রৌদ্রকরোজ্জ্বল এক বিকেলে মেস থেকে হলে
আশরাফ উদ্দীন রায়হান : রৌদ্রকরোজ্জ্বল এক বিকেলে বিনোদপুর গেট থেকে রিকশায় চেপে রাজশাহী বিশ্ববিদালয় রেলস্টেশন সংলগ্ন মেহেরচণ্ডী এলাকায় এসেছিলাম। রেললাইনের দুই ধারে বটগাছ দুটির পাতাগুলো মর্মর ধ্বনি তুলে মৃদুমন্দ বাতাসের জানান দিচ্ছিল। আমাকে রিসিভ করার জন্য চলন্ত রিকশাগুলোর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে আসাদ (MD Asaduzzaman) ভাই দ্রুত পদবিক্ষেপে হাঁটছিলেন। অত্যাসন্ন সালাতুল আসরের জামাত শুরু হওয়ার কয়েক মিনিট বাকি ছিল।
সদ্য-অযু-করা আসাদ ভাইয়ের পাঞ্জাবির হাতা দুটি কনুইয়ের ওপর পর্যন্ত ওঠানো—মুখ ও হাত থেকে টপটপ করে পানির ফোঁটা পড়ছে। ঠিক সে-মুহূর্তেই তাঁর সাথে আমার চোখ চাওয়াচাওয়ি! মজার ব্যাপার হলো, তখনও আসাদ ভাইয়ের সাথে আমার দেখা-সাক্ষাৎ বা ফোনালাপ— কোনোটাই হয়নি। কিন্তু অগ্রজতুল্য রাশেদ ভাইয়ের কথামতো কেউ একজন আমাকে রিসিভ করবেন— এরকম একটা সুস্থির চিন্তা ছিলই। তো চোখ চাওয়াচাওয়ি মাত্রই আসাদ ভাই রিকশাটি থামিয়ে, আমি রায়হান কি না— জিগ্যেস করলেন। আমি এবার নিশ্চিন্ত হয়ে তাঁর সাথে সাথে জানেয়ারা ছাত্রাবাস নামে তিনতলা একটি মেসে ওঠলাম। দু তলার ডান দিকের প্রথম রুমটি ডবল সিটের। দশ মাসের জন্য তখন থেকে এ রুমটিতেই থিতু হয়েছিলাম।
জামালপুরের প্রতিভাদীপ্ত ও মেধাবী ছাত্র মো. আসাদুজ্জামান ময়মনসিংহের সৈয়দ নজরুল ইসলাম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিকের পাঠ চুকিয়ে এখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রপ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগে অধ্যয়নরত। দেখতে নাদুসনুদুস ও ধীর-স্থির স্বভাবের মানুষটি বেশ কর্মচঞ্চল। সবকিছুতেই তাঁর পরিমিতিবোধ লক্ষ করার মতো বিষয়। তাঁর সাথে সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল আমার। এক সাথে দীর্ঘ সময় এক জায়গায় ছিলাম— বিদায়লগ্নে তাঁর কথাই সবচে বেশি পীড়া দিচ্ছে!
অগ্রজপ্রতিম মাহফুজ ঢালী ভাইয়ের ঈর্ষণীয় প্রতিভা আর সাফল্য যে-কাউকেই চমকে দেয়ার মতো। ঢাকার নটরডেম কলেজ থেকে পড়াশোনা-করা মাহফুজ ভাই এখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (আইইআর) শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটে ৩য় বর্ষে পড়ছেন। ভাইটির কেতাদুরস্ত বেশভূষা আর পারিপাট্য অনুসরণীয়ই বটে। তাঁর রুমটাও বেশ ছিমছাম। এক কথায় বলতে গেলে, সবকিছুতেই তাঁর আভিজাত্য আর উন্নত রুচিবোধের ছাপ।
লেখা বাহুল্য, আমার বইপড়ার নেশাটাও তীব্রতর হয়েছে তাঁকে দেখেই। আমার মতে, সদ্য প্রকাশিত দীনী ও সাহিত্যের বইসমূহের প্রথম কাতারের সংগ্রাহক তিনি। উপরন্তু কাজলা গেট মসজিদে তাঁর সাথে প্রথম আলাপচারিতায়ই বুঝেছিলাম তিনি একজন সাহিত্যকুঁড়ানো মানুষ।
আমার নিজের পছন্দের বইগুলো সংগ্রহের ক্ষেত্রে সঙ্গত প্রতিকূলতা থাকাতে খোরাকটা বেশিরভাগ সময় তাঁর কাছ থেকেই নিতে হয়েছে। মেসজীবনের প্রথম রাতে বটতলা হোটেলে তিনিই আমাকে খাইয়েছিলেন। এরপর কোনো এক রাতে একটি দোকানে চা-বিস্কুট পর্ব সাঙ্গ করে ফের তাঁর রুমে নিয়ে গেলেন। শানদার দস্তরখানের ওপর শানদার তশতরিতে সে-বার আঙ্গুর খেতে দিয়েছিলেন।
এরপর কতবার সুবিধা-অসুবিধায় পড়ে; প্রয়োজনের তাগিদে তাঁর দ্বারস্থ হয়েছি। কোনোবারই খালিমুখে ফেরত দেননি। পরামর্শ আর নানা বিষয়ে দিকনির্দেশনার জন্যেও আমার পেছনে তাঁর অবদান আমাকে ঋণী করে রাখবে।
আমার দুজন রুমমেটও স্মৃতির অ্যালবামে জায়গা করে নিয়েছে বৈকি। নেত্রকোণার বারহাট্টা থেকে আসা সালমানকে প্রথম রুমমেট হিসেবে পাই। আরবি সাহিত্যে অধ্যয়নরত সালমানের সাথে আমার আঞ্চলিক ভাষারীতিতে প্রায় হুবহু মিল থাকাতে দুজনের কথাও হতো জম্পেশ। দুজন একসাথে একই দস্তরখানে খেয়েছি। সত্যিকার অর্থে মিশে যাওয়া যাকে বলে, ঠিক সে-রকম সম্পর্কই ছিল আমাদের মাঝে। এখনও আছে বৈকি। আচারে-স্বভাবে চটপটে ও চঞ্চল সালমানের সাথে আমার দিনগুলো ভালোয় ভালোয় শেষ হয়েছিল। মাঝখানে সালমান সুবিধা বিবেচনা করে পাশের মেসে গিয়ে ওঠলো।
নতুন রুমমেট হিসেবে পেলাম মাসউদুর রহমান ভাইকে। হাফিজুল কুরআন ও সৌম্যদর্শন মাসউদ ভাই টাঙ্গাইলের সখীপুরের লোক। এ-সুবাদে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দীকি সম্পর্কে আমার কৌতূহল নিয়ে তাঁর সাথে ঢের আলোচনা করে প্রীত হয়েছি। ঢাকার জামিয়া মাদানীয়া বারিধারা মাদরাসা থেকে পড়ালেখা-করা আমার এই রুমমেট এখন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে পড়ছেন। স্বল্পভাষী মাসউদ ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্কটা বেশিরভাগই শ্রদ্ধা আর সম্মানেরই ছিল। সংকটে-বিপদে তাঁকে পাশে পেয়েছি। উপকার করেছেন অকাতরে।
‘হযরতজী’ অভিধায় অভিষিক্ত ফয়সাল (Md Foysal Hossain Bokul) ভাইয়ের কথা কখনও ভুলবো না। শুরু থেকেই তাঁর সহজ-সরল আচার-ব্যবহার পেয়ে নিজেকে নির্ভার মনে করেছিলাম। নওগাঁ জেলা থেকে আসা ফয়সাল ভাই ফিশারিজ বিভাগে লেখাপড়া করছেন। তাঁর অকৃত্রিম সদ্ব্যবহার মেসের সবার মনে তৃপ্তি এনে দেয়। আমার প্রতিও তাঁর সযত্ন ও সস্নেহ নজর ছিল বৈকি।
পাশের রুমের মিজান ভাই আর তরিকুল ভাইয়ের সাথে সুমধুর সম্পর্কের কথা না বললেই নয়। মাসুদ ভাইয়ের কথা বলার এফেমিনেট ভঙ্গিমা কতই-না উপভোগ করেছি। মজা-মাস্তি করেছি অনেক। চুয়াডাঙ্গার রিজভী ভাই, ঝিনাইদহের মিশন— সবাই। আবার ফজরের সময় তাঁদের সবাইকে ডেকে দেয়াটা ছিল আমার ডিউটি পালন করার মতো। বিশেষত সকালবেলায় মিজান ভাই আর আমার মধ্যে পত্রিকা পড়াটা ছিল রীতিমতো প্রতিযোগিতার মতো— কার আগে কে পড়ব। এসব মধুময় স্মৃতি ভুলবার নয়, ভুলবও না।
মেসটাতে বলতে গেলে চুয়াডাঙ্গা আর ঝিনাইদহের ছাত্র দিয়েই ভর্তি। নীচতলার হাসান ভাই, শহীদ ভাই, আসলাম ভাই, বন্ধু জাহিদ আর ওপরের বেশিরভাগই এই দুই জেলার লোক। আর মোস্ট সিনিয়র হিসেবে যাঁকে পেয়েছিলাম— তুহিন ভাই রংপুরের মানুষ। আরবি সাহিত্যে অনার্স-মাস্টার্স। মজার ব্যাপার হলো, তিনি আর আমি একসঙ্গেই মেস ছাড়ছি।
বিদ্যুৎ (Cphd Biddut) নামের বন্ধুটির সাথে অল্প সময়ে কীভাবে যে এতো অন্তরঙ্গতা পয়দা হয়ে গেলো— ভাবতে গেলে নিজেই আক্কেলগুড়ুম বনে যাই। প্রমিত রীতিতে কথা-বলা (ঝিনাইদহ) বিদ্যুতের সাথে আমার বোঝাপড়াটা অনেক সময় খুনসুটির পর্যায়ে আপডাউন করেছে। স্মৃতিমেদুর কত কী-ই-না হয়েছে ওর সাথে। আমার লেখার প্রচণ্ড রকমের হিতাকাঙ্ক্ষী ও। উৎসাহ-প্রণোদনা জুগায় অসম্ভব।
বাদ থাকবে না রানা ভাই আর উজ্জ্বল ভাইয়ের স্মৃতিও। ঘন কালো দাড়িশোভিত চেহারার রানা ভাইকে অনেক কারণেই ভালো লেগেছে আমার। আর দারুণ চাঞ্চল্য যার চোখে-মুখে বিচ্ছুরিত— সে-ই হলেন আমাদের উজ্জ্বল সেন দাদা। পাশাপাশি শ্যামবর্ণের জাহিদের ভদ্রোজনোচিত কথাবার্তাও মনে রাখার মতো। এক চিলতে হাসি ওর ঠোঁটে লেগেই থাকে সব সময়। আস্তে-ধীরে উপস্থাপন করতে পারাটা জাহিদের দুর্লভ একটা গুণই বটে। নতুন আসা বন্ধু খালেদের সাথেও যথেষ্ট হৃদ্যতাতা হয়েছে। ইতোমধ্যে ওর বাসা গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় যাওয়ার আমন্ত্রণও পেয়ে গেছি!
স্বল্প সময় থাকা সাঈদ ভাই আর সিরাজ ভাইয়ের সাথেও আন্তরিকতা হয়েছে ভালো। ঠাকুরগাঁওয়ের সিরাজ ভাইয়ের কঠোর পরিশ্রম আমাকে বেশ প্রাণিত করেছে। আর সাঈদ ভাইয়ের স্নেহাদরে সিক্ত হয়েছি সব সময়। আমার রুমে তিনজনের মুড়িপার্টিটা সেদিন বেশ জমেছিল। নিমাই ভট্টাচার্যের লেখা ‘মেমসাহেব’ উপন্যাসটি ধার নিয়েছিলাম সিরাজ ভাইয়ের কাছ থেকে।
পাশের মেসের সুমন ভাইয়ের শান্ত-ভদ্র আচরণ আমাকে আজীবন পথনির্দেশ করে যাবে। তাঁর ক্লাসফ্রেন্ড শাহজালাল ভাইয়ের বিনীত জীবনধারা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। সুমন ভাইয়ের নির্লিপ্ত অবস্থান বরাবরই ফায়দাজনক। স্মিত-মুচকি হাসিমাখা কথায় প্রাণটা জুড়িয়ে দিতে শাহহজালাল ভাইয়ের জুড়ি নেই। সত্যি বলতে কি, এত বিনয়মাখা মানুষ খুব কমই দেখেছি আমি।
ব্যাচমেট মুহিব্বুল্লাহ, মুন্না, মাহবুবদের কথাও অম্লান থাকবে হৃদয়পটে। ওদের কথা লিখে আর লেখার কলেবর বাড়ালাম না। এই লেখাগুলোই জীবনের খেরোখাতায় লিপিবদ্ধ করে রাখলাম। হয়তো কোনো দিন এসব হাতড়েই পার করব সময়।
শহীদ হবিবুর রহমান হল
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়