বৈশাখ আসার আগেই কালবৈশাখী ছোবল

বৈশাখ আসার আগেই কালবৈশাখী ছোবল

নিজস্ব প্রতিবেদক ● বৈশাখ আসার আগেই কালবৈশাখী তার ছোবল হানছে প্রকৃতিতে। গত কয়েকদিন ধরেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বজ্রঝড় বয়ে যাচ্ছে। প্রবল ঝড়ের সঙ্গে হচ্ছে ভারী ও মাঝারি বৃষ্টিপাতও। এতে একদিকে কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে, উঠতি আলু, মশুর, ভুট্টা ও রবিশস্যের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষক। সাধারণত, এপ্রিল থেকে মে (বৈশাখ) মাসে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয় কালবৈশাখী। গ্রীষ্মঋতুর সঙ্গেই হাত ধরাধরি করে এ প্রাকৃতিক তা-বের আগমন ঘটে। তবে বিগত কয়েক বছর ধরেই বসন্তকালেই দেখা দিচ্ছে কালবৈশাখী। এতে উঠতি রবিশস্য আর আমের মুকুল ঝরে যাওয়া নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন কৃষকরা। চলতি মৌসুমেও এমন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

এখন চলছে ফাল্গুন মাস। বৈশাখ মাস আসতে এখনও মাঝখানে চৈত্র মাস রয়ে গেছে। এর মধ্যেই কালবৈশাখীর তা-ব শুরু হয়ে গেছে। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রবল ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে মাঝারি বৃষ্টিপাত হয়েছে। রাজশাহী থেকে আমাদের প্রতিনিধি জানান, সন্ধ্যা পৌনে ৬টা থেকে প্রায় আধাঘণ্টাব্যাপী ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে মাঝারি বৃষ্টিপাত হয়েছে রাজশাহী অঞ্চলে। আবহাওয়া অফিস জানায়, মাঝারি বৃষ্টিপাতের সঙ্গে কালবৈশাখির ঝড় হয়েছে। প্রায় আধা ঘণ্টায় ২২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে এ অঞ্চলে। বৃষ্টিপাত ও ঝড়ো হাওয়ায় উঠতি আলু, মশুর, ভুট্টা ও রবিশস্যের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষকরা।

এদিকে বৃষ্টিপাতের কারণে নগরীর নিম্নাঞ্চল উপশহর, কোর্ট এলাকার লক্ষীপুর, গুড়িপাড়া, হড়গ্রাম ও কাজলা এলাকায় সড়কে পানি উঠে যায়। দীর্ঘদিন ধরে ড্রেন পরিষ্কার না করায় ড্রেন উপচে পানি জমে যায় বিভিন্ন সড়কে। ছুটির দিনের বিকেলে হঠাৎ বৃষ্টিপাতে ঘর থেকে বের হওয়া মানুষ বিপাকে পড়েন।

রাজশাহী আবহাওয়া অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষক রাজিব খান জানান, সকাল থেকেই মেঘলা আবহাওয়া বিরাজ করছিলো। পৌনে ৬টার দিকে মাঝাড়ি ধরনের বৃষ্টিপাত ও কালবৈশাখীর ঝড় বয়ে যায়। এটি এ মৌসুমের প্রথম বৃষ্টিপাত ও কালবৈশাখী। এর আগে গত ৭ মার্চ বিকেলে নোয়াখালীর হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপে কালবৈশাখীর আঘাতে দুই শতাধিক কাঁচা ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। বেশ কিছু গাছপালা উপড়ে পড়েছে। এ ছাড়া কয়েকটি মসজিদ ও মক্তবের টিনের ছাল উড়ে গেছে। গাছপালা ভেঙে রাস্তাঘাটে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে। এ সময় ছুটোছুটি করতে গিয়ে টিনের আঘাতে কমপক্ষে আট-দশজন আহত হয়েছেন।

প্রসঙ্গত, কালবৈশাখী এক ধরনের বজ্রঝড় , যা সচরাচর এপ্রিল-মে (বৈশাখ) মাসে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। স্থানীয়ভাবে এ বজ্রঝঞ্ঝা কালবৈশাখী নামেই অধিক সুপরিচিত। ‘কাল’ শব্দের অর্থ ঋতু , আবার কালো বর্ণকেও বোঝানো হয়ে থাকে। কালবৈশাখীকে কখনও কখনও ‘কালোবৈশাখী’ নামেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে যার অর্থ কালো বর্ণের বৈশাখী মেঘ। ঘন, কালো বর্ণের মেঘ ও ঝঞ্ঝা এবং এর ধ্বংসাত্মক প্রকৃতির জন্যই এ নামকরণ। ধ্বংসকারীকে ‘কাল’ বলেও ডাকা হয়। গ্রীষ্ম ঋতুর সঙ্গে হাত ধরাধরি করে এ ঝড়ের আগমন ঘটে। স্থানীয়ভাবে কোনো এলাকার ভূ-পৃষ্ঠ অত্যাধিক তাপমাত্রা অথবা অন্যান্য কারণে উত্তপ্ত হয়ে উঠলে বায়ুম-ল যথেষ্ট অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে এবং এ ঝড়ের জন্ম হয়। উত্তপ্ত, হাল্কা ও অস্থির বায়ু ঊর্ধ্বমুখী উঠতে থাকে এবং সমতাপীয় সম্প্রসারণ প্রক্রিয়ায় বায়ুস্তর সম্পৃক্ত বিন্দুতে না পৌঁছা পর্যন্ত শীতল হতে থাকে এবং কিউমুলাস মেঘ সৃষ্টি হয়। বায়ুম-লের অস্থিরতা অব্যাহত থাকলে কিউমুলাস মেঘ উল্লম্বভাবে কিউমুলোনিম্বাস মেঘ গঠন করে এবং পরবর্তী সময়ে বজ্রঝঞ্ঝার সৃষ্টি হয় যা সবার কাছে কালবৈশাখী নামে পরিচিত। সাধারণ বর্ষণের সঙ্গে এ ঝড়ের মূল পার্থক্য হচ্ছে, এ ঝড়ের সঙ্গে সবসময়ই বিদ্যুৎ চমকায় ও বজ্রপাত হয়। এটি একটি তাপগতিক  প্রক্রিয়া যেখানে ঘনীভবনের সুপ্ত তাপ দ্রুত ঊর্ধ্বারোহী বায়ু গতিশক্তিতে রূপান্তরিত হয়।

৩ নম্বর সতর্ক সংকেত : বঙ্গোপসাগরে দুটি লঘুচাপ থাকায় রাজধানীসহ সারাদেশে ভারী থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। কোথাও কোথাও বজ্রসহ ভারী বৃষ্টি এবং শিলাবৃষ্টিও হচ্ছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। বঙ্গোপসাগর ও উপকূলীয় এলাকার ওপর দিয়ে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাওয়ার শঙ্কায় চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরকে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অফিস। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে কুতুবদিয়ায়, ৯০ মিলিমিটার। এছাড়া সারা দেশেই ১০ মিলিমিটারের ওপরে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আরও দুদিন সারা দেশে বৃষ্টিপাতের খবর জানিয়েছে আবহাওয়াবিদরা। শনিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ঢাকায় ৩৮ মিলিমিটার, বরিশালে ২০ মিলিমিটার, খুলনায় ২৮ মিলিমিটার, রাজশাহীতে ২২ মিলিমিটার, সিলেটে ২৬ মিলিমিটার, চট্টগ্রামে ১৯ মিলিমিটার এবং ময়মনসিংহে ২৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অফিস। সৈয়দপুর ও রাজারহাট ছাড়া সারাদেশেই বৃষ্টিপাত হয়েছে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ আব্দৃল বারিক। আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস বিভাগের একজন আবহাওয়াবিদ জানান, রবিবার থেকে আবহাওয়ার কিছুটা উন্নতি হবে।

আবহাওয়া অফিসের সর্বশেষ পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, পশ্চিমা লঘুচাপের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও এর আশপাশের এলাকায় অবস্থান করছে। অপর একটি লঘুচাপের বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। ঢাকা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, রংপুর খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ী দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে বিক্ষিপ্তভাবে শিলা বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, লঘুচাপের বর্ধিতাংশ উত্তরপূর্ব বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত থাকায় উত্তর বঙ্গোপসাগর এলাকায় গভীর সঞ্চালণশীল মেঘমালা তৈরি অব্যাহত রয়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগর, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা এবং সমুদ্র বন্দরগুলোর ওপর দিয়ে ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে।

চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরের জন্য জারি করা তিন নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। এছাড়া উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারগুলোকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলেছে আবহাওয়া অফিস। আগামী চার থেকে পাঁচদিনে আবহাওয়ার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই বলে জানায় আবহাওয়া অফিস। ঢাকায় শুক্রবার সন্ধ্যার পর থেকে তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়। অনেক স্থানে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতারও। ফলে গভীররাত পর্যন্ত মানুষকে যানজটে ভুগতে হয়েছে। শনিবার সকালেও রাজধানীতে বৃষ্টির খবর পাওয়া গেছে।

patheo24/mr

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *