‘ভারতনামা’ সুখপাঠ্য; ভ্রমণকাহিনীর ইতিহাসে অনবদ্য
আফফান বিন শরফুদ্দীন ● অনাদিকাল থেকেই সৌন্দর্যের পূণ্যভূমি হিসেবে ভারতের সুখ্যাতি রয়েছে। এর একেকটি এলাকা একেক ধরনের অপার্থিব সৌন্দর্যের লীলাভূমি। প্রতিটি অঞ্চলেই চোখে পড়ে নয়নাভিরাম নৈসর্গিক সব দৃশ্য। কিন্তু ভারত শুধু সৌন্দর্য বৈচিত্র্যের জন্যই বিখ্যাত নয়। এর রয়েছে দীর্ঘদিনের জাতিগত বৈচিত্র্যের ইতিহাস।
আর্য, মৌর্য, দ্রাবিড়, পাঠান, মোগল, আরব, গ্রিক, রোমান, শক, হুন, ডাচ, পর্তুগিজসহ অসংখ্য জনগোষ্ঠীর মানুষ এখানে মিশে আছেন একই স্রোতে। সবার মতাদর্শগত ও ধর্মীয় ভিন্নতা সত্ত্বেও আবহমান কাল ধরে তারা সহাবস্থানের অনন্য নজির স্থাপন করেছিলেন। তাই বিগত আড়াই হাজার বছরেরও বেশি সময় জুড়ে পৃথিবীর বুকে অন্যতম একটা পরাশক্তি হিসেবে পরিচিতি ছিল এই শতধা বৈচিত্র্যময় ভারতভূমি। কিন্তু দুঃখজনকভাবে গত দেড় শতাব্দীর ইতিহাস বড় করুন। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ বেনিয়ারা এই অঞ্চলের প্রধান দু’টি ধর্মবিশ্বাসের মানুষের মাঝে জাতিগত দাঙ্গার যে ঘৃন্য বীজ বপন করে গিয়েছিল এপর্যন্ত তার বলি হয়েছেন প্রায় সত্তর লক্ষাধিক মানুষ!
একবিংশ শতাব্দীতে এসে সেই দ্বন্দ্ব পৌঁছেছে চরমে। অসাম্প্রদায়িকতার ঐতিহ্য দুমড়ে মুচড়ে পড়ে আছে দিল্লির রাজপথে, আসাম বিহার আর উত্তরপ্রদেশের অসংখ্য জনপদে। ভূ প্রকৃতির স্বর্গীয় দৃশ্যপটেই চলছে এখন সাম্প্রদায়িক পিশাচদের নারকীয় তাণ্ডব। আর এই অগ্নিগর্ভ সময়েই লেখক ‘ফয়জুল্লাহ আমান’ সফর করেছেন ভারতের অভ্যন্তরে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে চেন্নাই। মহিশুর থেকে কালিকট। অমৃতসর থেকে সাহারানপুর। দেওবন্দ থেকে দিল্লি তিনি ঘুরেছেন অসীম তৃষ্ণা নিয়ে। উত্তর ও দক্ষিণ ভারত, পূর্ব ও পশ্চিম ভারতের প্রায় সর্বত্রই তিনি গিয়েছেন। একেবারে কাছ থেকে দেখেছেন সেখানকার অধিবাসীদের জীবন যাত্রা।
একসময় ভারতে পড়াশোনার সুবাদে ভারতের প্রায় প্রতিটি জনগোষ্ঠীর লোকজনের সাথেই তার চেনাজানা রয়েছে। পাশাপাশি ইতিহাস, সাহিত্য, সমাজদর্শন, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব ও অন্যান্য বিষয়ে বিপুল পড়াশোনার কল্যাণে প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্বতা ও ঐতিহ্যগত বিষয়গুলো সম্পর্কে তার রয়েছে স্বচ্ছ ধারনা। একজন মুসলাম শিক্ষাবিদ হিসেবে তিনি দেখেছেন সেখানকার মুসলমানদের জ্ঞানগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নের নিরন্তর প্রয়াস। অনুকূল ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজেদেরকে টিকিয়ে রাখার বহুমাত্রিক প্রচেষ্টা।
আর লেখকের এই নিবিড় পর্যবেক্ষণ, ভূ প্রকৃতির উন্মাতাল সৌন্দর্যের বিবরন, চিন্তা বৈচিত্র্য সত্ত্বেও সেখানকার মানুষের সহাবস্থানের পথ পদ্ধতি কিংবা উত্তাল পরিস্থিতির উত্তরনের কৌশল সম্পর্কে লেখকের মূল্যায়ন নিয়েই তিলে তিলে গড়ে উঠেছে ‘ভারতনামা।’
শাদা কাগজে আবেগ অনুভূতির চিত্রায়ন পৃথিবীর সবচেয়ে দুরূহ কাজগুলোর একটা। কিন্তু এই কাজটিই লেখক আশ্চর্য দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করেছেন। ভ্রমণকাহিনীর ইতিহাসে ‘ভারতনামা’ নিঃসন্দেহে এক অনবদ্য সংযোজন। বলতে দ্বিধা নেই যে, আমার পড়া সবচেয়ে সুখপাঠ্য ও বৈচিত্র্যময় ভ্রমণকাহিনীর একটি হচ্ছে এই ‘ভারতনামা’। বর্তমানে বুলবুল সরওয়ারের পরে ভ্রমণকাহিনীর ক্ষেত্রে এই লেখকেই আমি সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ।
তবে তাড়াহুড়া করে ছাপানোয় বইয়ের বাইন্ডিং ও গেটাপ মনমতো হয়নি। ঐতিহ্যের মতো প্রকাশনীর কাছে আমরা এটা আশা করিনি। আমাদের সর্বভূক পাঠকদের অন্যতম প্রিয় প্রকাশনী হিসেবে ‘ঐতিহ্য’ সামনের দিনগুলোতে তাদের ঐতিহ্য সযত্নে ধরে রাখবে বলেই আমি আশাবাদী।
বই: ভারতনামা
লেখক: ফয়জুল্লাহ আমান
ধরণ: ভ্রমণকাহিনী
প্রকাশনী: ঐতিহ্য
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১১০
মুদ্রিত মূল্য: ২১০ টাকা
বইমেলায় ২৫% ছাড়ে পাওয়া যাচ্ছে ১৫৮ টাকায় ১৪ নাম্বার প্যাভিলিয়নে।