বাণিজ্য–যুদ্ধে গ্রাফাইট রপ্তানিতে চীনের নতুন পদক্ষেপ

বাণিজ্য–যুদ্ধে গ্রাফাইট রপ্তানিতে চীনের নতুন পদক্ষেপ

পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম: জাতীয় নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে খনিজ ধাতু গ্রাফাইট রপ্তানি সীমাবদ্ধ করার পরিকল্পনা নিয়েছে এর শীর্ষ বৈশ্বিক উৎপাদনকারী দেশ চীন। দেশটির বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে কিছু গ্রাফাইটপণ্যের জন্য আলাদা রপ্তানি অনুমতির প্রয়োজন হবে। চীনের এই সিদ্ধান্তের প্রভাব বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজারে পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।

মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপের তথ্য অনুসারে, চীন একই সঙ্গে বিশ্বের শীর্ষ গ্রাফাইট উৎপাদনকারী ও রপ্তানিকারক দেশ। বিশ্ববাজারে খনিজ গ্রাফাইটের ৬৭ শতাংশ সরবরাহ আসে চীন থেকে। চীনের গ্রাফাইটের শীর্ষ ক্রেতাদের মধ্যে রয়েছে জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়া। খবর রয়টার্স, সিএনবিসি ও সিএনএনের।

অন্যদিকে বৈদ্যুতিক গাড়ির (ইভি) জন্য প্রয়োজনীয় গ্রাফাইট পরিশোধনের মাধ্যমে ৯০ শতাংশের বেশি সরবরাহ করে থাকে দেশটি। বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি তৈরির জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি খনিজ হচ্ছে গ্রাফাইট। ইভির ব্যাটারিতে (অ্যানোডে) গ্রাফাইট ব্যবহার করা হয়। ইভি ছাড়াও সেমিকন্ডাক্টর, মহাকাশ, রাসায়নিক ও ইস্পাত শিল্পে গ্রাফাইটের ব্যবহার রয়েছে।

চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, বিশ্বব্যাপী গ্রাফাইটের সরবরাহব্যবস্থা, শিল্পশৃঙ্খলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য এবং জাতীয় নিরাপত্তা ও স্বার্থকে আরও ভালোভাবে সুরক্ষিত করার জন্য গ্রাফাইটের রপ্তানির বিষয়ে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কোনো নির্দিষ্ট দেশকে লক্ষ্য করে এটা করা হয়নি।

এমন একসময় চীন গ্রাফাইট রপ্তানিতে বিধিনিষেধ দিল, যখন অনেক দেশ (মূলত পশ্চিমা দেশগুলো) চীনা কোম্পানিগুলোর ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। যেমন চীনে তৈরি বৈদ্যুতিক গাড়ির ওপর সম্প্রতি শুল্ক আরোপের কথা জানায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র সরকার গত সপ্তাহের শুরুতে চীনা কোম্পানিগুলোর কাছে সেমিকন্ডাক্টর সরবরাহের ওপর বিদ্যমান নিষেধাজ্ঞার আওতা আরও বাড়িয়েছে। বিশেষ করে শীর্ষ চিপ প্রস্তুতকারক কোম্পানি এনভিডিয়ার তৈরি উন্নত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চিপ চীনের কাছে বিক্রির বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গতকাল শুক্রবার রাজধানী ওয়াশিংটনে ইইউ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানেও গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন খনিজ পদার্থের সরবরাহ নিয়ে আলোচনা হয়।

লন্ডনভিত্তিক অ্যালকেমি ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্টের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা কিয়েন হুয়েন বলেন, ‘গ্রাফাইট নিয়ে চীনের এমন বড় ও অপ্রত্যাশিত পদক্ষেপটি আমাদের অবাক করে দিয়েছে। কোনো ধরনের পূর্বাভাসের অনেক আগেই এমন একটি সিদ্ধান্ত নিল দেশটি।’

কানাডাভিত্তিক কোম্পানি নর্দার্ন গ্রাফাইটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) উগো জ্যাকমিন বলেন, এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে চীন জানিয়ে দিল যে তারা আর আপনাকে (পশ্চিমা দেশগুলোকে) বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরিতে সাহায্য করতে যাচ্ছে না। আপনাকে এটি করার জন্য আলাদা নিজস্ব উপায় খুঁজে বের করতে হবে।

গ্রাফাইটের আগে চিপ তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় আরও কিছু পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল চীন সরকার। যেমন গত ১ আগস্ট গ্যালিয়াম ও জার্মেনিয়াম রপ্তানির ওপর বিধিনিষেধ দেয় দেশটি। এতে সেই ধাতুগুলোর রপ্তানি কমে যাওয়ায় বিশ্ববাজারে এসবের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে।

চীনের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত টেসলার মতো বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতাদের জন্য উৎপাদন খরচ বাড়াতে পারে। পাশাপাশি গ্রাফাইটের বিকল্প উৎসের জন্য তাদের দৌড়ঝাঁপও বাড়বে।

ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির তথ্য অনুসারে, বিশ্বব্যাপী সম্পূর্ণ ব্যাটারিচালিত বৈদ্যুতিক যানবাহন ও হাইব্রিড গাড়ির বিক্রি বাড়ছে। গত বছর ১ কোটির বেশি ব্যাটারিচালিত গাড়ি বাজারে এসেছে, চলতি বছর যা ১ কোটি ৪০ লাখে পৌঁছাতে পারে।

বিশ্বব্যাপী বৈদ্যুতিক গাড়ির চাহিদা বাড়ায় গাড়ি প্রস্তুতকারকেরা চীনসহ বিভিন্ন গ্রাফাইট উৎপাদনকারী দেশের কাছে যাচ্ছে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় বাজারে গ্রাফাইটের সংকট রয়েছে। এর ফলে চীনের নতুন বিধিনিষেধের কারণে সেই সংকট আরও বাড়তে পারে। বিশেষ করে যেসব দেশ গ্রাফাইটের জন্য চীনের ওপর বেশি নির্ভরশীল, তারা চাপে পড়বে।

হিউন্দাই মোটর সিকিউরিটিজের একজন বিশ্লেষক কাং ডং-জিন বলেন, দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানিগুলো গ্রাফাইট আমদানির জন্য চীনের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করে। এর ফলে এখন তাদের যুক্তরাষ্ট্র বা অস্ট্রেলিয়ার মতো বিকল্প উৎস খুঁজতে হবে। কিন্তু এতে তাদের ব্যয়ের বোঝা অনেক বৃদ্ধি পাবে।

এদিকে চীনের নিষেধাজ্ঞার প্রভাব যাচাই করে দেখতে গতকাল দেশটির ব্যাটারি ও এর উপাদান নির্মাতাদের সঙ্গে একটি বৈঠক করেছে দক্ষিণ কোরিয়ার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে চীনের নতুন পদক্ষেপের ‘পরিচালনাসংক্রান্ত নীতি’ সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার পরিকল্পনা করছে জাপান। রপ্তানির বিষয়ে চীন যদি বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার নিয়ম লঙ্ঘন করে, তাহলে দেশটি ‘যথাযথ পদক্ষেপ নেবে’ বলে জানিয়েছেন জাপান সরকারের এক মুখপাত্র।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *