বাংলার বরেণ্য আলেম মুফতী ছাঈদ আহমদ রহ.

বাংলার বরেণ্য আলেম মুফতী ছাঈদ আহমদ রহ.

মুফতী সালমান বিন মানসুর :  গত ২৩ এপ্রিল’১৮ ইং সোমবার দিনটি ছিল মুসলিম উম্মাহর জন্য বেদনাদায়ক দিন। সেদিন সকাল ৯ টা ৪০ মিনিটে এ ক্ষণস্থায়ী পৃথিবী ছেড়ে মাওলাপাকের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেলেন শাইখুল আরবে ওয়াল আজম কুতবুল আলম শাহ সোলতান আহমদ নানুপুরী রহ. এর শ্রেষ্ঠতম খলীফা, জামিয়া ইসলামিয়া সোলতানিয়া লালপোল ফেনী’র প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম ও শাইখুল হাদিস, পীরে কামেল, হাকীমুল ওলামা আল্লামা মুফতী ছাঈদ আহমদ রহ.।

তিনি ছিলেন আধ্যাত্মিক জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র, গাংগুহী সিলসিলার সমকালীন শ্রেষ্ঠ ধারক ও বাহক, আল্লর্জাতিক খ্যাতনামা মুফতী, বিশিষ্ট হাদীস বিশারদ, যুগ সচেতন সাহসী নির্ভীক দ্বীনের কা-ারী, সুন্নতে রাসূল সা. এর মূর্তপ্রতীক, অনন্য তাকওয়া-পরহেজগারী ও বহুগুণের অধিকারী বিশিষ্ট বুযুর্গ ব্যক্তিত্ব। তিনি মানুষকে শরীয়তের সঠিক দিক নির্দেশনা দেয়ার পাশাপাশি হাজার হাজার পথহারা মানুষকে সঠিক পথের দিশা দিয়ে যান। আল্লাহভোলা বান্দাদেরকে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক করার মেহনতে রত ছিলেন আজীবন। তাঁর মৃত্যুতে দ্বীনের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে জান্নাতের উচ্চ মাকাম জান্নাতুল ফেরদাউসের অধিকারী বানান। তাঁর অবর্তমানে দ্বীনী অঙ্গনে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা পূরণের জন্য তাঁর যোগ্য উত্তরসূরী তৈরী করে দিন। আমীন।

এ মহান ব্যক্তির অনুপম জীবন চরিত ছিল অনুকরণীয়। তাঁর বিস্তারিত জীবনী পত্রস্থ করার জন্য হাজার পৃষ্ঠাও যথেষ্ট নয়। বক্ষমান নিবন্ধে তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী পেশ করা হল।

জন্ম ও পরিচয়

আল্লামা মুফতী ছাঈদ আহমদ রহ. ১৯ চৈত্র- ১৩৫৪ বাংলা, রোজ শুক্রবার জুমার নামাযের পূর্বে ফেনী জেলার অল্লর্গত ছনুয়া গ্রামের এক দ্বীনদার সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হাজী এহসানুল্লাহ সওদাগর ও মাতার নাম আসিয়া।

জনৈক বুযুর্গের ভবিষ্যদ্বাণী

মুফতী সাহেব রহ. এর মাতা-পিতা উভয়েই ছিলেন আলেম-ওলামার প্রতি যথেষ্ট দুর্বল ও আল্লরিক। এজন্য সর্বদা কোনো আলেমকে তাঁদের ঘরে জায়গীর রাখতেন। অথচ তাঁদের ঘরে লেখাপড়া করার মত কোনো সল্লান ছিল না। সে হিসেবে মাওলানা কবীর আহমদ নামক একজন বুযুর্গ তাঁদের ঘরে জায়গীর থাকতেন। মুফতী সাহেব রহ. এর আবক্ষাজান উক্ত মাওলানা সাহেবসহ জুমার নামায আদায় করতে গেলেন। নামায শেষে বাড়িতে এসে নবাগত শিশুর কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলেন। তখন পুত্রসল্লান জন্মগ্রহণ করেছে জেনে উক্ত মাওলানা সাহেব বলেন, এ ছেলে হয়ত ভবিষ্যতে বড় আলেম হবে। পরবর্তীতে সে ভবিষ্যদ্বাণীটি ষোল আনাই বাস্তবরূপ লাভ করে।

শিক্ষা জীবন

মুফতী সাহেব রহ. এর ছোট বেলা থেকেই ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি অত্যল্ল আগ্রহ ছিল। তাঁর মাতা-পিতা তাঁকে জনৈক হিন্দু শিক্ষকের নিকট সোপর্দ করার শত চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। একটি স্কুলে তাঁকে ভর্তি করা হয়েছিল, স্বভাবগতভাবে স্কুলে তাঁর তন্ (শরীর) গেলেও মন যেতো না। এভাবে দু’বছর স্কুলে পড়ার পর তাঁকে স্থানীয় রহিমপুর মাদরাসায় ভর্তি করা হয়। মাদরাসার পড়া তাঁর স্বভাবের সাথে খাপ খাওয়ার কারণে মাদরাসায় ভর্তি করানোর সাথে সাথে পড়া লেখার প্রতি তাঁর আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। উক্ত মাদরাসায় তিনি জামাতে হাশতুম পর্যল্ল অধ্যয়ন করেন।

জামালপুর মাদরাসায় অধ্যয়ন

রহীমপুর মাদরাসায় জামাতে হাশতুম পর্যল্ল পড়ার পর তাঁর বিশিষ্ট উস্তাদ মাওলানা আব্দুল মতিন সাহেব তাঁকে মিরশ্বরাই জামালপুর মাদরাসায় ভর্তি করান। জামালপুর মাদরাসায় তিনি জমাতে দুওম পর্যল্ল অধ্যয়ন করেন। উল্লেখ্য যে, জামালপুর মাদরাসায় জামাতে সিউম পর্যন্ত ছিল। তাঁর খাতিরে জামাতে দুওম খোলা হয়েছিল। প্রতি পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করতেন। এমনকি তিনি জমাতে সিউমের (দ্বাদশ শ্রেণি) বছর এত্তেহাদুল মাদারিসিল কওমিয়া (বাংলাদেশ কওমী মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড) এর কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় সারা দেশের মধ্যে প্রথম হন।

তিনি জামাতে হাফতুমের বছর থেকেই নিয়মিত তাহাজ্জুদ নামায পড়তে অভ্যস্ত হন। জমাতে চাহারুমের বছর স্বপ্নে দেখলেন যে, কুতবুল আলম ইমামে রবক্ষানী পটিয়ার মুফতী আজিজুল হক সাহেব রহ. তাঁকে শাইখুল মাশায়েখ হযরত শাহ সোলতান আহমদ নানুপুরী রহ. এর হাতে তুলে দেন। এজন্য তিনি চাহারুমের বছর নানুপুরী হযরত রহ. এর হাতে বাইআত হন।

জামালপুর মাদরাসা থেকে বিদায় নিয়ে পটিয়া মাদরাসায় যাওয়ার সময় এই প্রিয় ছাত্রটিকে মাদরাসার মুহতামিম সাহেবসহ মাদরাসার সকল ছাত্র-শিক্ষক জামালপুর মাদরাসা থেকে দেড় মাইল দূরে ‘চিনকি আস্তানা’ নামক রেল স্টেশনে এগিয়ে দিতে আসেন। স্টেশনে কান্নাকাটির রোল পড়ে যায়। যার কারণে রেলগাড়ি ছাড়তেও বিলম্ব হয়।

পটিয়া মাদরাসায় অধ্যয়ন

তাঁর একান্ত উস্তাদ মাওলানা আব্দুল মতীন সাহেব তাঁকে সাথে নিয়ে পটিয়া মাদরাসায় ভর্তি করালেন। বোর্ডের পরীক্ষায় ১ম স্থান অধিকার করায় মাদরাসা কর্তৃপক্ষ তাঁর ভর্তি পরীক্ষা নেননি। পটিয়া মাদরাসায় যে সকল বিভাগ রয়েছে অর্থাৎ মুনাযারা বিভাগ, মুশাআরা বা কবিতা রচনা বিভাগ, আরবি সাহিত্য বিভাগ ও উর্দূ সাহিত্য বিভাগসহ প্রত্যেক বিভাগের পরিচালকগণ তাঁর নাম নিজেদের বিভাগে লিপিবদ্ধ করে ফেলেন। উপর্যুক্ত প্রত্যেক বিভাগেই তিনি যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন। মুনাযারা বিভাগের যিম্মাদার তাঁর মুনাযারা করার যোগ্যতা দেখে তাঁকে ‘সাইয়্যেদুল মুনাযিরীন’ উপাধি দেন। বার্ষিক মুনাযারা ও কবিতা রচনা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করে পুরস্কৃত হন।

পটিয়া মাদরাসায় তিনি দু’বছর অধ্যয়ন করেন। প্রথম বছর ফুনুনাতে আলিয়া পড়েন। ফুনুনাতের কিতাব ‘কাজী হামদুল্লাহ’ পড়েছেন খতীবে আযম আল্লামা সিদ্দীক আহমদ রহ. এর নিকট। তিনি কয়েকদিন পড়ানোর পর মুফতী সাহেবের যোগ্যতা অনুমান করতে পেরে বলেন, আমাকে আর পড়াতে হবে না। আগামীকাল থেকে তুমি কিতাব দেখে এসে অর্থসহ বলবে আর আমরা শুনব। মোল্লা জালাল নামক কিতাব পড়েছিলেন ফকীহুল মিল্লাত মুফতি আবদুর রহমান রহ. এর নিকট। উক্ত কিতাব খারেজী ঘণ্টায় তিনি একাই পড়েছিলেন। ফুনুনাতের বছরও প্রত্যেক পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন।

মুফতী সাহেব রহ. এর ছোট বেলা থেকেই তাঁর প্রতি ছিল নানুপুরী হযরত রহ. এর নেক দৃষ্টি ও তাঁকে গড়ার ফিকির। ফুনুনাতের কোর্স সমাপ্তির শেষের দিকে নানুপুরী হযরত রহ. মুফতী সাহেব রহ. এর নিকট চিঠি পাঠিয়ে রমযানের শেষ দশদিন নানুপুর মাদরাসায় তাঁর সাথে ইতিকাফ করার জন্য মুফতী সাহেবকে নিয়ে যান। উক্ত দশদিনে নানুপুরী হযরত রহ. এর তাওয়াজ্জুহ, নসীহত, যিকির-আযকার ইত্যাদি দ্বারা তাঁর উপর অত্যন্ত প্রভাব পড়েছিল। একদা তিনি বলেছিলেন, ঐ দশদিনের সোহবতে এ রকম রূহানী তরক্কী অনুভব হয়েছিল যে, দশ বছরের সোহবতেও এরকম হয় না। এমনকি এর প্রভাব শরীরের মধ্যেও পড়েছিল, যার ফলে ছয়মাস পর্যন্ত তাঁর মুখের রুচি নষ্ট ছিল।

ফুনুনাত পড়ার পর জমাতে উলায় ভর্তি হন। উক্ত জমাতে মিশকাত শরীফ প্রথম খণ্ড পড়েন আল্লামা দানেশ রহ. এর কাছে। তিনি মুফতী সাহেব রহ. কে তাঁর অনুপম চরিত্র ও যোগ্যতার কারণে খুবই ভালবাসতেন। আর ঘণ্টার মধ্যে তাঁকে নিজের সামনেই বসাতেন। ঘটনাক্রমে একদিন তিনি পেছনে বসলে তাঁকে সামনে এনে বললেন, তুমি সব সময় আমার সামনেই বসবে। কেননা তুমি সামনে না থাকলে আমার পড়ানোর স্পৃহা জাগে না।

মুফতী সাহেব রহ. মিশকাত শরীফ তাকরার করতেন। আল্লামা দানেশ রহ. তাঁর তাকরার শুনে বলতেন, আমার মনমত যোগ্য আলেম দক্ষিণ দিকে একজনকে পাঠিয়েছি, পূর্ব দিকেও একজনকে পাঠিয়েছি। কিন্তু পশ্চিম দিকে পাঠানোর জন্য কাউকে খুঁজে পেলাম না। আশা করি আল্লাহ তাআলা তোমার দ্বারা আমার মনের আশা পূরণ করবেন। অতঃপর তিনি ছাত্রদেরকে মুফতী সাহেব রহ. কে মুহাদ্দিস সাহেব বলার জন্য হুকুম করেন এবং নিজেও মুহাদ্দিস সাহেব বলে ডাকতেন।

মুফতী সাহেব হুযুর রহ. হিদায়া তৃতীয় খণ্ড পড়েন মুফতী ইবরাহীম রহ. এর নিকট। তিনি যেদিন সবক শুরু করেন সেদিন সকল ছাত্র থেকে ইবারত পড়া শুনে বলেন, ছাঈদ আহমদ তুমিই সারা বছর ইবারত পড়বে। তাঁর কথামত সারা বছর তিনিই ইবারত পড়েন।

তিনি হিদায়াও তাকরার করতেন। জমাতের মধ্যে মোট তিনটি ফরীক বা গ্রুপ ছিল। মুফতী সাহেব তাকরার শুরু করার পর তাকরারের সব ফরীক ভেঙে গিয়ে এক ফরিক হয়ে যায়। অন্য ফরীকে যারা তাকরার করতো তারাসহ সবাই তাঁর তাকরার শুনার জন্য একত্র হত।

জামাতে উলা পড়ার পর কয়েকজন ওস্তাদের পরামর্শে তিনি হাদীস পড়ার জন্য পাকিস্তানে আল্লামা ইদ্রীস কান্দলভী রহ.এর নিকট যাওয়ার মনস্থ করলেন। হযরতজী রহ. এর আবক্ষাও তাতে সম্মতি দিলেন। আবার পটিয়া মাদরাসার তৎকালীন মুহতামিম হাজী ইউনুস সাহেব রহ. থেকে অনুমতিও নিয়ে নিলেন। তারপর ১৯৭০ ইং উভয় পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচন এল। নির্বাচনে মুসলিম লীগ তথা বাঙালি বিজয় লাভ করে।

হযরতজী রহ. এর আবক্ষা আলেম না হলেও খুব বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ভাবলেন পশ্চিম পাকিস্তানীরা বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা দিবে না, এ কারণে দেশ বিভক্তির আশংকা রয়েছে। তাই তিনি হযরতজীকে পাকিস্তান যেতে নিষেধ করে দিলেন।

হাটহাজারী মাদরাসায় অধ্যয়ন

তারপর কতিপয় ব্যক্তি হযরতজী রহ. কে পরামর্শ দিলেন যে, আপনি যেহেতু পটিয়া মাদরাসা হতে ছুটি নিয়ে এসেছেন, আর সেখানকার বুযুর্গদের থেকে বরকত হাসিল করেছেন, এখন মাদরে ইলমী হাটহাজারী মাদরাসায় ভর্তি হয়ে সেখানকার বুযুর্গদের থেকেও বরকত নিলে ভালো হয়। কথাটি হযরতজী রহ. এর নিকট যুক্তিযুক্ত মনে হওয়ায় তিনি হাটহাজারী মাদরাসায় ভর্তি হয়ে গেলেন। অল্প দিনেই হযরতজী রহ. হাটহাজারী মাদরাসার সেরা ছাত্র হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় দাওরায়ে হাদীস জামাতে তাঁর ক্রমিক নং প্রথম হলো। স্বাধীনতা যুদ্ধের গোলযোগের কারণে সে বছর ২য় সাময়িক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। যুদ্ধ চলার কারণে বার্ষিক পরীক্ষা পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। ঐ পরীক্ষার ফলাফল হযরতজী রহ. জানতে পারেননি। তিনি বুখারী শরীফ শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা আব্দুল কাইয়ূম সাহেব রহ., মুসলিম শরীফ হযরত আল্লামা মুফতি আহমাদুল হক রহ., তিরমিযী শরীফ শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা আব্দুল আযীয সাহেব রহ., আবু দাউদ শরীফ হযরত মাওলানা হামেদ সাহেব রহ., নাসাঈ ও ত্বাহাবী শরীফ তানযীমুল আশতাতের লেখক হযরত আল্লামা আবুল হাসান সাহেব রহ., মুয়াত্তা মালেক শাইখুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী দা.বা.., মুয়াত্তা মুহাম্মদ শাইখুল হাদীস আল্লামা নজীর আহমদ সাহেব রহ. এর নিকট পড়েন। দাওরায়ে হাদীস পড়ার পর তিনি ১ বছর তাফসীর বিভাগে পড়াশোনা করেন।

ওস্তাদগণের খেদমত

হযরতজী রহ. এর ইলম ও উন্নত চরিত্রের কারণে তাঁর ওস্তাদগণও তাঁকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি লেখাপড়ার সাথে সাথে আসাতেযায়ে কেরামের খেদমতেও ছিলেন অগ্রগামী। বিশেষ করে বৃহস্পতিবার ও শুক্রবারে শাইখুল হাদীস আল্লামা আব্দুল কাইয়ূম রহ.-এর বাড়িতে গিয়ে বিভিন্ন কাজ কর্ম করে দিতেন। ধান রোপণের সময় হলে ধান রোপণ করে দিতেন।

 

ছাগলনাইয়া আজিজিয়া মাদরাসায় কর্মজীবন 

মুফতী সাহেব রহ. কখন কী করবেন ঐ ব্যাপারে তাঁর শায়খ নানুপুরী হুযুর রহ. পূর্ব থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখতেন। সে হিসেবে নানুপুরী হুযুর রহ. মনে মনে স্থির করলেন যে, তাঁকে ফেনী জেলাধীন ছাগলনাইয়া আজিজিয়া মাদরাসাটি গড়ার জন্য পাঠাবেন। মাদরাসাটির মুহতামিম ছিলেন নানুপুরী হুযুর রহ. এর খলীফা হযরত মাওলানা বজলুর রহমান সাহেব রহ.। উক্ত মাদরাসাটির বয়স ১৫ বছর হলেও তাতে লেখাপড়ার তেমন উন্নতি হচ্ছিল না। কোনো উস্তাদ সেখানে বেশিদিন টিকতো না।

অপরদিকে তাফসীরের বর্ষ শেষ হওয়ার আগেই বিভিন্ন বড় বড় মাদরাসা কর্তৃপক্ষ তাঁকে ওস্তাদ হিসেবে পেতে যোগাযোগ করা শুরু করেন। কক্সবাজারের একটি মাদরাসায় তাঁকে বুখারী শরীফ পড়ানোর জন্য শাইখুল হাদীস হিসেবে নেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু মুফতী সাহেব হুযুর রহ. তো নিজের ইচ্ছার রশি তাঁর শায়খের হাতে সোপর্দ করে দিয়েছিলেন। তাই তাঁর প্রাণপ্রিয় শায়খ যখন বলেছিলেন, “আমি তোমাকে ছাগলনাইয়া মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে পাঠাতে ইচ্ছা করেছি। এ ব্যাপারে তোমার মতামত কী?” তখন মুফতী সাহেব হুযুর রহ. বলেছিলেন, এটাতো আজনবীর মত কথা হলো। আমাকে যদি আপনি রাস্তায় বসে থাকতে বলেন, এতেও আমি রাজি আছি। একে বলে ফানা ফিশ শাইখ।

যাইহোক, মুফতী সাহেব রহ. এর উত্তর শুনে নানুপুরী হুযুর রহ. খুশি হয়ে বলেন, আমি তোমার থেকে এ ধরনের উত্তরই কামনা করেছিলাম। হযরত মুফতী সাহেব রহ. স্বীয় শায়খের নির্দেশনা মোতাবেক ছাগলনাইয়া মাদরাসায় চলে যান। মাদরাসায় গিয়ে দেখলেন, মাদরাসার করুণ অবস্থা। মাদরাসার শ্রেণি আছে মাত্র দাহুম (৪র্থ শ্রেণি) পর্যন্ত। তাতেও ছাত্র আছে ৬/৭ জন। দুপুরের মক্তবে বিশজনের মত ছাত্র আছে।

এদিকে হাটহাজারী মাদরাসা, পটিয়া মাদরাসা, জামালপুর মাদরাসার আসাতেযায়ে কেরাম ও তাঁর খাছ ওস্তাদ মাওলানা আব্দুল মতিন সাহেব এবং তাঁর আব্বাসহ সবাই ছাগলনাইয়া মাদরাসায় যাওয়ায় অসন্তুষ্ট হন। কেননা তাঁরা পূর্ব থেকেই জানতেন যে, ছাগলনাইয়া মাদরাসার বয়স ১৫ বছর হয়ে গেলেও এর কোনো উন্নতি হয়নি। আর সবার আকাঙ্ক্ষা ছিল যে, মুফতী সাহেব হুযুর রহ. দাওরায়ে হাদীস মাদরাসায় হাদীস-তাফসীরের কিতাব পড়াবেন।

যাইহোক, হযরতজী মুফতী সাহেব রহ. তাঁর শায়খের নির্দেশনা মোতাবেক ছাগলনাইয়া মাদরাসায় পাহাড়ের মত অটল হয়ে পড়ানো শুরু করলেন। মুহতামিম সাহেব রহ. বলেন, আপনার বেতন ৬০ টাকা নির্ধারণ করা হল। হযরতজী রহ. আল্লাহপাকের শোকর আদায় করে বললেন, আমি ৬০ টাকারও যোগ্য নই। অথচ তাঁকে ইতোপূর্বে ৫ শত টাকা বেতনে শাইখুল হাদীস পদে নেয়ার জন্য প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল, যখন হাটহাজারী মাদরাসার শায়খুল হাদীসের বেতন ছিল ৩ শত টাকা। এ ঘটনাটি নিঃস্বার্থ দ্বীনি খেদমত ও স্বীয় শাইখের প্রতি ফানাইয়্যাতের একটি জোরালো দৃষ্টান্ত হিসেবে পেশ করার মত ঘটনা ছিল।

ছাগলনাইয়া মাদরাসায় গিয়ে হযরতজী রহ. মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে ছাত্র সংগ্রহ করতেন। অনেক সময় বাবুর্চি ও বড় ছাত্র না থাকায় খানা পাক করে ছাত্রদেরকে খাওয়াতেন নিজ হাতে। মাদরাসার টয়লেট পরিষ্কার করতেন। মাদরাসার ফান্ডে টাকা না থাকায় বাজারে গিয়ে চাঁদা কালেকশন করতেন। মক্তবে ছোট ছোট বাচ্চাদেরকে পড়াতেন।

হযরত মুফতী সাহেব রহ. এর অক্লান্ত মেহনতের ফল প্রকাশ হতে লাগল। মাদরাসার ছাত্রসংখ্যা দ্রুত বাড়তে লাগল। একই বছর নুহুম ও হাশতুম দুই জামাত খোলা হলো। প্রথম বছরে পড়ালেখার উন্নতি দেখে তাঁর শায়খ হযরত সোলতান আহমদ নানুপুরী রহ. বললেন, ইনশাআল্লাহ মাদরাসার উন্নতি হবে। তিনি আরো বললেন, জামাতে উলা পর্যন্ত খোলার পর আরো দুই বছর সেখানে পড়াবে, তারপর তোমার দায়িত্ব শেষ।

হযরত মুফতী সাহেব রহ. এর মেহনতে ছাত্র সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাচ্ছিল। সাথে সাথে প্রত্যেক বছর নতুন জামাত খোলা হচ্ছিল। আলহামদুলিল্লাহ, সাত বছরে জামাতে উলা খোলা হয়েছিল। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে তা’লীম-তরবিয়্যাত, লেখাপড়ায় উন্নত বহু ছাত্রে ভরপুর জমজমাট মনোরম একটি মাদরাসায় পরিণত হয়ে গেল।

জামাতে উলা খোলার পর আরো দু’বছরসহ মোট নয় বছর ছাগলনাইয়া মাদরাসায় তিনি কর্মরত ছিলেন।

খেলাফত লাভ

হযরত মুফতী সাহেব রহ. ছাগলনাইয়া মাদরাসার লেখাপড়া ইত্যাদির উন্নতিকল্পে যেমন প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন, অনুরূপভাবে আত্মশুদ্ধির জন্য যিকির, অযীফা, তেলাওয়াত ইত্যাদিও পরিপূর্ণভাবে আদায় করতেন। তিনি নানুপুরী হুযুর রহ. এর নির্দেশানুযায়ী ছাগলনাইয়া মাদরাসায় যাওয়ার পর প্রথম দিকে তিন রমযানে ৩ চিল্লা ইতিকাফ করেন। উক্ত ইতিকাফের ২/১ বছর পর মুফতী সাহেব রহ. কে তাঁর ছাব্বিশ বছর বয়সে নানুপুরী হযরত রহ. খেলাফত প্রদান করেন।

নানুপুর মাদরাসায় নিয়োগ

হযরত মুফতী সাহেব রহ. সুদীর্ঘ নয় বছর ছাগলনাইয়া মাদরাসায় অবস্থান করে মাদরাসাটি গড়ে দেন। ১৪০০ হিজরীতে তিনি নানুপুর মাদরাসা মসজিদে রমযানের আখেরী দশদিন ইতিকাফ করেন। তখন নানুপুর মাদরাসার মুহতামিম হযরত মাওলানা জমির উদ্দিন রহ. এবং নায়েবে মুহতামিম মাওলানা সোলাইমান রহ. মুফতী সাহেব রহ. কে নানুপুর মাদরাসায় নিয়োগের ব্যাপারে প্রবল আগ্রহ প্রকাশ করেন। আবার হযরত শায়খ সোলতান আহমদ নানুপুরী রহ.ও সম্মতি প্রকাশ করেন। সাথে সাথে ছাগলনাইয়া মাদরাসা থেকে বিদায় নেয়ার পদ্ধতিও বলে দেন। তাঁর বাতানো পদ্ধতিতে তিনি ছাগলনাইয়া মাদরাসা থেকে বিদায় নিয়ে ১৪০০ হিজরীর শাওয়াল মাসের ৫ তারিখে নানুপুর মাদরাসায় যোগদান করেন।

ফতওয়ার খিদমাত

নানুপুর মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ হওয়ার একদিন পর নানুপুরী হুযুর রহ. ঘোষণা দিলেন যে, আজ থেকে আল্লাহর রহমতের উপর ভরসা করে মাদরাসায় দারুল ইফতা বা ফতওয়া বিভাগ খোলা হলো এবং মাওলানা ছাঈদ আহমদ সাহেবকে মুফতী বানানো হলো এবং ছাত্রদেরকে বলে দিলেন যে, তোমরা প্রয়োজনীয় মাসআলা তাঁকে জিজ্ঞেস করবে এবং সাধারণ মানুষকেও বলে দিবে। মুফতী সাহেব রহ. বললেন যে, তিনি কোনো ইফতা বিভাগে ভর্তি হননি এবং কারো কাছে ফতওয়া দেয়া শিখেননি। তারপরও যখন নানুপুরী হযরত রহ. এর মোবারক জবানে ফতওয়া দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হলো, তিনি বুঝতে পারলেন যে, এতে আল্লাহপাকের কোনো রহস্য আছে এবং নিশ্চয় এতে আল্লাহপাকের রহমত হবে। তাই আল্লাহপাকের উপর ভরসা করে তিনি উক্ত দায়িত্ব গ্রহণ করে ফতওয়া লিখা শুরু করলেন। ধীরে ধীরে তাঁর মাধ্যমে ফতওয়া বিভাগের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন জায়গা থেকে অভিজ্ঞ মুফতীয়ানে কেরাম মুফতী সাহেব রহ. এর নিকট তাঁদের ফতওয়া সত্যায়নের জন্য প্রেরণ করা শুরু করেন। তিনি পাকিস্তানে কখনও যাননি। তা সত্বেও পাকিস্তানের মুফতী বোর্ডে তাঁকে অল্লর্ভুক্ত করা হয়। পাকিস্তানের জামিয়া বানূরীর তৎকালীন প্রধান মুফতী কয়েকটি মাসআলা ও রেসালা সত্যায়নের জন্য এবং মন্তব্য লিখার জন্য মুফতী সাহেব রহ. এর নিকট প্রেরণ করেন। তাঁর পক্ষ থেকে বিস্তারিত মন্তব্য লিখে পাঠানো হয়েছিল। সেখানকার মুফতীয়ানে কেরাম তা পছন্দ করেছেন এবং করাচীর জামিয়া বানূরী থেকে প্রকাশিত ‘জাওয়াহিরুল ফাতাওয়া’ নামক বিরাট ফতওয়া গ্রন্থে তাঁর কয়েকটি উত্তর স্থান পেয়েছে। আবুধাবীর ওয়াক্ফ সচিব শায়খ বশীর মালেকী মাযহাবের অভিজ্ঞ আলেম। তিনি একবার মুফতী সাহেব রহ. নিকট কয়েকটি প্রশ্ন পাঠান। মুফতী সাহেবের পক্ষ থেকে উত্তর পেয়ে তিনি খুবই খুশি হন। একবার এরশাদ সরকারের আমলে মুফতী ওয়াক্কাস সাহেবকে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী বানিয়ে তাঁর মধ্যস্থতায় বাংলাদেশের খ্যাতনামা মুফতীয়ানে কেরামের নিকট কয়েকটি প্রশ্ন পাঠানো হয়েছিল। চট্টগ্রামে পাঠানো কপির উত্তরের দায়িত্ব হাটহাজারী, পটিয়া, নানুপুর ও বাবুনগর মাদরাসার মুফতীগণের নিকট অর্পণ করা হয়েছিল। সবার লিখিত ফতওয়ার মধ্যে মুফতী সাহেবের লিখিত দীর্ঘ ৫২ পৃষ্ঠার ফতওয়াটি হাটহাজারী মাদরাসায় হযরত আল্লামা ইসহাক গাজী রহ. এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ফতওয়া যাচাই বৈঠকে গ্রহণযোগ্য হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছিল। হযরত নানুপুরী হযরত রহ. ও পটিয়ার হাজী ইউনুস সাহেব রহ. ফতওয়ার কপিটি নিয়ে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এরশাদ ও ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মুফতী ওয়াক্কাস সাহেবের বৈঠকে তাশরিফ নিয়েছিলেন।

দেশ-বিদেশ থেকে পাঠানো প্রশ্নসমূহের জবাব দেয়ার সাথে সাথে তিনি মাসিক আর-রশীদের ফতওয়া বিভাগের প্রশ্নসমূহের জবাবও লিখতেন।

ভারতে আন্তর্জাতিক মুফতী সেমিনারে আমন্ত্রণ

জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ (ভারত) এর পক্ষ থেকে কয়েকটি জটিল বিষয়ের শরয়ী সমাধানের জন্য হযরত মুফতী সাহেব রহ. এর নিকট কয়েকটি প্রশ্ন পাঠানো হয়েছিল। তাঁর পক্ষ থেকে প্রশ্নগুলোর উত্তর পেয়ে তাঁরা খুশি হয়ে ১৯৯১ ইংরেজিতে ভারতের দারুল উলূম দেওবন্দের ‘মাহমুদ’ হলে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক মুফতী সেমিনারে অংশগ্রহণের জন্য তাঁকে দাওয়াত দেন এবং তাতে তিনি অংশগ্রহণ করেন। উক্ত সেমিনারে তিনি উর্দু ভাষায় সারগর্ভ আলোচনা করেন। তাঁর উত্তর উপস্থিত অধিকাংশ মুফতীয়ানে কেরামের রায়ের সাথে মিল খেয়ে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। আবার ১৯৯২ সালের আন্তর্জাতিক মুফতী সেমিনারের মুনাযারা অনুষ্ঠানেও তিনি অংশগ্রহণ করে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর প্রদান করেন।

বিভিন্ন মুফতী বোর্ডের সদস্য

মুফতী সাহেব রহ.কে ঢাকাস্থ বাংলাদেশ মুফতী বোর্ডের শুরু লগ্ন থেকেই সদস্য বানানো হয় এবং ঐ বোর্ডের দশ সদস্য বিশিষ্ট বিশেষ কমিটিরও সদস্য করা হয়।

জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার পক্ষ থেকে ‘আল বুহুসুল ইসলামিয়া’ নামক দশ সদস্য বিশিষ্ট গঠিত ফতওয়া বোর্ডের জন্মলগ্ন থেকেই তাঁকে সদস্য হিসেবে মনোনীত করা হয়।

২০০৮ সনে বাংলাদেশ সরকারের নারী নীতিমালার আপত্তিকর ধারাসমূহ সংশোধন করার লক্ষ্যে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উদ্যোগে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ২০ সদস্য বিশিষ্ট শীর্ষস্থানীয় মুফতীয়ানে কেরামের যে কমিটি করা হয়েছিলো তাতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন।

গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বসমূহ

নানুপুর মাদরাসায় থাকাকালীন তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্বসমূহের মধ্যে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিম্নরূপ:

১.ফতওয়া বিভাগের প্রধান ২. শিক্ষা পরিচালক ৩. হাদীস ও ফিকহের গুরুত্বপূর্ণ কিতাবসমূহের অধ্যাপনা ৪. আঞ্জুমানে ছোলতানিয়া বাংলাদেশের মহাসচিব ৫. মাসিক আর-রশীদের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। তাছাড়া নানুপুরী হযরত রহ. তাঁর দ্বারা বাইরের অনেক মাদরাসার তত্ত্বাবধান ও পরিদর্শনের কাজ আঞ্জাম দিতেন। আর কোনো কোনো মাদরাসার পুরো দায়িত্ব তাঁর উপর অর্পণ করেছিলেন। আর একাধিক মাদরাসার ভিত্তিও তাঁর মাধ্যমে স্থাপন করেছিলেন। ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত তিনি ফেনী জামিয়া ইসলামিয়া সোলতানিয়া লালপোল (মাদরাসা)র প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও শাইখুল হাদীস হিসেবে দায়িত্ব পালন ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বহু মাদরাসার পৃষ্ঠপোষকতা ও তত্ত্বাবধান করেছেন।

শিক্ষকতায় তাঁর অবদান

নানুপুর মাদরাসায় থাকাকালীন যেভাবে হযরত মুফতী সাহেব রহ. দ্বারা ফতওয়ার দিক দিয়ে উম্মত ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়, এমনিভাবে তাঁর দরসের দ্বারাও অভাবনীয় উপকৃত হয় ছাত্ররা। প্রথম বছর থেকে শেষ পর্যন্ত রদ-বদল হয়ে নিম্নের গুরুত্বপূর্ণ কিতাবসমূহ তাঁর দরসে এসেছিল- গুলিস্তাঁ, নাহবেমীর, মেরকাত, কুতবী, মাকামাত, তাওযীহ, মুসাল্লামাতুস সাবুত, শরহে আকায়েদ, হেদায়া, নাসাঈ শরীফ, বায়যাবী শরীফ, তিরমিযী শরীফ (২য় খণ্ড), মুসলিম শরীফ (কামেল)।

জামিয়া সোলতানিয়া লালপোলে তিনি ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত বুখারী শরীফ এবং ফতওয়া বিভাগের ‘আল আশবাহ ওয়ান্নাযায়ের’ কিতাবের দরস প্রদান করেন।

নানুপুরী হযরত রহ. এর সাথে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ সফর

যেহেতু নানুপুরী হযরত রহ. মুফতী সাহেবকে সর্ব ব্যাপারে উম্মাহর জন্য গড়ে তোলার সর্বদা ফিকিরমন্দ ও আগ্রহী ছিলেন, তাই যেমনিভাবে তাঁকে নানুপুর মাদরাসায় নিয়ে দীর্ঘ সময়ের জন্য নিজের কাছে রেখেছেন তেমনিভাবে তাঁকে হযরতজী রহ. এর বড় সফরেও সঙ্গী হিসেবে রাখার জন্য আগ্রহী ছিলেন। এ কারণেই ১৪০০ হিজরীতে ভারতের দারুল উলূম দেওবন্দে আয়োজিত শত বার্ষিকী মহাসম্মেলনে যোগদানের সময় মুফতী সাহেবকে সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং নানুপুরী হযরত রহ. এর আখেরী হজেও তাঁকে সাথে নিয়ে যান।

নানুপুরী হযরত রহ-এর গুরুত্বপূর্ণ চিঠিপত্র লিখন

নানুপুরী হযরত রহ. তাঁর গুরুত্বপূর্ণ চিঠিপত্র ইত্যাদি মুফতী সাহেব রহ. এর দ্বারাই লিখাতেন। অনেক খলিফাদের খেলাফতের চিঠি তাঁর হাতেই লিখিয়েছিলেন। খোলাফাদের নামের তালিকাভুক্ত খাতা নানুপুরী হযরত রহ. একটি নিজের নিকট রেখেছিলেন। আরেকটি রেখেছিলেন মুফতী সাহেব রহ.-এর নিকট। তিনি নানুপুরী হযরত রহ.-এর ইন্তেকালের পর সমস্ত খোলাফাদের নাম মাসিক আর-রশীদের মাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন।

নানুপুর মাদরাসা থেকে বিদায়

মুফতী সাহেব রহ. দীর্ঘ ১৯ বছর পর্যন্ত নানুপুর মাদরাসায় অবস্থান করে উপরোল্লিখিত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বসমূহ অত্যন্ত সচেতনতা ও দূরদর্শিতার সাথে আঞ্জাম দেন। এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক, কর্তৃপক্ষ কারো পক্ষ থেকে তাঁর ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য কোনো অভিযোগ শুনা যায়নি বরং সকলের মুখ থেকে তাঁর ব্যাপারে প্রশংসাই পরিলক্ষিত হয়েছে। নানুপুরী হুযুর রহ. এর ইন্তেকালের পরও মাদরাসা কর্তৃপক্ষ বিশেষ করে মুহতামিম হযরত মাওলানা জমীরুদ্দীন সাহেব রহ. তাঁকে বিদায় দিতে রাজী ছিলেন না। বরং আজীবন উল্লেখিত দায়িত্বসমূহের সাথেই তাঁকে রাখতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু যেহেতু কুতবুল আলম হযরতজী নানুপুরী রহ. মুফতী সাহেব রহ. এর ব্যাপারে হুকুম জারী করেছিলেন যে, আমার ইন্তেকালের পর তুমি ফেনী লালপোলস্থ সোলতানিয়া মাদরাসায় অবস্থান করে খেদমত আঞ্জাম দিবে। তাই হযরতের অসিয়ত অনুযায়ী পারস্পরিক মায়া-মমতা ও বিদায়ী বেদনা প্রকাশের মাধ্যমে ১৪২০ হিজরীর শাবান মাসে তাঁর তা’লিমাতী এন্তেজামের মাধ্যমে বার্ষিক পরীক্ষা সমাপ্ত করে তিনি নানুপুর মাদরাসা থেকে বিদায় নিয়ে ফেনীতে চলে আসেন।

ফেনী লালপোল মাদরাসায় অবস্থান

হযরত মুফতী সাহেব রহ. ফেনীর লালপোল এলাকায় নানুপুরী হযরত রহ.-এর হুকুমে মাদরাসার জন্য জায়গা খরীদ করেন এবং সেখানে নানুপুরী হুযুর রহ. নিজ হস্ত মোবারকে মাদরাসার ভিত্তি স্থাপন করেন এবং তিনি হুকুম জারী করেন, আমি যতদিন বেঁচে থাকি তুমি নানুপুর মাদরাসা থেকে যেতে পারবে না। বরং যাতায়াতের মাধ্যমে উক্ত মাদরাসা পরিচালনা করবে। আমার ইন্তেকালের পর স্বয়ং ওখানে অবস্থান করে মাদরাসার খেদমত করে যাবে। তাই নানুপুরী হযরত রহ. এর ইন্তেকালের পর তাঁর নির্দেশক্রমে নানুপুর মাদরাসা থেকে বিদায় নিয়ে তিনি ফেনী লালপোল সোলতানিয়া মাদরাসায় অবস্থান করে মাদরাসা পরিচালনা করতে থাকেন। তাঁর অবস্থানের সাথে সাথে দ্রুতগতিতে মাদরাসার ছাত্র সংখ্যা বাড়তে থাকে। মাদরাসার অবকাঠামোগত উন্নতিও সাধিত হয়। ক্রমান্বয়ে দাওরায়ে হাদীস, উচ্চতর তাজবীদ বিভাগ ও ফতওয়া বিভাগ খোলার মাধ্যমে মাদরাসাটি জামিয়ায় রুপান্তরিত হয়। সাথে সাথে তা সালেকীন এবং খোদাপ্রেমিকদের মারকাযে পরিণত হয়।

বিভিন্ন জায়গায় মুনাযারায় অংশগ্রহণ

ছোটবেলা থেকেই মুফতী সাহেব রহ. এর অন্তরে ছিল শিরক ও বেদআতের প্রতি ঘৃণা এবং হক ও সুন্নতকে প্রতিষ্ঠিত করার ফিকির। এ কারণে ছাগলনাইয়া মাদরাসায় খেদমতকালে বিভিন্ন জায়গায় বেদআতীদের সাথে মাঠ পর্যায়ে মুনাযারা করেন এবং প্রত্যেক জায়গায় তিনি আল্লাহর রহমতে কামিয়াব হন আর প্রতিপক্ষ হেরে যায়।

পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মুফতী সাহেব রহ. কে ‘সাইয়্যেদুল মুনাযিরীন’ উপাধি দেয়া হয়েছিল। বিভিন্ন স্থানে মুনাযারায় তিনি প্রমাণ করেন যে, বাস্তবিকই তিনি সাইয়্যেদুল মুনাযিরীন।

খাঁটি আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআত সংস্থা প্রতিষ্ঠা

মুফতী সাহেব রহ.-এর মধ্যে হক প্রচার ও বাতিল প্রতিরোধের জযবা ও স্পৃহা বিদ্যমান থাকার কারণে ছাগলনাইয়াতে থাকাকালীন ওলামা বাজার, ঘাটঘর, ফুলগাজীসহ বিভিন্ন মাদরাসার অভিজ্ঞ ওলামায়ে কেরামদেরকে ডেকে ‘খাঁটি আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআত পরিষদ’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ঐ সংস্থা থেকে সহীহ আক্বীদা ও আমল সম্পর্কীয় কয়েকটি দ্বীনি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। যেমন, ১. ওহাবী কে? সুন্নী কে? ২. মাথা কামানোর ফতওয়া ও মাইকে শবীনা খতম। ৩. মুনাযারায়ে সোনাপুর ইত্যাদি।

এলাকার পরিবর্তন

তাঁর এলাকাটি ছিল বিদআত-কুসংস্কারে নিমজ্জিত। তাদের হেদায়াতের জন্য ছোট বেলা থেকেই তিনি ছিলেন ফিকিরমন্দ। তিনি ভেবেছিলেন যে, বিতর্কিত মাসআলাগুলো বুঝাতে চেষ্টা করলে তারা তা শুনবে না। এজন্য বিতর্কিত বিষয় আলোচনা না করে মানুষকে বুঝিয়ে নামাযের দিকে ডাকতেন এবং বেশি বেশি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতের কথা আলোচনা করতেন। ধীরে ধীরে তাদের ভুল ভাঙলো, তাদের ধ্যান ধারণা পাল্টে গেল। আজ তারা মুফতী সাহেব রহ.কে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। এমন কি যারা তাঁকে কাফের বলতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি পরে তারাই তাঁর জন্য পাগলপারা হয়ে যায়। এলাকার বিশাল ঈদগাহে তিনিই ঈদের নামাযের ইমামতি করতেন।

ইসলাহী খিদমাত

নানুপুরী হযরত রহ. এর আশা ছিল মুফতী সাহেব রহ. এর মাধ্যমে ব্যাপকভাবে মানুষ উপকৃত হওয়া। এ কারণে তাঁর শাইখ সোলতান আহমদ নানুপুরী রহ. নিজ জীবদ্দশায় স্বীয় সন্তান মাওলানা এমদাদুল্লাহ সাহেবকে গোপালগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ ইত্যাদি এলাকার মাহফিলে এলান করার জন্য বলেছেন যে, আমার পরে মুফতী সাঈদ আহমদ সাহেবের হাতে যেন মুরীদ হয়। নানুপুরী হুযুর রহ. এর ইন্তেকালের পর দলে দলে লোক মুফতী সাহেব রহ. এর হাতে বাইয়াত হন। অনেক লোক স্বপ্নের মাধ্যমে নির্দেশপ্রাপ্ত হয়ে তাঁর হাতে বাইয়াত হন। জামালপুর মাদরাসার তাঁর তিন সহপাঠী তাঁর হাতে মুরীদ হয়েছিলেন। এমনকি তাঁর ওস্তাদ মাওলানা ইউসুফ সাহেব একদা স্বপ্নে দেখলেন যে, মুফতী সাহেব রহ. নিজ কক্ষে যে জায়গায় বসতেন ওখানে ইমামে রাব্বানী, কুতবুল আলম রশীদ আহমদ গাংগুহী রহ. বসে আছেন। এ স্বপ্ন দেখে তিনি তাঁর ছাত্র হযরত মুফতী সাহেব রহ. হাতে বাইয়াত হতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। লক্ষণীয় হল, সাথী ভাই অপর সাথী ভাইয়ের হাতে বাইয়াত হওয়া আর ওস্তাদ তার ছাত্রের হাতে বাইয়াত হতে আগ্রহ প্রকাশ করা দ্বারা হযরত মুফতী সাহেব রহ. কত উঁচু মাপের ব্যক্তিত্ব ছিলেন, তা সহজে অনুমান করা যায়। তিনি দেশের প্রায় জেলায় সফর করে দ্বীনি মাহফিলে অংশগ্রহণ করে আল্লাহর বান্দাদেরকে হেদায়াতের বাণী শুনিয়েছেন। ঢাকা, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ফেনী ইত্যাদি অঞ্চলে হযরত মুফতী সাহেব রহ. এর মাসিক/ত্রৈমাসিক ইসলাহী মাহফিল অনুষ্ঠিত হতো। শেষ বয়সে অসুস্থতার কারণে শুধু জামিয়া সোলতানিয়া লালপোলে প্রতি ইংরেজি মাসের ১ম শুক্রবারে ইসলাহী মাহফিল অনুষ্ঠিত হতো।

হাজার হাজার মানুষ তাঁর হাতে বাইয়াত হয়ে আত্মশুদ্ধি হাসিল করে আল্লাহ তা’আলার প্রিয়পাত্র হবার সৌভাগ্য অর্জন করেন।

মাহে রমযান আগমন করলে মুফতী সাহেব রহ. এর সোহবতে থেকে আত্মশুদ্ধির উদ্দেশ্যে বড় বড় আলেম-ওলামাসহ বিভিন্ন স্তরের জনতা লালপোল সোলতানিয়া মাদরাসায় ই’তিকাফ করার জন্য সমবেত হতেন। তাদের মধ্যে কিছু আসতেন চল্লিশ দিনে জন্য, কিছু পুরো রমযানের জন্য, আর কিছু আসতেন রমযানের শেষ দশদিনের জন্য। মুফতী সাহেব রহ. তাঁদেরকে ইসলাহী সবক দিতেন, বয়ান করতেন।

শুক্রবারে অন্য কোথাও দাওয়াত না নিয়ে ফেনী লালপোল জামিয়া ইসলামিয়া সোলতানিয়ায় অবস্থান করতেন। ফলে শুক্রবারে লালপোল মাদরাসায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আলেম ওলামা এবং বিভিন্ন শ্রেণির মেহমানের সমাগম হতো। মুফতী সাহেব রহ. তাদের উদ্দেশ্যে জরুরি হেদায়াতি আলোচনা প্রদান করতেন।

তিনি তাঁর হাজার-হাজার আলেম মুরীদান থেকে বাছাই করে ১১৬ জনকে খেলাফত প্রদান করেন। তিনি বড় মাদরাসার মুহতামিম হওয়া, বড় বক্তা হওয়া ও প্রসিদ্ধ আলেম হওয়াকে খেলাফতের মাপকাঠি বানাতেন না। বরং দিলটা তৈরি হয়েছে কিনা, আল্লাহর মুহাব্বাত ও ভয় কাজে-কর্মে পরিলক্ষিত হয় কিনা, শাইখের প্রতি ফানাইয়্যাত আছে কিনা ইত্যাদি বিষয় দেখে খেলাফত প্রদান করতেন। বাংলাদেশ ছাড়াও বহির্বিশ্বের বড় বড় ব্যক্তিত্ব হযরতজী রহ. এর সাথে ইসলাহী সম্পর্ক স্থাপন পূর্বক খেলাফতপ্রাপ্ত হয়েছেন। যেমন, ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের শাইখে সানী হযরত আল্লামা আবদুল হক আজমী রহ. এর সাহেবজাদা মাওলানা মুফতী আবদুল বার আজমী সাহেব দা.বা., দক্ষিণ আফ্রিকার প্রসিদ্ধ ইসলামিক মিডিয়া ব্যক্তিত্ব মাওলানা সলিম করিম দা.বা., এছাড়া মক্কা শরীফে একজন, ওমানে একজন হযরত রহ. এর খলীফা রয়েছেন। ঐ দৃষ্টিকোণ থেকে হযরত মুফতী সাহেব রহ.কে শাইখুল আরব ওয়াল আজম বলা যায়।

মাদরাসা থেকে বেতন গ্রহণ করতেন না

হযরত মুফতী সাহেব রহ. অনেক বছর যাবত মাদরাসা থেকে বেতন নিতেন না। বেতন না নেয়ায় একবার জামিয়ার মজলিসে শুরা তাঁর জন্য রেজুলেশন করে ১৫ হাজার টাকা ভাতা ধার্য করে। তিনি বললেন, আপনারা রেজুলেশন করেছেন ঠিক আছে। তবে আমি প্রয়োজন হলে নেবো। কিন্তু মৃত্যু পর্যল্ল তিনি কোনো ভাতা নেননি। অথচ তাঁর পরিবারে মাসিক ৩০-৪০ হাজার টাকা খরচ হতো। আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলের কারণে আল্লাহর বান্দাদের দেয়া হাদিয়ার মাধ্যমে তাঁর পরিবারের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা হয়ে যেতো।

শ্রেষ্ঠ হানাফী আলেমদের মধ্যে অন্তর্ভুক্তি

বিশিষ্ট ফতওয়া বিশারদ ও লেখক আল্লামা মুফতী হিফযুর রহমান সাহেব দা.বা কর্তৃক আরবী ভাষায় রচিত সর্বকালের শ্রেষ্ঠ হানাফী ওলামায়ে কেরামের সংক্ষিপ্ত জীবনী সম্বলিত ২৩ খ- ব্যাপী ‘আল বুদূরুল মযিয়্যাহ আলা তারাজিমিল হানাফিয়্যাহ’ নামক বিশাল গ্রন্থের ৮ম খণ্ডের ১৯২ পৃষ্ঠায় হযরত মুফতী সাহেব রহ. এর সংক্ষিপ্ত জীবনী লেখা হয়েছে। এতে লেখক হযরতজী মুফতী সাহেব রহ. কে শ্রেষ্ঠ হানাফী আলেমগণের মধ্যে গণ্য করেছেন।

হাকীমুল ওলামা খেতাব

২০০১ সালের ফেনী ঐতিহাসিক ওয়াফদা ঈদগাহ ময়দানে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইসলামী মহাসম্মেলন পরিচালক একজন বড় আলেম হযরতজী রহ. এর বয়ানের পূর্বে তাঁর নাম ঘোষণা করার সময় হাকীমুল ওলামা মুফতী ছাঈদ আহমদ দা.বা. বলে নাম ঘোষণা করেন। যা মুহিব্বীনের অল্লরে তৃপ্তিদায়ক মনে হয়েছিল। তারপর বিভিন্ন মাদরাসার মাহফিল ও সম্মেলনের পোস্টারে এবং অনেক মানুষের মুখে মুখে হযরতজী রহ. এর শানে হাকীমুল ওলামা উপাধি চর্চা হতে থাকে। উক্ত উপাধির যথার্থতা সেসব লোকদের নিকট স্পষ্ট ও উদ্ভাসিত, যারা হযরতজীকে চিনেন ও তাঁর ব্যাপারে সম্যক অবগতি রাখেন।

জটিল বিষয়ের শরয়ী সমাধানে সিদ্ধহস্ত

হযরতজী মুফতী সাহেব রহ. এর নিকট যেকোনো জটিল শরয়ী সমস্যার সমাধানে ফতওয়া চাওয়া হলে তিনি সহজে তার সমাধান দিয়ে দিতেন। যেকোনো নতুন সমস্যার সমাধানে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত।

তিনি হাটহাজারী ফতওয়া বোর্ডের সদস্য ছিলেন। উক্ত বোর্ড থেকে ইসলামী ব্যাংকের শরয়ী রূপরেখা চাওয়া হলে তিনি কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী ব্যাংকের শরয়ী রূপরেখা পেশ করেন।

কিছুদিন পূর্বে চেয়ারে বসে নামায আদায় সংক্রান্ত ফতওয়া লিখেন যা দৈনিক ইনকিলাবসহ কয়েকটি জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বোমাবাজদের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ফতওয়া লিখেন। উক্ত ফতওয়াটিও বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। আবার তা স্বতন্ত্র পুস্তক আকারেও প্রকাশিত হয়ে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের ঊধর্ক্ষতন অনেক কর্মকর্তার হাতে পৌঁছে গেছে। উক্ত ফতওয়াটিতে তিনি কাউকে ছাড় দিয়ে লিখেননি। যা পাঠকমাত্রই বুঝতে সক্ষম হবেন।

শত শত মাদরাসার পৃষ্ঠপোষকতা

হযরত মুফতী সাহেব রহ. জামিয়া ইসলামিয়া সোলতানিয়া লালপোল ফেনী এর প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক হওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের শত শত মাদরাসার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর নামানুসারে মাগুরাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সাঈদিয়া মাদরাসা নামে অনেক মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি বাংলাদেশের বৃহত্তম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া চট্টগ্রামসহ অনেক বড় বড় মাদরাসার মজলিসে শুরার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। তিনি শেষ বয়সে অসুস্থতার কারণে বিভিন্ন মাদরাসায় যেতে পারতেন না বিধায় ঐ সব মাদরাসার মজালিসে শুরার অধিবেশন জামিয়া সোলতানিয়া লালপোল ফেনীতে এসে তাঁর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হতো।

বিভিন্ন মাদরাসার জটিল সমস্যার নিরসন

অনেক মাদরাসায় এমন জটিল জটিল সমস্যা দেখা দেয়, যেগুলোর কারণে মাদরাসা ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে, কিন্তু হযরত মুফতী সাহেব রহ. সাহসিকতা ও বিচক্ষণতার সাথে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করায় ঐ সমস্ত সমস্যা ধুলাবালির মত উড়ে যায়। শুধু এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখতে গেলে একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থে রূপ নেবে।

তাবলীগ জামাতের সৃষ্ট সংকট সমাধানে তাঁর উদ্যোগ

হযরত মুফতী সাহেব রহ. ইন্তেকালের পূর্বে ফেনী জেলার বিভিন্ন মাদরাসার মুহতামিম ও শীর্ষস্থানীয় চল্লিশজন ওলামায়ে কেরাম এবং ফেনী জেলা তাবলীগী মারকাযে শুরার মুহতারাম সদস্যবৃন্দকে তাঁর প্রতিষ্ঠিত জামিয়া সোলতানিয়া লালপোলে আহ্বান করে এনে তাঁর সভাপতিত্বে তাবলীগে সৃষ্ট সংকট সম্পর্কে আলোচনা পর্যালোচনা পূর্বক সিদ্ধান্ত হয় যে, ওলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানেই তাবলীগ জামাত পরিচালিত হবে। কোনো বিতর্কিত ব্যক্তিকেন্দ্রিক তাবলীগ জামাত পরিচালিত হবে না।

তাঁর ইল্লেকালের পর ঢাকাস্থ কাকরাইল মারকাযের অন্যতম মুরুব্বী হযরত মাওলানা রবিউল হক সাহেব দা.বা তাঁর কবর যেয়ারত করতে এসে তাবলীগ জামাতের ব্যাপারে উক্ত উদ্যোগের কারণে তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেন। সাথে সাথে তাঁর মত বিচক্ষণ, প্রজ্ঞাবান ও উম্মতের দরদী ব্যক্তিকে হারিয়ে তিনি অত্যন্ত আবেগ আপ্লুত হয়ে যান।

মুতাফাররিকা ও মুশতারিকা বিভাগের আবিষ্কার

হযরত মুফতী সাহেব রহ. যখন চট্টগ্রাম নানুপুর মাদরাসায় শিক্ষা পরিচালক ছিলেন, তখন তিনি হাফেয ছাত্র, স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্রদেরকে ইয়াজদাহুম, দাহুম ও নুহুমের তিন বছরের কিতাবগুলো অল্প সময়ে তথা ১ বছরে পড়িয়ে দেয়ার জন্য মুতাফাররিকা বিভাগ নামক একটি বিভাগ আবিস্কার করেন, তখন কোথাও এ নামে কোনো বিভাগ চালু ছিল না। নানুপুর মাদরাসায় বিভাগটির সুনাম চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল। বিভাগটি চালু করার পর একবার হাটহাজারী মাদরাসা থেকে সিনিয়র শিক্ষকগণের একটি কাফেলা নানুপুর মাদরাসায় আসলেন মুতাফারিকা বিভাগটি পরিদর্শন করার জন্য। তাঁরা ছাত্রদের লেখাপড়া দেখে খুবই মুগ্ধ হলেন। পরবর্তীতে নানুপুর মাদরাসার অনুকরণে বাংলাদেশের বহু মাদরাসায় মুতাফাররিকা বিভাগ খোলা হয়। অনুরূপভাবে যেসব ছাত্র নিচের জামাতগুলোতে অবহেলার কারণে নাহু-ছরফ তথা আরবী ব্যাকরণে দুর্বল রয়ে গেছে তাদেরকে এক বছরে নাহু-ছরফের গুরুত্বপূর্ণ কিতাবগুলো পড়িয়ে সবল বানানোর জন্য হযরত মুফতী সাহেব রহ. মুশতারিকা বিভাগ নামে একটি বিভাগ চালু করেন। এ বিভাগটি মুতাফাররিকা বিভাগের ন্যায় প্রসিদ্ধি লাভ না করলেও লালপোল জামিয়া সোলতানিয়াসহ কিছু কিছু মাদরাসায় তা চালু হয়েছে।

জ্বিন তাবেয়ীর সাথে সাক্ষাত এবং জ্বিনদেরকে ফতওয়া প্রদান

মানবজাতি যেমন শরীয়তের মুকাল্লাফ অর্থাৎ শরীয়তের বিধি-বিধান মানতে বাধ্য, তদ্রূপ জ্বিনজাতিও শরীয়তের মুকাল্লাফ। তাই শরীয়তের মাসআলা-মাসায়েল জানা তাদের জন্যও জরুরি। একবার হযরত মুফতী সাহেব রহ. এর বাড়িতে কিছু লোক এলেন। তাঁর সাথে কথা-বার্তা বলার পর তারা উধাও হয়ে গেলেন। লোকগুলোর ব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো, এরা কোথায় গেলেন? উত্তরে হযরতজী বললেন, এরা জ্বিন ভাই। শরীয়তের মাসআলা-মাসায়েল জানতে এসেছেন।

একবার জামিয়া সোলতানিয়াতে একজন জ্বিন তাবেয়ী এসেছেন হযরতের সাথে সাক্ষাত করার জন্য। তিনি এসেছিলেন রাতের বেলায়। তাঁর সাথে একজন মানুষও ছিল। তিনি হযরতের কক্ষের বাতিগুলো নিভিয়ে দিতে বললেন। বাতি নেভানোর পর হযরতজী রহ. এবং ঐ জ্বিন তাবেয়ীর মাঝে সাক্ষাত হয়। আলোচনার পর জানা যায় যে, ঐ জ্বিনের পিতা আল্লাহর রাসূল সা. এর সাহাবী ছিলেন। ঐ জ্বিন তাবেয়ী নিজ বাগান থেকে হযরত রহ. এর জন্য হাদিয়া হিসেবে আঙ্গুর, নাশপাতিসহ কয়েক প্রকারের ফল পাঠিয়েছিলেন।

নানুপুরী হুযুর রহ.-এর আসল দৌলত লাভ

শাইখুল আরবে ওয়াল আজম কুতবুল আলম শাহ্ সোলতান আহমদ নানুপুরী রহ. একবার মিরসরাই হাবিলদারবাসা মাদরাসায় তাশরীফ নেন। তাঁর সাথে ছিলেন হযরত মুফতী সাহেব রহ.। নানুপুরী হুযুর রহ. ঐ মাদরাসায় ঘুমান। ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে মুফতী সাহেব হুযুর রহ. কে বলেন, আমি একটি স্বপ্ন দেখেছি। ঐ স্বপ্নটি শুনার পর আলহামদুলিল্লাহ বলবে। নানুপুরী হুযুর রহ. বলেন, আমি স্বপ্ন দেখেছি যে, তুমি আর আমি একটি নৌকায় আরোহন করেছি। নৌকা চলছে, এ সময় ঝড়ো হাওয়া বইছে। নৌকাটি ডুবে যাওয়ার উপক্রম হল। তখন আমি তোমাকে বললাম, আমি মারা গেলেও সমস্যা নেই। আল্লাহ তা‘আলা আমাকে যে দৌলত দিয়েছেন আমি তা তোমাকে দিয়ে দিয়েছি। তুমি কষ্ট করে হলেও নদীর কূলে উঠে যাবে।

এ থেকে বুঝা গেল যে, নানুপুরী হুযুর রহ. এর আসল দৌলত লাভকারী হলেন হযরত মুফতী সাহেব রহ.। তাই শায়খ সোলতান আহমদ নানুপুরী রহ. যেমন কুতবুল আলম ছিলেন তেমনি হযরত মুফতী সাহেব রহ.ও কুতবুল আলম ছিলেন। তাছাড়া হযরত মুফতী সাহেব রহ. কুতবুল আলম হওয়ার অনেক প্রমাণ আছে। বিস্তারিত তাঁর জীবনীগ্রন্থে লিখা হবে ইনশাআল্লাহ।

তাহাজ্জুদ গুযার

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা কিয়ামুল লাইল তথা তাহাজ্জুদ নামাযকে কর্তব্য বানিয়ে নাও, কেননা তা পূর্ববর্তী নেককারগণের অভ্যাস। (তিরমিযী শরীফ ২/১৯৪)

উক্ত হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যে, তাহাজ্জুদ নামায আদায় করা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সব নেককারগণের অভ্যাস। এ অভ্যাস হযরত মুফতী সাহেব রহ. এর মধ্যে ছিল পরিপূর্ণ। জামালপুর মাদরাসায় জামাতে হাফতুমে পড়াকালীন হযরত রহ. তাহাজ্জুদ নামাযে অভ্যস্ত হয়ে যান, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১১/১২ বছর।

হযরত মুফতী সাহেব রহ. মাহফিল ইত্যাদির কারণে কখনো কখনো ঘুমাতে রাতের ১২টা /১টা বেজে যেতো। তারপরও তিনি শেষ রাতে তাহাজ্জুদের জন্য উঠে যেতেন। শেষ বয়সে অনেক রোগে আক্রান্ত হওয়া সত্বেও তিনি তাহাজ্জুদ নামায ছাড়তেন না।

যুগ সচেতনতা

হযরত মুফতী সাহেব রহ. ছিলেন যুগ সচেতন ব্যক্তিত্ব। তিনি পত্র-পত্রিকা ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেশের খবর রাখতেন, সারা বিশ্বের মুসলমানদের খবর রাখতেন, পত্রিকায় বিবৃতি দিতেন। কয়েক বছর পূর্বে নারীনীতিমালা নিয়ে যখন সরকার একথা বলে বিভ্রাল্লি ছড়াচ্ছিল যে, নারী নীতিমালায় ইসলামবিরোধী তেমন কিছু নেই। তখন তিনি নারী নীতিমালার আপত্তিকর ও ইসলামবিরোধী ধারাগুলো চিহ্ণিত করে একটি বুলেটিন তৈরী করেছিলেন যা একটি জাতীয় দৈনিকে প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপানো হয়েছিল। অন্যান্য পত্রিকায়ও ছেপেছিল। উক্ত বুলেটিনটি ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের অনেক জেলায় লক্ষ লক্ষ কপি বিতরণ করা হয়েছিল।এভাবে তিনি ইসলাম ও মুসলমানদের কোনো সমস্যা দেখা দিলে সাধ্যমত ভূমিকা পালনের জন্য চেষ্টা করতেন। আর মুসলিম উম্মাহর জন্য দুআ করতেন সবসময়।

রাসূল সা. এর সুন্নত যেন তাঁর স্বভাবগত বিষয়

হযরত মুফতী সাহেব রহ. এর প্রতিটি কাজ সুন্নত মোতাবেক হতো। রাসূল সা. এর সুন্নত যেন তাঁর স্বভাবগত বিষয় হয়ে গিয়েছিল। আর সুন্নতের উপর অটল থাকাই প্রকৃত বুযুর্গী। গোপালগঞ্জের খ্যাতনামা পীর শাইখুল হাদিস মাওলানা আবদুল্লাহ সাহেব দা.বা. বলেন, আমি হযরত মুফতী সাহেব রহ. এর উত্তরবঙ্গের অনেক সফরে সাথে ছিলাম। মাহফিল করে গন্তব্যে পৌঁছতে প্রায় রাত ১টা বেজে যেতো। হযরত মুফতী সাহেব রহ. এর কোনো কাজ আমি সুন্নতের খেলাফ দেখিনি।

মৃত্যুর পূর্বে যখন হযরতের হুঁশ প্রায় ছিলো না, খানা-পিনা বন্ধ, ইশারা-ইঙ্গিতও করতে পারতেন না, এমন মুহূর্তে কুদরতিভাবে একটু একটু ইশারা করে বুঝালেন মেসওয়াক করিয়ে দেয়ার জন্য। হযরতের বড় ছেলে মাও. তৈয়ব সোলতানী হযরতকে মেসওয়াক করিয়ে দিলেন। এতে হযরতের স্বস্তি এসে গেল। মেসওয়াক করানোর পর পরই তাঁর ইন্তেকাল হয়ে গেল। মৃত্যুর পূর্বক্ষণে মেসওয়াক করা এটা রাসূল সা. সুন্নত। হযরত আয়েশা রা. রাসূল সা. কে মেসওয়াক করিয়ে ছিলেন। আলহামদুলিল্লাহ ঐ সুন্নতটিও হযরত রহ. থেকে ছুটলো না।

তাকওয়া ও খোদাভীতি

যার অল্লরে যত বেশি তাকওয়া থাকে তিনি আল্লাহর নিকট তত বেশি সম্মানিত। কার অন্তরে কি পরিমাণ তাকওয়া আছে তা তার কাজেই প্রমাণ হয়। হযরত মুফতী সাহেব রহ. থেকে এমন শত শত ঘটনা প্রকাশ পায় যেগুলো প্রমাণ করে যে, তিনি তাকওয়ার সর্বোচ্চ মাকামে অধিষ্ঠিত ছিলেন। বিস্তারিত হযরত মুফতী সাহেব রহ. এর জীবনীগ্রন্থে আলোচনা করা হবে, ইনশাআল্লাহ।

উম্মাহর দরদী কাণ্ডারী

হযরত মুফতী সাহেব রহ. ছিলেন মুসলিম উম্মাহর প্রতি অত্যন্ত দরদী। এ কারণে তিনি শুধু মুসলিম উম্মাহর খবর জানার জন্য দৈনিক পত্রিকা পড়তেন। ইন্টারনেটের মাধ্যমে খবর জানতেন এবং মুসলিম উম্মাহর জন্য সবসময় দুআ করতেন।

প্রত্যেক অঙ্গ প্রত্যঙ্গ থেকে আল্লাহর যিকির

নোয়াখালী নিবাসী মুফতী গিয়াসুদ্দীন দা.বা. বলেন, নোয়াখালীস্থ ছাদুল্লাপুরে মুফতী সাহেব রহ. অনেকবার তাশরীফ নেন। তিনি ওখানের আড়াইশত বছর পূর্বের ইমামুদ্দীন গাজী রহ. মসজিদে অবস্থান করতেন। একবার শেষ রাত্রে তিনি ঐ মসজিদে যিকির করছিলেন। যিকিরের সময় তাঁর সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ পৃথক হয়ে প্রত্যেক অঙ্গ থেকে আল্লাহর যিকিরের আওয়াজ শুনা যাচ্ছিল। এ অবস্থাটি এক ব্যক্তি দেখে ফেললে ঘটনাটি তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশ করতে হযরত মুফতী সাহেব রহ. নিষেধ করে দেন। অনুরূপ ঘটনা কুতবুল আলম পটিয়ার মুফতী আজীজুল হক রহ. এবং হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী রহ. এর ব্যাপারেও ঘটেছিল। যা বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে।

সাহসিকতা

হযরত মুফতী সাহেব রহ. ছিলেন বিরল সাহসিকতার অধিকারী। তাঁর সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন ঘটনা তাঁর সাহসিকতা ও নির্ভিকতার প্রমাণ বহন করে।

একটি বড় মাদরাসার শুরার বৈঠক। হযরত মুফতী সাহেব রহ. ঐ বৈঠকের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। এক পক্ষ মাদরাসা দখলের পাঁয়তারা করেছিল। তারা সন্ত্রাসীর মাধ্যমে ফোন করাল যে, আপনি বৈঠকে আসবেন না, আসলে আপনার গাড়ি জালিয়ে দেয়া হবে। হযরত মুফতী সাহেব রহ. সাহসিকতার সাথে ঐ বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকায় ষড়যন্ত্রকারীদের সব ষড়যন্ত্র নস্যাত হয়ে যায়।

একবার নাটোরের একটি মাহফিলে একজন বক্তার কড়া কথায় গাইরে মুকাল্লিদরা গণ্ডগোল ও মারামরি শুরু করল। এমতাবস্থায় হযরত মুফতী সাহেব রহ. মাইক হাতে নিয়ে বয়ান শুরু করলেন। তিনি কয়েক ঘণ্টাব্যাপী আলোচনা করলেন। তাঁর আলোচনায় মারামারি থেমে যায় ও পরিবেশ শান্ত হয়ে যায়। তিনি বয়ানের শেষে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন, আগামীকাল দুপুর পর্যন্ত আমি আপনাদের এলাকায় থাকবো। তাকলীদ সম্পর্কে কারো কোনো প্রশ্ন থাকলে আমার কাছে গিয়ে করবেন। তাঁর সাহসিকতার এমন আরো শত শত ঘটনা রয়েছে।

তাঁর বদান্যতা

হযরত মুফতী সাহবে রহ. মিতব্যয়ীও ছিলেন, আবার দানবীরও ছিলেন। আমার জানামতে কোনো ব্যক্তি তাঁর নিকট এসে কিছু চেয়ে খালি হাতে ফেরত যায়নি। অনেক অসুস্থ ও অভাবী ছাত্র-শিক্ষক ও আত্মীয়-স্বজনকে তিনি মোটা অংকের টাকা দিয়ে সাহায্য করতেন। তাঁর নিকট মাদরাসায় যত মেহমান আসতো তাদের মেহমানদারী তিনি নিজের টাকা দিয়ে, নিজের হাদিয়ার জিনিস দিয়ে করতেন। মেহমানদারীর জন্য ভাউচার দিয়ে মাদরাসা থেকে কোনো টাকা নিতেন না।

প্রতি শুক্রবার তিনি মাদরাসা মসজিদে জুমুআর নামায আদায় করে বের হওয়ার সময় একশত টাকা করে মসজিদের দান বাক্সে রাখতেন।

কন্যা সন্তান জন্ম নিলে কেউ কেউ তো মনক্ষুণ্ন হয়। কিন্তু হযরত মুফতী সাহেব হুযুর রহ. তাঁর প্রথম কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করলে গরু জবাই করে তার আকিকা দিয়েছিলেন। অথচ একটি ছাগল জবাই করলেও আকিকার জন্য যথেষ্ট হয়ে যেতো।

লেনদেনের পরিচ্ছন্নতা

হযরত মুফতী সাহেব রহ. এর অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল লেনদেনের পরিচ্ছন্নতা। এতো পরিচ্ছন্ন লেনদেনের ব্যক্তির সংখ্যা খুবই বিরল। তাঁর জামার মধ্যে ভেতরের পকেট ছিল দুটি। বাম পাশের পকেটটি কলবের উপর থাকতো বিধায় তাতে মাদরাসার টাকা রাখতেন, ডান পাশের পকেটে রাখতেন ব্যক্তিগত টাকা। কোনো সময় হাদিয়ার টাকা নাকি মাদরাসার টাকা সন্দেহ হয়ে গেলে সব টাকা মাদরাসার জন্য দিয়ে দিতেন।

একবার তাঁর বাড়ির নির্মাণ কাজের জন্য আনা কিছু রড প্রয়োজন বশত: মাদরাসার মাঠে রাখা হয়। হযরত মুফতী সাহেব রহ. ব্যক্তিগত কাজে মাদরাসার জায়গা ব্যবহার হওয়ার কারণ দেখিয়ে সেটার জন্য শিক্ষকদের মাধ্যমে ভাড়া নির্ধারণ করে মাদরাসার ফান্ডে টাকা দিয়ে দেন।

হযরত মুফতী সাহেব রহ. জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার মজলিসে শুরার অন্যতম সদস্য ছিলেন। তাঁর ইল্লিকালের পর অনুষ্ঠিত তাঁর আলোচনা সভায় পটিয়া মাদরাসার মহাপরিচালক আল্লামা মুফতী আব্দুল হালীম বুখারী দা.বা. বলেন, একবার মুফতী সাহেব রহ. গাড়ি নিয়ে পটিয়া মাদরাসার শুরার অধিবেশনে অংশগ্রহণ করেন। আমি তাঁকে গাড়ি ভাড়া ও হাদিয়া হিসেবে ১০ হাজার টাকা প্রদান করলে তিনি এ বলে তা ফেরত দেন যে, “আমার একজন মুহাবক্ষতওয়ালা (মুরিদ) যাতায়াতের জন্য গাড়িটি দিয়েছেন। ভাড়া বাবত কোনো টাকা তিনি নিবেন না।”

অথচ তিনি চাইলে টাকাগুলো হাদিয়া হিসেবে গ্রহণ করতে পারতেন।

তাঁর রচনাবলী

মুফতী সাহেব রহ. রচনা ও লেখালেখির জগতে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। তিনি জীবনের শুরুর দিকে মাদরাসা গড়া, তা’লীম-তাদরীস, ওয়াজের সফর, ফতওয়া লিখনসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক দায়িত্ব পালনের কারণে স্বতন্ত্র পুস্তকাদি বেশি রচনা করার সময় সুযোগ পাননি। তবে তাঁর লিখিত ফতওয়াসমূহ একত্রিত করলে বহু ভলিয়মের বিশাল গ্রন্থের রূপ নিবে। হায়াতের শেষের দিকে এসে বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ায় বাইরের সফরে তেমন যেতে না পারায় এ সুযোগকে তিনি কাজে লাগিয়ে মাদরাসায় অবস্থান করে ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত অনেকগুলো যুগোপযোগী বই-পুস্তক রচনা করে গেছেন। এর মধ্যে ‘মাযহাব মানা ওয়াজিব কেন’ অন্যতম। বইটিতে তিনি কুরআন, হাদীস ইত্যাদির উদ্বৃতি দিয়ে বিস্তারিতভাবে লা-মাযহাবী ফেৎনার স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। তাঁর অন্য রচনাবলীর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, স্বীয় শাইখ কুতবুল আলম শাহ সোলতান আহমদ নানুপুরী রহ. এর জীবনীগ্রন্থ ‘জীবন ও আদর্শ’। যা প্রায় চারশত পৃষ্ঠাব্যাপী। অন্তরে আল্লাহর মুহাব্বাত লাভ এবং জীবন গঠনের মহৌষধ রয়েছে উক্ত জীবনীগ্রন্থে। এছাড়া তাঁর রচনাবলীর মধ্যে রয়েছে- আল্লাহর যিকির রূহের খোরাক, তারাবীর নামায বিশ রাকাত সুন্নতে মুয়াক্কাদা, আমীন চুপে চুপে বলা মুস্তাহাব, ইসলামের দৃষ্টিতে দাড়ি, চেয়ারে বসে নামায আদায় বিষয়ক ফতওয়া, বোমাবাজদের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ফতওয়া, যিকরে জলী ও খফী (উর্দু), ইসলামের দৃষ্টিতে শবীনা খতম ও মাথা কামানো, ওহাবী কে? সুন্নী কে?, শরয়ী পর্দা ও মহিলাদের জামাতে নামায বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ ফতওয়া। তাছাড়াও হযরতের ইসলাহী বয়ানের ৯টি বই প্রকাশিত হয়েছে।

সন্তানসন্ততি

হযরত মুফতী সাহেব রহ. এর ৫ ছেলে (যথাক্রমে ১. মাও. তৈয়ব সোলতানী ২. মাওলানা ক্বারী মুহাম্মদ কাসেম ৩. হাফেয মুফতী তাহের ৪. ইব্রাহীম ৫. ইসমাঈল) এবং ৭ মেয়ে ও ৩৬ জন নাতী নাতনী রেখে তিনি মারা যান।

ইন্তেকাল

ক্ষণজন্মা এই মহামনীষী ইন্তেকালের পূর্বে একাধারে রাজধানীর ধানমণ্ডির গ্রীন লাইফ হাসপাতাল ও বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সর্বশেষ (ঢাকার ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র মতে) ফেনী আলকেমী হাসপাতালে চিকিৎসারত থাকাকালে হুযুরের শেষ অসিয়ত অনুযায়ী মাদরাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাদরাসাতেই ২৩ এপ্রিল ২০১৮ ইং সোমবার, সকাল ৯ টা ৪০ মিনিটে লাখো লাখো ভক্ত, মুরীদান, ছাত্র জনতা ও পরিবারের সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে এই নশ্বর পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে মহান রবের ডাকে সাড়া দিয়ে আখেরাতে পাড়ি জমান।

জানাযা পূর্ব অবস্থা

ফেনীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত হতে অসংখ্য ওলামা, ফুজালা, মুরীদান, ভক্তবৃন্দ ও জনসাধারণ তাঁর জানাযায় অংশ গ্রহণ করেন। পুরো জানাযাস্থল জনসমুন্দ্রে পরিণত হয়। হযরতের প্রতিষ্ঠিত জামিয়া সোলতানিয়া লালপোল’র মাঠ, ভবনসমূহের সকল তলা, আশপাশের রোড-ঘাট লালপোল বাজার, লালপোল বিশ্বরোড ও রোডের বিপরীত পার্শ্ব পর্যন্ত এক কিলোমিটারব্যাপী রাস্তা কানায় কানায় ভরে যায়। এছাড়াও অসংখ্য মানুষ কয়েক ঘণ্টাব্যাপী যানজটে আটকা পড়ার কারণে জানাযার নামাযে অংশগ্রহণ করতে পারেননি।

হযরতের নামাযে জানাযার পূর্বে অনেক ওলামায়ে কেরাম বক্তব্য রাখেন। এতে তাঁর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন অনেকে। অধিকাংশের বক্তব্যের মূল কথা ছিল, আজ আমরা শরীয়ত ও তরীকতের রাহবারকে হারালাম। আমরা এমন এক অবিভাবককে হারালাম যাঁর অভাব কখনো পূর্ণ হবার নয়। ওলামা বাজার মাদরাসার মুহতামিম, শাইখুল হাদীস ও জামিয়া সোলতানিয়া লালপোলের মজলিসে শূরার সদস্য আল্লামা নূরুল ইসলাম আদীব সাহেব দা.বা জানাযা পূর্ব বক্তব্যে মজলিসে শুরার সিদ্ধাল্ল অনুযায়ী মুফতী সাহেব রহ. এর মেজো সাহেবজাদা মাওলানা ক্বারী মুহাম্মদ কাসেম সাহেব দা.বা. কে হুযুরের মাদরাসার পরবর্তী মুহতামিম ঘোষণা দেন। নামাযে জানাযার ইমামতি করেন হযরতের বড় সাহেবজাদা মাওলানা তৈয়ব সোলতানী।

হযরত রহ. এর মৃত্যুর আগে জামিয়া সোলতানিয়ার জামে মসজিদের উত্তর পার্শ্বে একটি নতুন কবরস্থান তৈরি করা হয়েছিল। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সময় জানাযার নামায শেষে তাঁকে সেখানেই দাফন করা হয়। পরে হযরতের শাইখপুত্র সাহেবজাদায়ে নানুপুরী রহ. হযরত মাওলানা এমদাদুল্লাহ সাহেব উক্ত কবরস্থানের নাম করন করেন, ‘মাকবারায়ে সাঈদিয়া’।

মুফতী সাহেব রহ. ছিলেন দেশের একজন খ্যাতনামা বুযুর্গ ব্যক্তি, মুহাদ্দিস, মুফতী, আদর্শ ওস্তাদ ও একজন কামেল পীর। তিনি ছাত্র-ওস্তাদ ও সর্বস্তরের জনতার উন্নত ও নৈতিক চরিত্র গঠনে সারাজীবন মেহনত করে গেছেন। কুরআনের শিক্ষা বিস্তারে এবং দ্বীনের বহুমুখী খেদমতে সারা জীবন ত্যাগ ও কুরবানী দিয়ে গেছেন।

তাঁর ইসলাহী ও ইলমী খেদমাতগুলো ইতিহাস হয়ে থাকবে। ফেনী লালপোল সোলতানিয়া মাদরাসা তাঁর অমর কীর্তি। দেশের বিভিন্ন প্রাল্লে ছড়িয়ে আছে তাঁর লক্ষ লক্ষ ছাত্র, ভক্ত ও মুরীদান। তাঁর হাতে তৈরি হয়েছে বহু আলেম, মুফতী, মুহাদ্দিস, খোদাপ্রেমিক ও দ্বীনের রাহবার। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতের আলা মাকাম নসীব করুন।


লেখক : নায়েবে মুহতামিম, জামিয়া সোলতানিয়া লালপোল, ফেনী,

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *