মার্কিন ডলার এত শক্তিশালী কেন?

মার্কিন ডলার এত শক্তিশালী কেন?

পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : মার্কিনিদের জন্য ইউরোপ ভ্রমণের এখন দারুণ সময়। চলতি মাসের শুরুর দিকে গত দুই দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো মার্কিন ডলারের সঙ্গে সমতা হারায় ইউরো। তবে মার্কিনিদের কেবল ইউরোপ ভ্রমণেই সীমাবদ্ধ থাকার প্রয়োজন নেই। কারণ ইদানিং বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই তাদের জন্য সস্তা হয়ে উঠেছে। এ বছর ইয়েনের বিপরীতে ১৫ শতাংশ, পাউন্ডের বিপরীতে ১০ শতাংশ এবং ইউয়ানের বিপরীতে পাঁচ শতাংশ মূল্যমান বেড়েছে ডলারের। কিন্তু কেন?

২০২১ সালের প্রথম দিকে এক ঝাঁক মুদ্রার বিপরীতে মার্কিন ডলারের মান নেমে গিয়েছিল পাঁচ বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ের কাছাকাছি। মহামারির অনিশ্চয়তায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সেটি। তবে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার সঙ্গে সঙ্গে সুদিন ফেরে ডলারেরও। কিন্তু এর মান যে এত বেশি বাড়বে, তা আশা করেননি বেশিরভাগ বিশ্লেষক। গত বছরের জুনের তুলনায় বর্তমানে বিভিন্ন মুদ্রার বিপরীতে ডলারের দর প্রায় ২০ শতাংশ বেড়েছে, যা ২০০২ সালের পর থেকে সর্বোচ্চ।

এর অন্যতম প্রধান কারণ যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের কঠোর পদক্ষেপ। মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে গত মার্চ থেকে সুদের হার ১ দশমিক ৫ শতাংশ পয়েন্ট বাড়িয়েছে তারা। বিনিয়োগকারীরা মনে করেন, বছর শেষ হওয়ার আগে আরও দুই শতাংশ পয়েন্ট সুদের হার বাড়াবে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ১৯৮০-এর দশকের পর থেকে এত দ্রুত সুদের হার আর বাড়ায়নি দেশটি।

সুদের হার হলো বিনিময় হারের একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক। উচ্চ সুদের হারযুক্ত কোনো দেশের একটি শক্তিশালী মুদ্রা থাকা উচিত। কারণ সেই দেশের সম্পদগুলো তখন উচ্চ হারে মুনাফা দেয়, যা আরও বেশি মূলধন প্রবাহকে আকর্ষণ করে। এ কারণেই মূলত ইউরো ও ইয়েনের বিপরীতে এত ভালো ফল করেছে ডলার। ফেডারেল ব্যাংকের তুলনায় ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংক (ইসিবি) ও ব্যাংক অব জাপান (বিওজে) অনেক বেশি নমনীয়। এ সপ্তাহে ইসিবি হয়তো সুদ বাড়ানোর পদক্ষেপ শুরু করতে পারে, কিন্তু বিওজে এখনো নেতিবাচক সুদের হার শক্তভাবে ধরে রেখেছে।

নীতির এই বৈসাদৃশ্য অর্থনীতির মৌলিক বিষয়গুলোর গভীর পার্থক্যকে প্রতিফলিত করে। কয়েক বছর ধরে জাপানের সমস্যা হলো মূল্য সংকোচন। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সেখানে পণ্যের দাম সামান্য বেড়েছে। তবে ইউরো জোনে মূল্যস্ফীতি প্রায় আমেরিকার মতোই বেশি। কিন্তু তাদের দুশ্চিন্তা রয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাসের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে। সেখানে সুদের হার বাড়ানো জ্বালানি খরচ তো কমাবেই না, বরং তা মন্দার আশঙ্কা বৃদ্ধি করবে।

যুক্তরাষ্ট্রে মহামারি চলাকালীন অত্যাধিক চাহিদা ও আর্থিক প্রণোদনা মূল্যস্ফীতি বাড়াতে বড় ভূমিকা রেখেছে বলে ধারণা করা হয়। আগের বছরের তুলনায় গত জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রে মূল মূল্যস্ফীতি (পরিবর্তনশীল খাদ্য ও জ্বালানি ব্যয় বাদে) ছিল ৫ দশমিক ৯ শতাংশ, কিন্তু ইউরোপে ছিল মাত্র ৩ দশমিক ৭ শতাংশ।

ফেড এবং অন্যান্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর এসব কঠোর পদক্ষেপ বিশ্বব্যাপী সম্পত্তির দামের ওপর চাপ তৈরি করেছে। বেশিরভাগ শেয়ারবাজারে টানাটানি অবস্থা, করপোরেট বন্ড ডুবছে, ক্রিপ্টোবাজারের অবস্থাও খারাপ। হতাশাবাদী পূর্বাভাসকরা মনে করেন, এই পরিস্থিতি সামনে আরও ভয়াবহ হবে।

তবে এসবে আপাতত ডলারের জন্য সুবিধাই হচ্ছে। আর্থিক অস্থিরতার সময়ে প্রায়ই ‘সেফ হ্যাভেন’ প্রবাহ থেকে উপকৃত হয় মার্কিন মুদ্রা। বিনিয়োগকারীরা বিশ্বাস করেন, যা-ই ঘটুক না কেন, তারা ঝড় থামার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সু-নিয়ন্ত্রিত অতি তরল অর্থবাজারে অপেক্ষা করতে পারেন। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের হিসাবে, ডলারের সাম্প্রতিক শক্তির প্রায় ৪৫ শতাংশই এসেছে এর ‘সেফ হ্যাভেন’ অবস্থানের কারণে।

কথা হলো, এই পরিস্থিতি কতদিন চলবে? ফেডারেল ব্যাংক যদি কঠোরতায় অন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে ছাড়িয়ে যেতে থাকে, তাহলে সেটি ডলারের মানের জন্য ইতিবাচক হবে। একইভাবে, বাজারে অস্থিরতার একটি নতুন ঢেউ শুরু হলে সেটিও ডলারকে শক্তিশালী করতে পারে। তবে এর মান যতটা বেড়েছে, তারচেয়ে আরও বেশি বাড়ার সম্ভাবনা বেশ কম।

  • দ্য ইকোনমিস্ট থেকে অনুবাদ করেছেন খান আরাফাত আলী

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *