একটা পতাকার জন্য যুদ্ধ করেছিলাম। লালসবুজের পতাকা। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ভাষণ দেওয়ার পর ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের প্রিয় মাতৃভূমির প্রত্যাশা এ দেশের জনগণের হৃদয়তন্ত্রিতে বড়ধরনের আশা জাগানিয়া হয়ে ওঠে। মুক্তিকামী জনতার বিরুদ্ধে এহেন কোনো অপপ্রচার নেই যা পাকবাহিনী, রাজাকার, আলবদর, আল শামস করেনি। তারা জালেমের হাতকে শক্তিশালী করতে চেয়েছিল। জুলুম করে, অত্যাচার করে, অবলা নারীদের ঝাঁপিয়ে পড়ে কোনো গোষ্ঠী ক্ষমতায় টিকতে পারে না। যে পরিমাণ খুন-ধর্ষণ-জুলুম পাকবাহিনী করেছিল তা ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল। আল্লাহর পক্ষ থেকেই তাদের উপর শাস্তিস্বরূপ গজব নেমে আসে। বহির্বিশ্বও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। ভারতেও বিশ্বের অবিসংবাদিত আধ্যাত্মিক রাহবার, আওলাদে রাসূল ফিদায়ে মিল্লাত আসআদ মাদানী রহ. বাংলাদেশের পক্ষে জনমত তৈরির জন্য মিছিল, সভা, সেমিনার করেছিলেন। সীমান্তে এর প্রভাবও পড়েছিল। ‘ইসলাম ও সনাতনধর্মীদের মধ্যে যুদ্ধ’ হিসেবে প্রচার দিয়ে যারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করেছিল তারা ফিদায়ে মিল্লাতের কার্যক্রমের কারণে শঙ্কায় পড়েছিল। বিশ্বজুড়ে যে দারুল উলূম দেওবন্দের প্রভাবÑ তা একাত্তরে বাংলাদেশের নির্যাতিত মানুষের পক্ষে ছিল। কুচক্রীমহল সবসময় আলেমদের বিপদগামী করতে উদ্যত থেকেছে। এখনও তাদের চক্রান্ত অব্যাহত আছে। সাম্প্রদায়িক বানানোর জন্য নীলনকশা তৈরি করে কাজ করে যাচ্ছে। এখনকার সবচেয়ে বড় সমস্যা ‘জঙ্গি’ হিসেবে কওমী আলেমদের চিহ্নিত করার জন্যও একটা গোষ্ঠী তৎপর। কারণ স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি ইসলামকে ব্যবহার করে তারা ফায়দা লুটতে চেয়েছিল। পরাজিত হয়েও তাদের নষ্টকর্ম শেষ হয়ে যায়নি। রাজকারী মানসিকতাকে উসকে দিতে, ছড়িয়ে দিতে এহেন কোনো কাজ নেই তারা করছে না। বিশেষত আলেমদের এ বিষয়ে সতর্ক ও সচেতন থাকা অতীব জরুরি। যারা অন্যের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খেতে চায় তাদের ব্যাপারে আলেম সমাজ সতর্ক না হলে সমূহ বিপদ যে বগলদাবা করে বেড়াতে হবেÑ তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
আমরা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী থেকে মুক্ত হই। এদেশের আলেম সমাজসহ অনেকেই এদেশের মুক্তিকামী মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে দেশের মানুষকে পাকিস্তানী জালিম শাসকদের কবল থেকে মুক্ত করেছিলেন। অসংখ্য উলামায়ে কেরামগণ তাদের জানমাল, শক্তি সামর্থ্য দিয়ে এ দেশের মাজলুম জনগণের স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছেন। ‘১৯৭১ সালে মোনাফিকদের ক্ষমা নেই’ শীর্ষক একটি সরকারি প্রচার পত্রের শেষে লিখা ছিল, আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সত্যের জয় ও মিথ্যার বিনাশ অবশ্যম্ভাবী, বাঙালি এতে সম্পূর্ণ বিশ্বাসী।
এখানকার নব্বই ভাগ মুসলমানের এ দেশে ‘হিন্দু’ নিধনের নামে মুসলিম নিধনে যুদ্ধ শুরু করেছিল হানাদাররা। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বর্বর ও নির্মম হিসেবে পরিচিত তাদের জুলুম। বিধ্বংসী এই নিধনশালায় আলেমদের ভূমিকা কী ছিল? এটা একটা বড় প্রশ্ন। বাংলাদেশের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য আলেমেদ্বীন মাওলানা মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুযূর রহ. মুক্তিযুদ্ধকে জালেমের বিরুদ্ধে মাজলুমের লড়াই হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময়কার হানাদারদের নিসৃংশতা, বর্বরতা স্বচোক্ষে দেখেছিলেন। যে কারণে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে তিনি অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। এ দেশের আলেমগণ দারুল উলূম দেওবন্দ চর্চার কারণে ভালো উর্দু জানতেন। ফলে মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষের বিপদের দিনে অনেক বেশি কাজে লেগেছে তাদের অবস্থান। কিন্তু বার বারই বিপদে ফেলতে চেয়েছে মওদুদীবাদিরা। তারা শান্তিবাহিনী গঠন করে আলেমদের নাম প্রচার করে বিপদে ফেলতে চেয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত আগা শাহীর সাক্ষাৎকার, যা মার্কিন টেলিভিশন এবিসির মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছিল। ওই সাক্ষাৎকারে সাংবাদিক বব ক্লার্কের এক প্রশ্ন থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয়, আলেম সমাজ মুক্তিযুদ্ধে জনগণের পাশে ছিলেন এবং সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেছেন। সাংবাদিক অ্যান্থনী মাসকারেণহাস লেখেন- কুমিল্লার নবম ডিভিশন হেডকোয়ার্টারে আমার সফরকালে আমি দেখেছি, পাঞ্জাবি অফিসারগণ বাঙালিদের ইসলামের আনুগত্যের প্রতি সব সময়ই সন্দেহ পোষণ করত। তারা বাঙালি মুসলমানদের কাফের ও হিন্দু বলত।
দ্বিজাতিতত্ত্বের ধ্বজাধারী হানাদার সদস্যদের নিজেদের নামাজ রোজার বালাই না থাকলেও অন্যের কালেমা বিশুদ্ধ আছে কিনা তা নিয়ে খুবই বেদনাকাতর হতো। মূলত, ৭১ সালে ইসলাম ও মুসলমানই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছিল। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম লেখেন, এক মহিলা রোগীর কাছে শুনেছিলাম তিনি নামাজ পড়ছিলেন, সেই অবস্থায় তাঁকে টেনে ধর্ষণ করা হয়। আরেক মহিলা কোরআন শরিফ পড়ছিলেন, শয়তানরা কোরআন শরিফ টান দিয়ে ফেলে তাঁকে ধর্ষণ করে।
এরকম কতশত বীভৎস ঘটনার জন্ম হয়েছিল একাত্তরে তার শেষ নেই। শুধু তাই নয় পাকিস্তানের করাচির অনেক আলেমও শেখ মুজিব তথা মুক্তিযুদ্ধের সমর্থন জানিয়েছিলেন। সিলেটের জকিগঞ্জ এলাকার মাওলানা আব্দুস সালাম ১৯৭১ সালে করাচির ইউসুফ বিন্নুরী মাদরাসার ছাত্র ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের মাদরাসায় পড়–য়া বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদেরও বিপদে পড়তে হয়েছে। মাদরাসা ছাড়তে হয়েছে। তবে একথা স্বীকার্য যে, পাকিস্তানের দেওবন্দী চেতনার অনেক আলেমও পাকিস্তানের জুলুমের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন। বাংলাদেশের আলেমদেরকে শয়তানীচক্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন। বাংলাদেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে এক ছাত্র করাচি মাদরাসার ইমাম মুফতি মাহমুদ সাহেবকে প্রশ্ন করলেন, হযরত মুজিব গাদ্দার কো গ্রেফতার কর লে আয়া, লেকিন আবি তক কতল বী নেহি কিয়া?’ প্রশ্ন শুনেই মুফতি সাহেব খুব ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, শেখ মুজিব গাদ্দার নেহি, অহ সুন্নি মুসলমান হে, ইয়াহিয়া আওর ভূট্টো শিয়া হে। হর সুন্নি মুসলমানে কি জান আওর মাল কি হেফাজত কর না হর সুন্নি মুসলমানকে লিয়ে ওয়াজীব হে।
একটা কথা খুব বড় করেই বলা যায়- এ দেশের মাদরাসা ও মসজিদের ইমাম-খতীবগণ সবসময় ন্যায়পরায়ণতার কথা বলেন। সত্যসমৃদ্ধির কথা বলেন। তারা কোনটা জুলুম আর কোনটা জুলুম নয় তা নির্ণয় করতে পারেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় একারণে মুক্তিবাহিনীর সহযোগিতা, আশ্রয়, সেবপ্রদানে বড়ভূমিকা পালন করেন আলেমসমাজ। ১৯৭১ এ মুক্তিযোদ্ধারা রণাঙ্গণে যাবার আগে আল্লাহর কাছে সালাত আদায় করে মুনাজাত করে রওনা হয়েছেন। এ ঘটনাগুলো আমাদের চোখের সামনেই ঘটতো। গুলির ভেতর দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষশক্তিকে আমরা সাহায্য সহযোগিতা করেছি। বাংলাদেশের পক্ষে জনমত তৈরিতে কাজ করেছি। আফসোসের কথা হলো, এ দেশের আলেমসমাজ জমিয়তে উলামা হিন্দের নকশ ও নমুনার উপর চলার অভিপ্রায়ে একমত হলেও বাস্তবানুগ নয়। সবসময় কুচক্রীমহলের প্রতারণার শিকার হয়ে আসছে। বহির্বিশ্ব থেকে দারুল উলূম দেওবন্দে বৈধভাবে পড়াশোনা করতে পারলেও ৪৭বছরেও বাংলাদেশের তরুণরা সে অধিকার পাচ্ছে না। আলেমদের আন্দোলন, সংগ্রাম ও নৈতিক বিপ্লবী অগ্রযাত্রা সুপরিকল্পিত নয় বলেই আমরা আগাতে পারছি না। আর না হলে অল্প আমলও মুক্তির উপায় হিসেবে চিহ্নিত হতো। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে মানুষের জন্য ও সুন্দর একটি বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য কবূল করুন। আমীন।
মাসিক পাথেয় ডিসেম্বর ২০১৭