বিস্ফোরক বল!
আহমাদ কাশফী : বাবা, বল কিন্না দাও! প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে বাবার ফ্যাকাশে মুখের দিকে চেয়ে থাকে রাতুল।
রাতুলের হতদরিদ্র পিতা আবুল মিয়া নিজ সন্তানকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খোঁজে পায় না।
বাবা, বল কিন্না দিবা না?
সন্তোষজনক উত্তরের আশায় আবারো প্রশ্ন করে রাতুল।
মাসের দশদিন গেছে গা অহনো ঘর ভাড়া দিবার হারি নাই। আর তুই আছোছ বল লয়া।
যা ভাগ!
বাবার ধমক খেয়ে অভিমান করে
মাঠের দিকে চলে যায় রাতুল।
পড়ন্ত বিকেল। সূর্যটা পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে। ধূসর বর্ণের গেঞ্জি আর ছেড়া নোংরা একটি কালো থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরে মাঠের এককোণে দাঁড়িয়ে আছে রাতুল।
তিলোত্তমা নগরীর অ-তিলোত্তমা খেলার মাঠ। যেখানে একটির বেশী দুটি ক্রিজ হলে ক্রিকেট খেলা দুষ্কর। সেখানে প্রায় ১০/১২টি ক্রিজে চলছে পূর্ণোদ্দমে ক্রিকেট ম্যাচ।একপ্রান্তে বাদাম, আইসক্রিম ওয়ালারা পসরা সাজিয়ে বসে আছে। অপরপ্রান্তে নোংরা পানির উপর গড়ে উঠেছে পরিত্যাক্ত ময়লার বাগাড়।
মজার বিষয় হলো, মাঝেমধ্যে দু একটা বল এসে ময়লার বাগাড়ে আছড়ে পড়ে। আর ওৎপেতে থাকা বস্তির ছেলেগুলো নিয়ে দৌড়ে পালায়।
আজ রাতুল বল কুঁড়ানোর আশায় তাদের সাথে যোগ দিয়েছে। চাতক পাখির ন্যায় একদৃষ্টে চেয়ে আছে কখন একটি বল এসে ময়লার বাগাড়ে পড়বে। আর সাথে সাথে খপ করে কুঁড়িয়ে নিয়ে পালাবে।
হঠাৎ একটি বল এসে রাতুলের সামনে আছড়ে পড়ল। চোখের পলকে বাজপাখির মত ঝাঁপ দিয়ে ধরে রাতুল পালানোর পথ ধরল। কিন্তু, ভাগ্যের লিখন খারাপ ছিল, বিধায় বল আর কপালে জুটলো না।মাস্তান টাইপের ইয়ামোটা কৃষ্ণকায় এক যুবক ছেলে এসে রাতুলের পথ আগলে দাঁড়িয়ে বিশ্রী কয়েকটি গালি দিয়ে জোরপূর্বক বল কেড়ে নিল।
পরে আরো দু’তিনটি বল এসে বাগাড়ে পড়লেও তা আর রাতুলের ভাগ্যে জোটেনি।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। অন্ধকার ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। শহরের সাদালাইটগুলো জ্বলে উঠছে। মাঠে খেলতে আসা ছেলেগুলো ইতোমধ্যে চলে গেছে।বস্তির বল টোকাইয়ে ছেলেরাও চলে গেছে। নির্জন মাঠের একপ্রান্তে অভিমানী রাতুল একা দাঁড়িয়ে আছে।
হঠাৎ রাতুলের চোখ আটকে গেল ময়লাস্তূপের উপর পরে থাকা একটি চকচকে নতুন দামী ব্যাগের উপর। রাতুল লোভাতুর হয়ে নোংরা পানির উপর দিয়ে হেঁটে ব্যাগটির নিকট চলে গেল। সাত-পাঁচ না ভেবেই চেইন খুললো । ভেতরে বল সাদৃশ্য একডজন লাল বল দেখতে পেলো।
রাতুলের চোখমুখ বিস্ময়ে ছানাবড়া! বল টোকাতে এসে পেয়ে গেছে কত্তগুলো বল।রাতুল অকস্মাৎ যেন জ্ঞান ফিরে পেলো। মনে পড়লো মাইকিংয়ের কথা। এগুলোতো আর কিছু নয়, বিস্ফোরক বল। তখনই খুশিতে আত্মহারা সে। দু’তিন দিন আগে শহরের বিভিন্ন জায়গায় পোস্টার -মাইকিং করা হয়েছে বিস্ফোরক দ্রব্য ধরিয়ে দিতে পারলে একলক্ষ টাকা পুরস্কার।বিশ টাকার বল টোকাতে এসে একলক্ষ টাকার মালিক হয়ে যাবে সে।রাতুলের যেন আনন্দ আর ধরে না।
বাবলু মিঁয়া। স্থানীয় জননেতা, রাতুলদের বস্তির মালিক। আয়েশি ভঙ্গিতে পায়ের উপর পা তুলে মাঠের প্রবেশদ্বারের একটি দোকানে চা খাচ্ছে। রাতুল সরাসরি চলে গেল তার কাছে।কানে ফিসফিস করে বললো, বাবলু মামা! একটু এইদিকে আহো,দেইখ্যা যাও মাঠের কোণায় কী! পুলিশের নাম্বারে একটা কল দেও। বাবলু মিয়া প্রথমে এই ছোকরার কথায় কর্ণপাত করলো না। রাতুল আরো আশ্বাস দিয়ে বললো, মামা! অনেক দামি দামি জিনিস! অর্ধেক তোমার বাকিটা আমার।বাবলু মিয়া এবার টাকার আশ্বাস পেয়ে চলে এল রাতুলের সাথে। মাঠের মাঝখানে এসে রাতুল সব বুঝিয়ে বললো বাবলু মিয়াকে।
কিছুক্ষণ পর পুলিশ এসে ময়লার বাগাড় থেকে উদ্ধার করলো একব্যাগ ককটেল। লোকজন এসে জড়ো হতে লাগলো মাঠে। খবর পেয়ে ছুটে এল পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ টিম, পুলিশের বড়বড় অফিসার, সাংবাদিক, স্থানীয় জননেতা, গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ। তাদের সামনেই রাতুলের হাতে তুলে দেওয়া হলো একলক্ষ টাকার একটি চেক। মাইকে ঘোষণা করা হলো, বল টোকাতে এসে বিস্ফোরক বল উদ্ধার করে দেওয়ায় একলক্ষ টাকা পাচ্ছে রিকশাচালক আবুল মিয়ার ছেলে রাতুল ওরফে বিস্ফোরক বল রাতুল।