ভারতসফর ● সদরুদ্দীন মাকনুন ●
দুপুরের খাবারের পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আসরের নামাজের পর হযরত এলেন এবং আব্বাকে নিয়ে আজমীরের খানকার মুতাওয়াল্লীদের দাওয়াতে অংশগ্রহণ করতে চলে যান। আমি মাওলানা রশিদ আহমদ ও হাফেজ সাহেব আজমীরের শহরটা একটু ঘুরে দেখার জন্য বের হই।
ভারতে হাম্দনাত বা কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠানগুলো অনেক জনপ্রিয়। এদের মিডিয়াসহ সবধরনের টেলিভিশন অনুষ্ঠানে কবিতা জনপ্রিয়। উর্দু বা হিন্দিতে তারা মুশাআরা অনুষ্ঠান বলে থাকে। ভাবছিলাম, আর যা-ই হোক, মুশাআরা অনুষ্ঠান মিস করা যাবে না।
রাতের খাবার শেষে ৮টার দিকে আলমী নাতে মুশাআরায় অংশগ্রহণ করার জন্য হোটেল ত্যাগ করি। যেতে যেতে মনে পড়লো ২০০৮ সালে আমরা যখন আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান শিল্পী জুনায়েদ জামশেদকে নিয়ে হামদনাত মাহফিল করি তখন আমাদের দেশের অনেকেই বেদআতি কাজ হচ্ছে বলে বিরোধিতা করেন। অনেকটা শোরগোল বাঁধিয়ে দিয়েছিলো। অথচ আজ দারুল উলূম দেওবন্দ ও আজমীর শরীফেই এরকম হামদনাত মাহফিল হচ্ছে। আসলে অনেকেই না বুঝে না শুনে শুধু বিরোধিতার জন্যই বিরোধিতা করে।
অপসংস্কৃতির দাবানল ও আগ্রাসনের বিপক্ষে নিজেরাও কোনো উদযোগ গ্রহণ করে না। কেউ করলে তাতে বাঁধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়াতে চায়। খামাখা।
১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যেই আমরা অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছাই। এতে হিন্দুস্তানের প্রখ্যাত সব হামদনাত শিল্পী ও শায়েরগণ অংশ নেন। আর বিখ্যাত বেদআতি শায়ের মরহুদ বেকল উতসাহী এবং এক শিখ আশেকও নাত পরিবেশন করেন। দর্শক শ্রোতা এবং শায়ের ও আশেকের এক মিলনমেলায় পরিণত হয় আলমী নাতে মুশাআরা। সরদার পানচি যখন বলেন, বে ধর্মীদের জন্য মদীনায় যাওয়া নিষেধ হলেও হে রাসূল আমি আমার এক আলাদা পদ্ধতি আবিষ্কার করেছি। এই বলে তিনি শেরটি পরিবেশন করেন ‘না হো মায়ুস পানচি, এক জিয়ারাত ইয়ু ভি হোতি হে/উসিকো দেখল্ যিসনে মাদিনে কি গালি দেখি’ হতাশ হয়ো না হে পানচি, এক প্রকার সাক্ষাৎ এমনও হয়/ তাকেই দেখ যে সাক্ষাৎ করেছে মদিনার। আলমী নাতে মুশাআরা এশকে রাসূলের এক অন্য রকম আবহ সৃষ্টি করলো। অনুষ্ঠানের ফাঁকেই হযরতের সঙ্গে আমাদের দিল্লী ফেরত যাওয়ার বিষয়ে কথা হয়। যদিও আমাদের বিমানের টিকিট করা ছিলো তবুও আব্বা বাই রোডে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলে হযরত আমাদের জন্য ¯েপশাল গাড়ির ব্যবস্থা করেন এবং বলেন, মাওলানা আমিও আপনার সঙ্গে বাই রোডে যাবো। এরপর দিন অনুষ্ঠান শেষ করে আমরা রাতেই রওনা দেব এমন প্রোগ্রাম সাজানো হয়। এরপর আমরা রাত ২.৫০ মিনিটে হোটেলে ফেরত আসি।
সেখানে প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে কুতুবুল বাঙাল আধা ঘণ্টা মোরাকাবায় কাটান। প্রচণ্ড ভিড়েই এরকম মোরাকাবা দেখে আমি অভিভূত হয়ে যাই। আমার ভেতরেও একটা মুগ্ধতা কাজ করে। আমি ভাবি, আসলে এই ভিড়েতো আর সবাই এমন করে ধ্যানমগ্ন হতে পারে না। ভিড় মে তানহা-ই কা এহসাস- কেউ কেউ খুঁজে নিতে পারে। তিনি তো আমার বাবা নন কেবল আরও কিছু। পীর, মুর্শিদ ও পথপ্রদর্শক।
পরদিন সকালে এগারটার দিকে নাস্তার পর আমি আর আমার বাবা আজমির জিয়ারতে যাই। সেখানে প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে কুতুবুল বাঙাল আধা ঘণ্টা মোরাকাবায় কাটান। প্রচণ্ড ভিড়েই এরকম মোরাকাবা দেখে আমি অভিভূত হয়ে যাই। আমার ভেতরেও একটা মুগ্ধতা কাজ করে। আমি ভাবি, আসলে এই ভিড়েতো আর সবাই এমন করে ধ্যানমগ্ন হতে পারে না। ভিড় মে তানহা-ই কা এহসাস- কেউ কেউ খুঁজে নিতে পারে। তিনি তো আমার বাবা নন কেবল আরও কিছু। পীর, মুর্শিদ ও পথপ্রদর্শক।
দিনে আমাদের কোন প্রোগ্রাম না থাকায় রেডি হয়ে আসরের পর অনুষ্ঠানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিই। আসর পরে আমরা অনুষ্ঠানস্থলে রওনা দেই। যেতে যেতে দেখলাম গোটা আজমির শহর জমিয়ত কর্মীদের পদভারে মুখরিত। পুরো আজমীরজুড়েই জমিয়তের অনুষ্ঠানের আমেজ বিরাজ করছে। চারিদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ। বিশেষ গেট দিয়ে আমরা ঠিক মাগরিবের আগ মূহূর্তে অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করি। স্টেজে দেখলাম হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, শিখ, বিদয়াতি, গায়রে বেদয়াতি সবাই এক কাতারে বসে আছে। এত অসাম্প্রদায়িক মিলনমেলা বাংলাদেশের উলামায়ে কেরাম কল্পনাও করতে পারবে না। হয়তো বা অনেকেই জমিয়তে উলামার নামে বাংলাদেশে কাজ করেন বা কাজ করতে চেষ্টা করেন। বাস্তবে তারা শাইখুল ইসলাম সাইয়্যিদ হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ.কে প্রাণ উজার করে মুহাব্বাত করলেও মুসলিমলীগী চিন্তা চেতনা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। আজও অজানা সিলেটের জনসাধারণ কেন তারা ৪৭ সালে পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। শায়খে কৌড়িয়া থেকে শুরু করে শায়খে গাজীনগরী, মুফতি নুরুল্লাহ ও সর্বশেষ কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ রহ.সহ সবারই আজীবন চেষ্টা ছিলো জমিয়তকে তার মূল ধারায় ফিরিয়ে আনা। কিন্তু ইসলামী রাজনীতির কিছু ইন্টেলেকচুয়াল ভণিতাবাজদের কারণে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। আজ সময় হয়েছে শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ.- এর উদার, অসাম্প্রদায়িক ও সহিষ্ণু চিন্তাধারার আলোকে জমিয়তকে তার মূলধারায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা।
যাই হোক মূল কথায় ফিরে আসি। জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের প্রোগ্রামের এস্টেজে আজমীর শরিফের বেদআতিগণতো উপস্থিত ছিলেনই আরও উপস্থিত ছিলেন কট্টর বেদআতি মতবাদ রেজভীদের প্রধান আহমাদ রেজা খানের প্রপৌত্র তৌকির রেজা খান। সেই সঙ্গে তার মনোগ্রাহী বক্তব্যও অত্যন্ত প্রশংসিত হয়। এরপর অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে আমাদের মানবকল্যাণে শান্তির ফতোয়ার কথা তুলে ধরে হযরত মাহমুদ মাদানী হযরত কুতবে বাঙালকে তা হিন্দুস্তানের উলামায়ে কেরাম ও জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সদর কারী সাইয়্যেদ উসমান সাহেব ও দারুল উলূম দেওবন্দের প্রধান মুফতি মাওলানা হাবিবুর রহমান খায়রাবাদির হাতে তুলে দেয়ার জন্য আহ্বান জানান। একলাখ আলেম মুফতি ও ইমামের স্বাক্ষরসম্বলিত মানবকল্যাণে শান্তির ফাতওয়ার প্রতীকি কপি ভারতের লাখো লাখো আলেম উলামার সামনে জমিয়তে উলামা হিন্দ নেতৃবৃন্দের হাতে তুলে দেন। পরে হযরত আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ সংক্ষিপ্ত বক্তব্য তুলে ধরেন,
বিসমিল্লাহির রহমানীর রহীম
আল হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন
মুহতারাম সভাপতি, হযরত ওলামায়ে কেরাম ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ভাইয়েরা।
বন্ধুগণ, আল্লাহ তা’আলার সীমাহীন মেহেরবানী যে, এই ভারতের স¤্রাট, খাজা গরীবে নেওয়াজের পুণ্যভূমিতে আমরা একত্র হতে পেরেছি।
আমি জোড় দিয়ে বলতে পারি, আজকের এই মহাসমাবেশে হযরত খাজা গরীবে নেওয়াজের বিশেষ তাওয়াজ্জুহ আছে। কারণ এখানে আসার আগে স্বপ্নযোগে খাজা সাহেবের সাথে আমার সাক্ষাত হয়েছে। এই সমাবেশের উপর হযরতের সন্তুষ্টি আমি লক্ষ্য করলাম। এই ঘটনা দ্বারা বুঝা যায় আজকের এই মহাসমাবেশ আল্লহর দরবারে মকবুল।
আমি দ্বিতীয় আরেকটি কথা বলতে চাই। ইসলাম আমাদেরকে শিক্ষা দেয় যে, এটি একটি শান্তির ধর্ম, প্রেমের ধর্ম। যেমনটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার এমন একটি শক্তি রয়েছে যার সামনে জালেম মাথানত করতে বাধ্য এবং পরাজিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধৈর্যের পাহাড় ছিলেন। সাহাবায়ে কেরাম সহিষ্ণুতার মূর্তপ্রতীক ছিলেন। জযবা কিংবা প্রবৃত্তির বশিভূত হননি। হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সন্ধির শর্ত রক্ষার্থে হযরত আবূ জান্দাল রা.কে ফিরিয়ে দিয়ে পরম সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়েছিলেন। এর ফলাফল কী দাঁড়ালো? মাত্র দুই বছরের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা দুই হাজার থেকে দশ হাজারে পরিণত হয়েছিল। আল্লাহ আমাদেরকে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সঙ্গে কাজ করার তৌফিক দান করুন। আমীন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধৈর্যের পাহাড় ছিলেন। সাহাবায়ে কেরাম সহিষ্ণুতার মূর্তপ্রতীক ছিলেন। জযবা কিংবা প্রবৃত্তির বশিভূত হননি। হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সন্ধির শর্ত রক্ষার্থে হযরত আবূ জান্দাল রা.কে ফিরিয়ে দিয়ে পরম সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়েছিলেন।
এরপর ওই রাতে অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর হযরত মাহমুদ মাদানির সঙ্গে আমরা দিল্লীর উদ্দেশে রওয়ানা দিই। জয়পুরের এক গুজরাটি হোটেলে রাতের খাবার সারি। গাড়িতে হঠাৎ হযরত মাদানি জিজ্ঞেস করলেন, মাওলানা সাদ সাহেবের বিরুদ্ধে ভারতে যে চিঠি পাঠানো হয়েছে তাতে কি আপনার স্বাক্ষর আছে? কুতুবে বাঙাল বললেন, না, আমি তো এতে স্বাক্ষর করিনি। মাওলানা মাদানি তখন বললেন, তাই তো, মাওলানা সালমান মুনসুরপুরী বললেন, মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ তো জযবার উপর চলেন না। বাস্তবতার নিরিখে এগিয়ে যান। কাজ করেন।
তিনি বললেন, দেখুন মাওলানা, হযরত ফিদায়ে মিল্লাতের ইন্তেকালের পর আমার সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে মাওলানা সাদ সাহেবের সঙ্গেও এমন আচরণ করা হয়েছে। তাই আপনার উচিত, মাওলানা সাদের সঙ্গে দেখা করে এ বিষয়টা পরিষ্কার করা।
তখনই মাওলানা সালমান সাহেবকে ফোন করে জানান, দেখুন, মাওলানা সাদ সাহেবের বিরুদ্ধেও স্বাক্ষরটি মৌলিকভাবে ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ সাহেবের নয়। এরপর হযরত ওমরায় যাওয়ার কথা জানান। প্রসঙ্গক্রমে একবার সৌদীর বিজনেস ভিসা থাকার কারণে ওই ভিসাতেই হজের জন্য মক্কায় গিয়েছিলেন। ইমিগ্রেশন হয়ে যাওয়ার পর ভারতের এক বড় মাওলানা হযরতকে বলছিলেন, এটা তোমার কেরামতি না, তোমার দাদার কেরামতি। হযরত শাইখুল ইসলাম সাইয়্যিদ হুসাইন আহমদ মাদানির রহ.-এর তাওয়াজ্জুহ তোমার সঙ্গে সবসময় আছে।
এরপর রাত চারটায় আমরা জমিয়তুল উলামা হিন্দের অফিসে পৌঁছি। বিশ্রাম নেয়ার পর পরদিন সকালে নিজামুদ্দীন ফোন করে মাওলানা সাদ সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় নেয়া হয়।