বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামা কী ও কেন!

বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামা কী ও কেন!

মাওলানা আব্দুর রহিম কাসেমী : ওয়ালি উল্লাহি দর্শনের আলোকে আকাবিরের চিন্তা লালানকারী সংগঠন হিসেবে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের আদর্শ সিক্ত সংগঠন হচ্ছে বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামা। এর পরিচয় এবং গুরুত্ব হিসেবে জানতে হলে একজন আলেম হিসেবে নিজের পরচিয় জানা আবশ্যক। আজকের প্রেক্ষিতে বাঙলাদেশ জমিয়তুল উলামার বিকল্প নেই। একজন আলেমের পরিচয় ও বাস্তব অবস্থান হলো যে, আল্লাহ এবং তার রাসূল সা. প্রদত্ত পরিচয় তা হচ্ছে, ওয়ারিসে নবী। তার দায়িত্ব অনেক বড় এবং বিস্তৃত,তাই তার সকল কর্মকান্ড এ পরিচয়কে ঘিরেই হতে হবে। ভারত উপমহাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দীর্ঘ সময় অর্থাৎ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া পূর্ব পর্যন্ত এ দেশে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের কোনও ধারাবাহিকতা গড়ে ওঠেনি।তবে বাঙলাদেশ স্বাধীন পরবর্তী সময়ে ফিদায়ে মিল্লাত আসআদ মাদানী রহঃ বাংলাদেশের প্রক্ষিতে জমিয়তের ধারাবাহিকতা গড়ে তুলেছিলেন জমিয়তে উলামা নামে।যার সভাপতি ছিলেন শায়খ তাজাম্মুল আলী রহ. এবং সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন শায়খ আহরারুজ্জামান রহ.। কিন্ত দুর্ভাগ্যবশত অনিবার্য কারণে জমিয়তের কার্যক্রম দীর্ঘস্হায়ী হতে পারেনি।পরবর্তীতে ২০১৪ সালে জানেশীনে ফিদায়ে মিল্লাত, রাহবারে উম্মাত, কুতুবে বাঙাল,শায়খুল হাদীস আল্লামা ফরীদ উদ্দিন মাসউদ তারই ধারাবাহিকতায় গড়ে তুলেন বাঙলাদেশ জমিয়তুল উলামা। আজ বিশ্বব্যাপী বাঙলাদেশ জমিয়তুল উলুম সুপরিচিত। এর আবেদন সুদূরপ্রসারী। তাই এর ভিত্তিতেই বাঙলাদেশ জমিয়তুল উলামার গুরুত্ব অপরিসীম। বাঙলাদেশ জমিয়তুল উলামার গুরুত্ব বুঝতে হলে একজন আলেম হিসেবে তার পরিচয় ও অবস্থান সম্পর্কে জানতে হবে এবং এ বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। একজন আলেমের খোদা ও রাসূল প্রদত্ত পরিচয় যেহেতু ওয়ারিসে নবী তাই একজন আলেমের পরিচয় ও কর্মকান্ড হবে এটিকে ঘিরেই। এর বাইরে যাওয়ার এর বাইরে চলার কোনই অবকাশ নেই।

একজন ওয়ারিসে নবীর মূল দায়িত্ব হলো ‘ফিকরে উম্মত’ এবং সমাজের সর্বত্র অনাবিল সুখ শান্তির প্রচার।আর তার এ দায়িত্বের বুনিয়াদ এবং অবলম্বন কি হবে! তা জানতে হলে অবশ্যই তাকে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের চেতনা এবং ওয়ালিউল্লাহি দর্শনের মৌলিক দিকগুলো অাবশ্যিক জানতে হবে।আমরা জানি ওয়ালিউল্লাহি দর্শনের মৌলিক দিক দু’টি। যা তিনি উম্মতের সামনে পেশ করেছিলেন। একটি হলো, ইলমে ওহী’ তাই ইলমে অর্জনের সাথে সাথে এর ব্যাপকতর চর্চা ঘটাতে হবে। প্রত্যেকের দোরগোড়ায় এর শিক্ষা পৌঁছে দিতে হবে।দ্বিতীয়টি ছিল,ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে এবং বস্তুতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।মূলত শাহ আব্দুল আযীয দেহলভী রহ. আড়াই লাইনের সে ফতোয়ার মাধ্যমেই এ আন্দোলনের সূচনা করেন।পরবর্তীতে ইংরেজরা ভারত উপমহাদেশে তাদের আস্তানা সুসংহত করার জন্য বেপরোয়া হয়ে ওঠলে। একদিকে হাজার হাজার উলামায়ে কেরামকে শহীদ করার মধ্য দিয়ে ইলমে ওহীর চর্চায় দৈনত্য সৃষ্টির নগ্ন থাবা বিস্তার করতে শুরু করলো। অন্যদিকে সমাজ থেকে উলামায়ে কেরামের নেতৃত্বকে চিরতরে খতম করা এবং সাধারণ মানুষকে উলামায়ে কেরাম থেকে বিচ্ছিন্ন করার কুটতৎপরতা চালালো।ঠিক এমত অবস্থায় হুজ্জাতুল ইসলাম কাসেম নানুতবি রহ. ওয়ালী উল্লাহি দর্শনের প্রথম দিকটিকে তথা ইলমে ওহী চর্চার দর্শনকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দিলেন দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে।আর অন্যদিকে শায়খুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দি রহ. সাম্রাজ্যবাদীদের ষড়যন্ত্র এবং বস্তুতান্ত্রিক মানসিকতার বিরুদ্ধে গণ আন্দোলনের দর্শনকে সাংগঠনিক রুপ দিলেন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে।মৌলিকভাবে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের বুনিয়াদ ও অবলম্বন সমাজে উলামায়ে কেরামের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং হক্কানী উলামায়ে কেরামের সাথে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ত করার চেতনাই বাঙলাদেশ জমিয়তুল উলামার চেতনা।এরই প্রক্ষিতে এ অবলম্বনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে উত্তীর্ণ করার জন্যই আল্লামা ফরীদ উদ্দিন মাসউদ বাঙলাদেশ জমিয়তুল উলামাী যে দুটি লক্ষ্য স্হির করেছেন। তা মূলত কুরআন সুন্নাহর মেজায।তা মূলত আল্লাহ এবং রাসুল সা. এর নির্দেশনা।সে দুটি লক্ষ্য হলো নিজের সমঝকে (বুঝ) আকাবিরের সমঝের উপর ন্যস্ত করা।সকল কর্মকান্ড আকাবীর আসলাফের সমঝের আলোকে গ্রহণ করা।এটাই কুরআন সুন্নাহর মেজায। আর দ্বিতীয়টি হলো,সাধারণ মানুষকে হক্কানী উলাময়ে কেরামের সাথে সম্পৃক্ত করে তোলা।

একজন ব্যক্তি ওয়ারিসে নবী হিসেবে তার ক্ষেত্র হলো উম্মত। উম্মতকে যেমন তার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা ও রাখার দায়িত্ব তার।ঠিক তেমনিভাবে উম্মতের দ্বীন-ঈমানের হেফাযত এবং উম্মতের মাঝে শান্তি প্রচেষ্ঠার দায়িত্বও তার।অতএব কারণে এ দুটি লক্ষের বাইরে একজন ওয়ারিসে নবীর যাওয়ার সুযোগ নেই।বাঙলাদেশ জমিয়তুল উলামার উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি আলোকিত সমাজ গঠন করা। আর এ আলোকিত সমাজ গঠনের প্রত্যয় নিয়ে বাঙলাদেশ জমিয়তুল উলামা পুনর্গঠিত হয়েছে এবং যাত্রা শুরু করেছে। অর্থাৎ সমাজের প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে ঈমান, ইবাদাত, মুআমালাত, মুআশারাত, আখলাকের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন। এর জন্য কর্মসূচি হলো তিনটি: ১.দাওয়াত ২.তালীম.৩.ইনফাক ফি সাবীলিল্লাহ। একজন কর্মী একজন দায়ী উম্মতকে এ দাওয়াত দিবে যে আমার দ্বীনকে সহীহ করতে হলে। সঠিক দ্বীনের উপর চলতে হলে আমার সমঝকে আকাবীরের সমঝের উপর ন্যস্ত করতে হবে। এর বিকল্প নেই। রাসুল কারীম সা.বুঝ ও আমলের ক্ষেত্রে নিজের সমঝকে আল্লাহর সমঝের উপর ন্যস্ত করেছিলেন।

সাহাবায়ে কেরাম রা. রাসুল সা.-র সমঝের উপর তাদের সমঝকে ন্যস্ত করেছিলেন। দ্বীন বর্ণনা নির্ভর, যুক্তি নির্ভর নয়। অতএব কারণে, এ কথার দাওয়াত দিয়েই উম্মতকে আবার আকাবির ও আসলাফের কাতারে সামিল করতে পারলেই দ্বীন সহীহভাবে বুঝা এবং পালন করা সম্ভব হবে। সাথে সাথে যেহেতু দাওয়াতের দ্বারা জযবা পয়দা হয়। আবেগ তৈরী হয়।যা কখনও স্থায়ী হয়না। তাই দাওয়াত দিয়ে সাপ্তাহিক, পাক্ষিক এবং মাসিক তালীমের হালকা বসাতে হবে। রাসুলে কারীম সা. একদিকে যেমন দাওয়াত দিয়েছেন। অপরদিকে তালীমের হালকা গঠন করে তাদের মধ্যে যেহনিয়্যাত পয়দা করেছেন এবং আদর্শের উপরে তাদের দৃঢ়পদ করেছেন। অতএব বাঙলাদেশ জমিয়তুল উলামার দ্বিতীয় কর্মসূচি হচ্ছে তালীম। তৃতীয় কর্মসূচি হলো ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহ। ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহর দ্বারাই আল্লাহর মোহাব্বাত ক্বলবে পয়দা হয় এবং দুনিয়ার মোহাব্বাত দুরিভূত হয়। কৃপনতা দুরিভূত হয় ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহর মাধ্যমেই। কাজের প্রতি মোহাব্বত আল্লাহ ও রাসু্লের মোহাব্বত তথা দ্বীনের প্রতি মহাব্বতের জন্য একমাত্র অবলম্বন হচ্ছে অন্তর থেকে দুনিয়ার মোহাব্বত দূর করে আল্লাহ পাকের মোহাব্বত পয়দা করা।তাই বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামার তৃতীয় কর্মসূচি হচ্ছে, ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহ। এর মাধ্যমে দুনিয়ার মোহাব্বত বিদূরিত করে আল্লাহর মোহাব্বত গালেব করা। বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামা চায় যে,আবার সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং মানবতা প্রতিষ্ঠার সাথে সঙ্গে সমাজকে আল্লাহমুখী করা। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে এবং বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামাকে কবুল করুন। আমীন! ইয়া রাব্বাল আলামীন।

লেখক : মহাসচিব, বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামা

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *