হযরত উলামায়ে কেরাম, যুবক ভাইয়েরা এবং জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের নেতৃবৃন্দ! মনে রাখার বিষয় হল, এটা কোন সাধারণ মজলিস না বরং তরবিয়তী মজলিস, ফিকরী মজলিস। শেখার মজিলস যে আমি এখান থেকে গিয়ে কোন মিশনে চলবো, আমার জীবনকে আমি কোন পথে পরিচালিত করবো।
কোন ঈমানদারকে এটা বলার প্রয়োজন নেই- ঈমানের সাথে চলো, কুরআনের পথে চলো, শরীয়ত মোতাবেক চলো, নামাজ, রোজা ইত্যাদি আল্লাহর যে হক আছে, নবীর যে হক আছে তা আদায় করো। এগুলো তো করতেই হবে।এগুলো ব্যতিরেকে আমরা তো ঈমানদারই হতে পারবো না।
আমার কথা হল, শরীয়ত বা দ্বীন আসলে কাকে বলে? আল্লাহ তায়ালা কুরআনে দ্বীনের পরিপূর্ণতার যে ঘোষণা দিয়েছেন اليوم اكملت لكم دينكم বলে, মূলত এই দ্বীন কী? কোন জিনিসেরই বা পূর্ণতা পেয়েছে? রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ইলমী এবং আমলী যিন্দেগী। তাঁর মধ্যে মাক্বী যিন্দেগী, মাদানী যিন্দেগী। সুলহে হুদাইবিয়ার আগের ও পরের যিন্দেগী। ইসলামের নেজাম পূর্ণ হওয়ার আগের ও পরের যিন্দেগী। হিজরত করে সবে যখন মদীনা মুনাওয়ারে এসেছেন তখনকার সেই আমল যে, কিভাবে সকল ধর্মের মানুষকে একত্র করে বিভিন্ন বিষয় সামনে নিয়ে সন্ধিপত্র বা চুক্তিনামা তৈরী করেছেন। যার মাঝে ৮০টিরও বেশি বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল! সেগুলো আমাদের মুতালা বা অধ্যয়ন থাকা উচিত।
রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইহুদীদের সাথে অন্যান্য ধর্মের সাথে কি কি চুক্তি করেছেন? এর মধ্যে একটা বিষয় এ-ও ছিল যে, যদি বাইরের কোন শত্রু শক্তি, আমাদের শহরের উপর, আমাদের দেশের উপর, মদীনা মুনাওরার উপর হামলা করে, আমরা সবাই মিলে মিশে সে আক্রমণকে প্রতিহত করবো।আমাদের এলাকাকে সুরক্ষিত করবো। আমাদের দেশকে হেফাযত করবো। আমাদের শহরকে রক্ষা করবো। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই মিলে আমরা দুশমনকে প্রতিহত করবো।
বর্তমানে সেই চুক্তিনামাকে সামনে রেখে আমাদের কাজগুলোকেও বিন্যস্ত করা যে, কিভাবে আমাদেরকে দেশের ভেতরে বসবাস করতে হবে? কিভাবে জীবন অতিবাহিত করতে হবে। সাথে সাথে এ বিষয়টাও মনে রাখতে হবে যে, ঈমান ও ভীতি, ঈমান ও শংকা, ঈমান এবং নিরুৎসাহিত আলাদা আলাদা জিনিস, দুইটা বিপরীত জিনিস। এগুলো কখনো একত্র হতে পারে না। কারো ঈমান থাকবে আবার ভীতিও থাকবে এটা হতে পারে না। আমি সাময়িক ভয় পাওয়ার কথা বলছি না। আমি বলছি এমন ভয় পাওয়ার কথা, যা মনের মধ্যে এভাবে গেঁথে যায় যে ব্রেইনে আর কোন কাজ করে না। কোন রাস্তা বের করতে পারে না। ভবিষ্যতের জন্য কোন পথ বের করতে পারে না। আর এটাই ঈমানের সাথে বৈপরীত্য রাখে।
জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ওই সংগঠনের নাম যে সংগঠনের আকাবিররা হালতকে পরিবর্তন করেছেন। কোন অবস্থার তালে তাল মিলিয়ে চলেননি। অবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে চলা তো অনেক সহজ। কিন্তু, কোন হালতের (অবস্থার) পরিবর্তন করে দেয়ার জন্য, দিলে অনেক সাহসের প্রয়োজন। বাইরের লোকদের মোকাবেলা করা সহজ, কিন্তু নিজেদের লোকদের মোকাবেলা করা কঠিন। যদি নিজেদের কেউ ভুল রাস্তায় চলে, ভুল চিন্তা দ্বারা পরিচালিত হয় এবং জযবায় ভরপুর থাকে। তার সে জযবাকে কন্ট্রোলে এনে তাকে সহীহ রাস্তায় ফিরিয়ে আনা সবচে কঠিন কাজ। কোন একজন বড় আলিম এই মুহূর্তে আমার স্মরণে আসছে না, হয়ত হযরত আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ. বা শাহ আতাউল্লাহ বুখারী রহ. হবেন, যিনিই হোন। তিনি লিডার ও কায়েদের মধ্যে পার্থক্য বয়ান করেছেন, এবং বলেছেন যে উলামায়ে কেরামকে কিয়াদাতের দায়িত্ব পালন করতে হবে।
আভিধানিক অর্থে লিডার ও কায়েদের অর্থ যদিও এক (নেতা)। কিন্তু হযরত পার্থক্য করে বলেছেন, লিডার কাকে বলে এবং কায়েদ কাকে বলে? তিনি বলেন, লিডার ওই ব্যক্তিকে বলে যার কাজ হল, বাতাস যেদিকে প্রবাহিত হয় সেদিকেই যাওয়া। সে ক্বওমের মেজাজ দেখে, যে ক্বওম কি চায়? সে তেমনই বলে।
আর কায়েদের কাজ হলো, সে দেখে যে কওম সহীহ রাস্তায় চলছে না ভুল রাস্তায়? যদি ক্বওম ভুল রাস্তায় চলে তাহলে ক্বওমকে সহীহ রাস্তায় আনার দায়িত্ব পালন করে। এরপরে তিনি আরো লিখেছেন যে, লিডার সর্বদা তালি আর প্রশংসাই শুনে অথচ কায়েদ সর্বদা গালিই শুনে। বাস্তবে কথা হল লিডার সে কথাই বলে যা আপনি চান তখন আপনি তালি বাজান, বাহ! বাহ! সুন্দর কথা বলেছেন।
কেন প্রশংসা করেন? কারণ সে আপনার মনের কথা বলেছেন। আর যদি সে এটা বলতো যে আপনি ভুল রাস্তায় যাচ্ছেন ভুল চিন্তা করছেন ভুল পথ অবলম্বন করছেন। তাহলে বাস্তবতা এটাই যে, সবার এটা পছন্দ হবে না। বলবে বড় হয়ে গেছে, এখন আমাদেরকে বোঝাতে এসেছে!
আলহামদুলিল্লাহ! জমিয়তে উলামা কিয়াদাতের দায়িত্বই পালন করে চলেছে। এ সংগঠন সর্বদা সঠিক রাস্তাই দেখিয়ে এসেছে এবং কখনো এই পরোয়া করেনি যে ক্বওম তাদের প্রতি খুশি আছে না নারাজ হয়ে গিয়েছে। আমাদের আকাবিররা যেটাকে হক মনে করেছেন সেটাই বলেছেন, কখনো কওমের পরোয়া করেননি।
২০০ বছর লড়াই করে হিন্দুস্তান যখন স্বাধীনতার নিকটে চলে এলো তখন সবার মাথায় দেশ ভাগের ভূত চেপে বসল যে, আমাদের আলাদা রাষ্ট্র চাই! সবার মধ্যে প্রচণ্ড জযবা। কিন্তু জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ সে সময় বলল দেশ ভাগ করা মানে নিজের পায়ে নিজে কুড়োল মারা। আপনারা এ ব্যাপারে বিশদ জানেন বিস্তারিত বলতে চাচ্ছি না। তবে এটুকুই বলছি যে জমিয়তের আকাবিররা দেশ ভাগের শক্ত বিরোধিতা করেছেন। এর মাঝে অনেক হিকমতও নিহিত ছিল। এমনকি জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ, সবাই একসাথে কিভাবে বাস করা যায় এ ব্যাপারে একটা ফরমুলাও দিয়েছিল।
এমন নয় যে কেবল মুখালাফাত করেই ক্ষান্ত হয়েছেন। সেই ফর্মুলাটা মাদানী ফর্মুলা নামেই প্রসিদ্ধ। জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সমস্ত জিম্মাদারগনের এটা পড়া প্রয়োজন। এই ইতিহাস জেনে রাখা আবশ্যক যে, কেমন শানদার নেযাম ছিল সেটা। এগুলো বলা আমার উদ্দেশ্য না।
সমষ্টিগতভাবে জমিয়তের আকাবিররা হযরত মাদনী, মুফতী কেফায়াতুল্লাহ, মাওলানা আবদুর রহমান, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ (রহিমাহুমুল্লাহ) এছাড়া আরো হাজারো উলামায়ে কেরাম দেশ বিভক্তির বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হল, মানুষ যখন জোশের মধ্যে থাকে তখন কোন কিছুই বুঝতে চায় না।। যখন পাকিস্তানের দাবিতে না’রায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবার বলেছে সে সময় আমাদের আকাবির আমাদের বুযুর্গরা বলেছেন এটা নিজের পায়ে নিজে কুড়োল মারা ছাড়া আর কিছুই নয়। যখন হযরত মাদানী রহ. একথা বললেন, তখন বাইরের কেউ নয় বরং নিজেদের লোক মুসলমান ভাইয়েরা তার পাগড়ি খুলে পা দ্বারা মাড়িয়েছে।
এটা কি চিন্তা করা যায়? যিনি ছিলেন শাইখুল আরব ওয়াল আযম। যিনি ১৪, ১৫ বছর মদীনা মুনাওয়ারায় রাসূলের রওযায় বসে হাদীস পড়িয়েছেন। শুধু এটুকুই নয় হত্যার জন্য আক্রমণ পর্যন্ত করেছে।
একজন অনেক বড় আলেম শাইখুল হাদীস আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়েছেন, তার সাথে সরাসরি আমার কথা হয়েছিল যে, তখন কি অবস্থা ছিল। সে বলল আমাদেরকে পড়াশোনার জন্য দারুল উলুম দেওবন্দে না পাঠিয়ে মাযাহিরে উলুমে পাঠানো হয়েছিল শুধু এই একটা মাত্র কারণে যে, দেওবন্দে মাদানী রহ. এর মতো লোক থাকায় আমরাও বিগড়ে যাব। ব্রেইন ওয়াস হয়ে যাবে। আমি এলাকার নাম নিতে চাচ্ছি না। হযরত মাদানী রহ. সে এলাকায় আসতেন তখন মাদ্রাসার ভেতরে থেকে মাদ্রাসার ছাদে উঠে মাদানী রহ. এর বয়ান শোনারও অনুমতি ছিলো না। সেখানে তাকে শাইখুল ইসলাম না বলে শাইখুল আসনাম তথা মূর্তি পূজকদের শাইখ বলা হতো।
একেই বলে কিয়াদাত। নিজেদের লোকদের গালি শোনার পরেও কুরআন ও হাদীসের আলোকে ইতিহাস ও ভৌগলিক অবস্থার নিরীখে মাদানী রহ. যেটাকে হক বলে বুঝেছেন, যে অবস্থার উপর কায়েম ছিলেন সে অবস্থাতেই সর্বদা বহাল ছিলেন। তিনি সর্বদা দেশের সাথে দ্বীন ও ধর্মের ইজ্জত ও সম্মান চাইতেন। দেশকে ভাগ না করার জন্য চেয়েছেন। কেননা এক দেশে বসবাসকারীরা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে যাবে শুধু ছড়িয়েই যাবে না বরং সারা জীবনের জন্য দুশমন বনে যাবে। মানুষ মানলো না, শুনলোনা তার কথা। অবশেষে যা হওয়ার তাই ই হলো। কিন্তু আজ ফলাফল কী?
আমি পড়েছি মাওলানা মনযুর নোমানী রহ. লিখেছেন, তিনি পাশের রাষ্ট্রে সফর করেছিলেন সেখানকার নামকরা নেতৃবৃন্দের অন্যতম একজন চৌধুরী খালেকুজ্জামান। যখন তার সাথে আমার সাক্ষাত হলো, আমি ফিরে আসার এক সপ্তাহ পরেই তার ইন্তেকাল হয়ে গিয়েছিল, জমিয়তের ব্যাপারে তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল (নাউযুবিল্লাহ) নিজেদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠন করে হুসাইন আহমদ মাদানী রহ. এর সামনে থেকে বিরিয়ানীর প্লেট ছিনিয়ে নিয়েছি। হিন্দুস্তানের কেউ এখন তাঁর দিকে ঘুরেও দেখবে না। কিন্তু ইন্তেকালের ১ সপ্তাহ পূর্বে যখন মনযুর নোমানী রহ. এর সাথে তাঁর দেখা হয়েছে তখন তিনি বলেছিলেন, মাওলানা! হুসাইন আহমদ মাদানী সত্য বলেছিলেন আমরাই ধোঁকা খেয়ে গিয়েছি। আমরাই ভুলের উপরে ছিলাম।
আমি এই ঘটনা কেবল শোনানোর জন্যই বলছি না। আমি এজন্যই আপনাদের সামনে বলছি, যেন আপনারা বুঝতে পারেন যে, আল্লাহ আপনাদের আকাবিরদের মাঝে দূরদৃষ্টি দিয়েছিলেন। তারা কিয়াদাতের দায়িত্ব পালন করেছেন। তারা এমন কখনো করেননি, মানুষ যা চায় তাই বলেছেন।
বর্তমানে বিদ্যমান যারা কিয়াদাতের দায়িত্ব পালন করছেন তাদের উপরেও আস্থা রাখুন। আল্লাহ তাদের দূরদর্শিতার সাথে সাথে ইলমও দিয়েছেন। আমরা তো মাঝে মধ্যেই বড় বড় বুযুর্গদের ব্যাপারে না জেনে, তাহকীক না করে সমালোচনার ঝড় তুলি। মিডিয়া যাকে ফেরেশতা বানিয়ে দেয়, আমরা তাকে ফেরেশতা মনে করি, আর যাকে তারা শয়তান বানিয়ে দেয় তাকে আমরা শয়তান মনে করি।
অনুবাদ ও গ্রন্থনা : মুফতি আশিক মুহাম্মদ
সম্পাদনা : মাসউদুল কাদির