ফিরে দেখা । এম এ খালেক
রাজিয়াদের স্বপ্ন পূরণে এসএমই খাত
দেশের সীমান্তবর্তী জেলা মেহেরপুর সফরকালে গৃহবধু রাজিয়া সুলতানার (৩০) ব্যক্তিগত উদ্যোগে পারিবারিকভাবে গড়ে তোলা গরুর খামার পরিদর্শনের সুযোগ হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি বিজরিত মুজিবনগর কমপ্লেক্স দেখার পর ফেরার পথে স্থানীয় সফল উদ্যোক্তা রাজিয়া সুলতানার গরুর খামার পরিদর্শনের ইচ্ছা পূরণ করি। স্থানীয় জাতের উন্নত মানের গরুর জন্য মেহেরপুরের সুনাম রয়েছে। রাজিয়া সুলতানার খামারে গিয়ে দেখি তিনি নিজেই গরুগুলোর পরিচর্যা করেন।
রাজিয়া সুলতানার সাথে আলাপকালে জানা যায়, এইচএসসি পাশ করার পর প্রায় ১২ বছর আগে তার বিয়ে হয়। রাজিয়ার স্বামী সাজ্জাদ হোসেন ছোট খাটো ব্যবসায় করতেন। সংসার মোটামুটি ভালোই চলছিল। কিন্তু বছর সাতেক আগে তার স্বামীর অসুস্থ হলে ব্যবসা করার সামর্থ হারিয়ে ফেলেন। এতে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করে রাজিয়া ব্যক্তিগত উদ্যোগে গরুর খামার গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমে মাত্র ৪টি দেশি গাভী নিয়ে খামার শুরু করেন। বর্তমানে তার খামারে ১৫টি গাভী রয়েছে। গাভীর দুধ বিক্রি করে ভালো আয় হচ্ছে। সংসারের ব্যয় নির্বাহের পাশাপাশি ছেলে-মেয়েকে পড়াশুনা করাছেন রাজিয়া। খামারের কাজে স্বামী, সন্তানরা সাহায্য করে। রাজিয়া তার খামারকে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রাতিষ্ঠানিক খামারে পরিণত করার স্বপ্ন দেখছেন। মাঝারি আকারের একটি আধুনিক খামার প্রতিষ্ঠা করতে হলে অন্তত ১০ লাখ টাকা প্রয়োজন। একটি বেসরকারি ব্যাংকের স্থানীয় শাখায় তিনি যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু তারা শুধু অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে ঋণ প্রদানে আগ্রহী নন। ঋণ পেতে হলে উপযুক্ত জামানত দিতে হবে। কিন্তু জামানত দেবার সামর্থ রাজিয়া দম্পত্তির নেই। তাই রাজিয়ার আধুনিক গরুর খামার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাচ্ছে। পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও এভাবে উদ্যোগী রাজিয়ার স্বপ্ন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু না, উদ্যমী রাজিয়ার এবার স্বপ্ন পূরণের সুযোগ এসেছে। সম্প্রতি মন্ত্রী পরিষদ সভায় এসএমই শিল্প খাতে বিনা জামানতে ঋণদানের সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়েছে। ফলে রাজিয়া সুলতানাদের মতো উদ্যোক্তারা, যারা নিজেদের সামর্থকে কাজে লাগিয়ে পারিবারিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখতে চান, তাদের জন্য অপার সম্ভাবনার দুয়ার উন্মুক্ত হয়েছে। এসএমই শিল্পের সংজ্ঞায়ও পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে। আগের নীতিমালায় ৫০ লাখ টাকার কম বিনিয়োগ সম্বলিত শিল্পকে এসএমই খাতের অন্তর্ভুক্ত করা হতো না। ফলে ছোট ছোট শিল্পগুলো এসএমই খাতের সুবিধা পেতো না। নতুন সংজ্ঞায় সর্বনিম্ন ১০ লাখ টাকা বিনিয়োগ সম্বলিত শিল্পকেও এসএমই খাতের অন্তর্ভুক্ত করে এই খাতের নামকরণ করা হয়েছে সিএমএসএমই (কটেজ, মাইক্রো, স্মল এন্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ)। ফলে রাজিয়া সুলতানাদের মতো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের এই খাত থেকে ব্যাংক ঋণ পাবার সুযোগ উন্মোচিত হয়েছে, বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তাগণ এতদিন জামানত প্রদানে অপারগতার কারণে ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সমস্যায় পতিত হচ্ছিলেন। আগামীতে এই সমস্যার অনেকটাই সমাধান হবে আশা করা যায়। ফলে নারী উদ্যোক্তারাও জাতীয় অর্থনীতিতে আগের চেয়ে বেশি অবদান রাখতে পারবেন।
এসএমই উদ্যোক্তাদের বিনা জামানতে ব্যাংক ঋণ প্রদানের সরকারি সিদ্ধান্ত অত্যন্ত সময়োপযোগী। এর ফলে নারী উদ্যোক্তাদের দীর্ঘদিনের একটি দাবি পূরণ হলো। তবে সমস্যা হলো অনেক উদ্যোক্তারাই গ্রহণকৃত ঋণের একটি বড় অংশ নানাভাবে অন্য খাতে প্রবাহিত করে। এই সমস্যা দূরীকরণে ঋণদানের পর কঠোর মনিটরিং জোরদার করা প্রয়োজন।
পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) এর চেয়ারম্যান, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. খলীকুজ্জমান আহমেদ বলেন, আমরা অনেক দিন ধরেই বলে আসছিলাম মাইক্রো ইন্ডাস্ট্রিগুলোকে এসএমই খাতের আওতাভুক্ত করার জন্য। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যেই সেই চাহিদা পূরণ করেছে। এছাড়া সরকার বিনা জামানতে এসএমই খাতে ঋণ দানের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা সময়োপযোগী এবং কার্যকর একটি সিদ্ধান্ত। যারা বিনা জামানতে ঋণ গ্রহণ করবেন, তারা সেই ঋণের অর্থ যাতে অন্য কোনো খাতে প্রবাহিত করতে না পারেন, সেজন্য ঋণদান পরবর্তী মনিটরিং এবং সুপারভিশন জোরদার করতে হবে। আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলের উদ্যোক্তারা অত্যন্ত উদ্ভাবনী শক্তির অধিকারী। তারা যে কোনো উদ্যোগ নিয়ে সফল হতে পারেন। তবে শুধু ঋণদান করলেই একজন উদ্যোক্তা সফল হতে পারবেন না। এজন্য উদ্যোক্তাদের দক্ষতা ও সামর্থ বৃদ্ধি, বাজার তথ্য প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ এবং উৎপাদিত পণ্যের সঠিক বাজারজাতকরণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এছাড়া যে ঋণ দেয়া হবে, তা যেনো উপযুক্ততার ভিত্তিতে দেয়া হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। যে প্রকল্পের জন্য যেটুকু ঋণ প্রয়োজন, তাকে সেটুকুই ঋণ দিতে হবে, যাতে সেই ঋণের অর্থ অপচয় না হয়।
বাংলাদেশে সিএমএসএমই খাতের বিকাশের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। নিকট প্রতিবেশী দেশ ভারত এবং চীন এসএমই খাতের উপর জোর দিয়েই তাদের শিল্পায়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করেছে। চীনের শিল্প খাতে টিভিই (টাউন-ভিলেজ এন্টারপ্রাইজ) নামে একটি এসএমই কর্মসূচি রয়েছে, যা অত্যন্ত কার্যকর বলে প্রতীয়মান হয়েছে। বর্তমানে চীনের শিল্পখাতে টিভিই খাতের অবদান ৬০ শতাংশের মতো। ভারতের শিল্প খাতে এসএমই খাতের অবদানও চীনের মতোই ৬০ শতাংশ। বাংলাদেশের শিল্প খাতে এসএমই খাতের অবদান মাত্র ২০ শতাংশ। আমরা পরিকল্পিতভাবে কার্যকর উদ্যোগ নিলে এসএমই খাতের অবদান অনেক বাড়াতে পারি। এসএমই খাতের সুবিধা হচ্ছে এতে পুঁজির পরিমাণ খুব কম প্রয়োজন হয়। কিন্তু কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এই খাতের কোনো বিকল্প নেই।
চলতি অর্থ বছরের বাজেটে ‘স্টার্ট আপ বিজনেস’ নামে একটি বিশেষ খাত সৃষ্টি করে এত ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। সম্ভাবনাময় নতুন উদ্যোক্তাদের প্রাথমিক পুঁজির যোগান দেয়াই এই কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য। এই কার্যক্রম যাতে সফল হতে পারে সে জন্য বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি(বিডা) ইতোমধ্যেই দেশের বিভিন্ন জেলায় সম্ভাবনাময় নতুন উদ্যোক্তাদের বাছাই করে ব্যাপক ভিত্তিক প্রশিক্ষণদানের উদ্যোগ নিয়েছে। আশা করা যায় এর মাধ্যমে সম্ভাবনাময় নতুন খুঁজে বের করা সম্ভব হবে। প্রশিক্ষণ শেষে এদের প্রয়োজনীয় আর্থিক সহযোগিতার জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করিয়ে দেয়া হবে।
রাজিয়া সুলতানার মতো সম্ভাবনাময় উদ্যোক্তাদের সামনে সোনালী দিন অপেক্ষা করছে, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। বর্তমান সরকারের সময়ে বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে যে জাগরণ শুরু হয়েছে, তা আরো ত্বরান্বিত করতে এসএমই খাত ব্যাপক ভূমিকা রাখবে এমন আশাবাদ অলীক নয়।
লেখক : কলামিস্ট