সৌর শাইন : বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বৃহৎ অংশ নারী। বর্তমানে এ দেশের কৃষি-শিল্প ও অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অবস্থান সুদৃঢ়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে বাংলাদেশের নারীরা ক্রমান্বয়ে উন্নতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। তাছাড়া নারী উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকার বরাবরই ইতিবাচক অবস্থানে রয়েছে, যা ইতোমধ্যে সারাবিশ্বে প্রশংসা কুড়িয়েছে।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০১৬ অনুযায়ী, ১৪৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭২তম। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের চেয়ে এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভাল অবস্থানে রয়েছে। অন্যদিকে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ, যা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য গর্বের বিষয়। জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা নারী উন্নয়নে বাংলাদেশের এ অবস্থানের ব্যাপক প্রশংসা করেছে।
এতদ্সত্ত্বেও বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের নারী সমাজকে আরো অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিতে হবে। নারীর মৌলিক অধিকার ও সামাজিক আরো বেশি সম্মান নিশ্চিত করতে হবে।
নারীর নিরাপত্তার দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশ নারীবান্ধব রাজনৈতিক ক্ষমতা বলয়ে থাকলেও নারীর পূর্ণ নিরাপত্তা এখনো ঝুঁকির মুখে। ঘরে-বাইরে নারীর পথচলা এখনো শতভাগ নিরাপদ নয়। পুরুষদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নারী লাঞ্ছনার ক্ষেত্রে অভিযোগের আঙুল বরাবরই পুরুষদের প্রতি একটু বেশি। নারীর প্রগতির পথে এ সমস্যা সমাধানে পুরুষের সুষ্ঠু ইতিবাচক মানসিকতার বিকল্প নেই। নারীর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাই কেবল পারে নারী-পুরুষের মধ্যে সুন্দর সহাবস্থান গড়ে তুলতে। পথ-ঘাট, যানবাহন, কর্মস্থল, ঘরসহ সকল পর্যায়ে নারীর জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হলেই নারী ও পুরুষের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব হবে।
পাশাপাশি, নারীর অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় দেখা যায়, পরিবারে নারী সাধারণত পুরুষদের উপর নির্ভরশীল। আমাদের দেশে বেশির ভাগ পরিবারেই এটি দৃশ্যমান। উচ্চবিত্তের মধ্যে সংখ্যাটা সীমিত হলেও, মধ্য ও নিম্নবিত্ত পরিবারে খুবই স্বাভাবিক বিষয় এটি। নারী সার্বিকভাবে পিতা-স্বামী-সন্তান কিংবা অন্য কারোর উপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল, যা নারীর স্বাধীনতা ও মানসিক শক্তিমত্তার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া নারী কোনো না কোনোভাবে হীনমন্যতার শিকার হবেই। পরিবারে নারীর স্বাধীন চাওয়া পাওয়ার অধিকার বরাবরই সীমিত, কিংবা পুরুষের মননকেন্দ্রিক, যা নারীকে মানসিকভাবে যথেষ্ট দুর্বল করে রাখে, পরনির্ভশীলতার ছাপ থাকে তাদের মুখে।
এ সমস্যা সমাধানে নারীর কর্মসংস্থান বৃদ্ধি প্রয়োজন। স্বনির্ভর উপার্জনক্ষম নারী আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন জীবনযাপনে নিজেকে গড়ে তুলতে পারে। অর্থনীতিতে নারীর পূর্ণ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে পারলে, নারীকে কারো কাছে দয়া গ্রহীতা হয়ে থাকতে হবে না। প্রতিকূলতার সাথে তাদের প্রতিযোগিতা করতে হবে। আর প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগটা পুরুষকেই তৈরি করে দিতে হবে। আপন কর্মপ্রতিভা বিকাশের জন্য তাদের পূর্ণ সুযোগ প্রয়োজন। দেশের অর্থনীতিতে নারীর ভূমিকা রাখার জন্য প্রয়োজন সুষম পরিকল্পনা যাতে বাংলাদেশের নারীরা আপন শক্তিতে বলীয়ান হয়ে আরও এগিয়ে যেতে পারবে।
আবার নারীশিক্ষার প্রকৃত অবস্থা বিবেচনায় দেখা যায় সরকার বর্তমানে নারীশিক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়ায় নারীশিক্ষার প্রসার অতীতের তুলনায় অনেকটা বেড়েছে। কিন্তু শিক্ষার পরিধি প্রাথমিক, নিম্ন মাধ্যমিক কিংবা সর্বোচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত গড়ায়। পারিবারিক সিদ্ধান্তে অনেক কিশোরীকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় যা নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়। বাল্য বিবাহকে কঠোরভাবে ও সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে রোধ করতে হবে। নারীর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অবশ্যই তাকে উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে হবে এবং এর সঠিক প্রয়োগ ঘটাতে হবে। নারীকে তার অর্জিত শিক্ষাগত যোগ্যতার মাধ্যমে কর্মস্থলে প্রবেশ করতে হবে এবং প্রবেশ করার সুযোগ এবং অগ্রগতির পথ নিশ্চিত করতে হবে।
নারীর জন্য চিকিৎসাসেবা শতভাগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সমাজের একটি চাকা অচল কিংবা অকেজো অবস্থায় থাকলে কখনোই ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া যাবে না। গর্ভবতী মায়ের প্রতি পরিবার থেকে বিশেষ যতœ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি বিশেষ উদ্যোগের পাশাপাশি আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার বিশেষ প্রয়োজন। ইতোমধ্যে বেশ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে সেগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। অন্যদিকে কিশোরী মেয়েদের শারীরিক সচেতনতা ও চিকিৎসার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। তথ্যচিত্রের মাধ্যমে বয়ঃসন্ধিকালীন সতর্কতা ও এ বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদানের উদ্যোগ আরো জোরদারভাবে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।
শহর এবং শহরের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে নারীরা এগিয়ে গেলেও দেশের প্রান্তিক অঞ্চলের নারীরা শহরের তুলনায় এখনও অনেক পিছিয়ে। তারা সামাজিক কুসংস্কারের শিকার হয়ে আরো বহুদূর পিছিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও সমাজের নানা স্তরে রয়েছে নারীর অগ্রগতির পথে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা। এসব সামাজিক প্রতিবন্ধকতা সমাজের সর্বস্তর থেকে উপড়ে ফেলতে না পারলে নারীর প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব হবে না। দলমত, ধর্ম, সম্প্রদায় নির্বিশেষে পুরো দেশকে সমন্বিতভাবে নারীর উন্নয়নে এগিয়ে আসতে হবে। শহর ও গ্রামের সর্বস্তরে সুষমভাবে সুপরিকল্পিত উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে হবে।
সরকারের পাশাপাশি নারীর উন্নয়নে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে। নারী ও পুরুষের লক্ষ্য হওয়া উচিত প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা করা, একে অপরের বিরুদ্ধে নয়। নারী-পুরুষের সম্পর্ক সহযোগিতা ও সৌহার্দ্যমূলক হওয়া আবশ্যক। এতে সকলেরই মঙ্গল।
নারীর শিক্ষা ও কর্মসংস্থান সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব হলে, তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে। এর ফলে নারী পরিবারের বোঝা হয়ে থাকার পরিবর্তে আত্মনির্ভলশীল হবে। সেইসাথে স্বাধীন মানসিকতা ও স্বাতন্ত্র্যবোধ নারীকে চিন্তার স্বাধীনতা প্রদান করবে। মনে রাখা উচিত, যে কোনো জাতি চিন্তার ক্ষেত্রে স্বাধীন না হলে সংকীর্ণ মানসিকতাকে যুগের পর যুগ ভুগতে থাকবে। তাই আমাদের নারীর স্বাধীন চিন্তার ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : কলামিস্ট