক্ষণ পর চিনতে পারলো সেতো আরিফ নিজেই তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়তো। ওর গানের গলা ভালো ছিলো বলে সবাই ওকে সামনে সামনে রাখতো। গাইছে “এগারো মাস পরে মুসলমানের ঘরে এলো মাহে রমযান” আরিফ ঘোরের মাঝেই গাইতে থাকে “এগারো মাস.., নিজের কণ্ঠস্বরে নিজেরি ঘুম ভেঙে যায়।
আরিফ ঢাকা এসেছে প্রায় নয় বছর আগে ঢাকা ভার্সিটিতে সুযোগ পাবার সুবাদে। কিভাবে কেটে গেলো এতগুলো বছর! এখন বে সরকারি একটা ফার্মে চাকরি করে, মাইনেও ভালো পায়, প্রায় আটত্রিশ হাজার ওভারটাইমে প্রায় পঞ্চাশে পৌঁছে। ভার্সিটিতে চান্স পাবার পরপরই একটা বাম রাজনৈতিক দলের সাথে ভিড়ে যায়। তারপর লেলিন, স্টেলিন, চেগুয়েভারা মাথায় এভাবে পুশকরা করা হয় যে নিজের ঐতিহ্য, নিজস্বতাবোধ এক সময় সব কিছু ফিকে হয়ে যায়। আস্তে আস্তে নামায রোযা থেকে কিভাবে যেন একটা দূরত্ব বজায় রাখে। রোযা শেষবার কত বছর আগে রেখেছিলো তাও মনে মেই। নামায বলতে ঈদের নামায, বাড়িতে গেলে ঈদগাহে না গেলে বন্ধুরা লজ্জা দিবে তাই যাওয়া হয়।
আরিফের মনে পড়ে যায় এসএসসি পরীক্ষার আগে এপ্লাস পেলে পাঁচটা রোযার মান্নত করেছিলো। এপ্লাস পাবার পর আরিফ দুইটা আর ওর মা রেখে দিয়ে ছিলো তিনটা রোযা। আরিফ যখন ছোট ছিলো তখন বাড়ি থেকে রোযা রাখতে দিতে চাইতো না। কিন্তু ওর বন্ধু শফিকের সাথে পাল্লা দিয়ে রোযা রাখতো কে কয়টা রোযা রাখতে পারে। একরাতে সাহরিতে ডাক না দেয়ায় সেকি কান্না! আরিফ কিছু না খেয়েই রোজা রাখলো, মা মেরেও রোযা ভাঙ্গাতে পারলো না। আারিফ আর শফিক নিয়মিত তারাবিও পড়তো। একবার শফিক তারাবির নামাযে সেজদায় যেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। নামাযের শেষে ওকে ডাকা হলো, আরিফ সেকথা মনে করিয়ে দিয়ে ক্ষেপাতো।
শফিক আজ নেই, দুবছর আগে ক্যানসারে মারা গেলো। ওর তিন বছরের একটা মেয়ে রেখে গিয়েছিলো। এই কথা মনে হতেই আরিফের চোখ ভিজে গেল। ওর এখন ভালো লাগছে না আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। পশ্চিম আকাশে তখন একটা মস্তবড় চাঁদ জ্বলজ্বল করছে। হাজিপাড়া ঝিলমসজিদের মাইকে মুয়াজ্জিন তখন বলছেন – সাহরি খাবার সময় শেষ হতে আর দুই মিনিট বাকী। কতদিন মাইকে এই আওয়াজ, যুবকদের ডাকাডাকি কত বিরক্ত লাগতো। মাঝে মাঝে মন চাইতো……।
আজ আরিফের অন্য রকম লাগছে যেন ওর ভেতর একটা ঝড় বয়ে চলছে, কী করবে যেন ভেবে পাচ্ছে না! সুবহে সাদিকের এক পশলা শীতল জান্নাতি হাওয়া এসে হৃদয় শরীর জুড়িয়ে দিলো। শেষ মুহূর্তে রুমে ঢুকে জগ থেকে দুই গ্লাস জল খেয়ে নিলো। রোজা রাখার আরবি নিয়তটা আরিফের মনে নেই, বহু চেষ্টা করেও নিয়তটা মনে করতে পারলো না। আরিফ ভাবলো, নামাযের পর ইমাম সাহেবের কাছ থেকে জেনে নেয়া যাবে এই ভেবে মসজিদের দিকে রওনা হয়ে গেলো।