শরয়ী সীমারেখা মেনে সরকারের সাথে মাদরাসার সহযোগিতার সম্পর্ক, কখনই দ্বন্দ্বের নয় : আল্লামা আরশাদ মাদানী 

শরয়ী সীমারেখা মেনে সরকারের সাথে মাদরাসার সহযোগিতার সম্পর্ক, কখনই দ্বন্দ্বের নয় : আল্লামা আরশাদ মাদানী 

• ভারতের নতুন শিক্ষানীতিতে দেওবন্দের সমর্থন
• হযরত কাসেম নানুতবীর সিলেবাস
• মাদরাসা শিক্ষার্থীদের জাগতিক শিক্ষা প্রদানে দেওবন্দের পরিকল্পনা
• হিফজুল কুরআনের সাথে আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়

দারুল উলূম দেওবন্দ বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা কওমী মাদরাসা সমূহের প্রধানকেন্দ্র। ভারতের উত্তর প্রদেশে অবস্থিত এই মাদরাসায় আজ (১৮ সেপ্টেম্বর) অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে জমিয়তে উলামা হিন্দের সভাপতি, দারুল উলূম দেওবন্দের সদরুল মুদাররিসীন, আমীরুল হিন্দ, আওলাদে রাসূল, আল্লামা সায়্যিদ আরশাদ মাদানী দিকনির্দেশনা মূলক এক বক্তব্য রেখেছেন। এই বক্তব্যের চুম্বক অংশ ‘দেওবন্দের শিক্ষাপরিকল্পনা’ বিষয়ক আলোচনা পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

 

ভারতের নতুন শিক্ষানীতিতে দেওবন্দের সমর্থন

ভারতের জাতীয় শিক্ষানীতি প্রসঙ্গে দারুল উলূম দেওবন্দে ইতোমধ্যেই ১০-১৫টি বৈঠক হয়েছে জানিয়ে আল্লামা আরশাদ মাদানী বলেন, শরয়ী সীমারেখা মেনে সরকারের সাথে মাদরাসার সহযোগিতার সম্পর্ক। দ্বন্দ্বের সম্পর্ক কখনই ছিল না। এর অনেক উদাহরণ আমি পেশ করতে পারি, তবে এতে করে আলোচনা দীর্ঘতর হয়ে পড়বে। আমি কেবল চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কেই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখছি।

“ভারতের নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি (একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা) আসছে এবং এতে সরকার এই নীতি গ্রহণ করেছে যে, ভারতের প্রত্যেক শিশু অন্তত দশম শ্রেণী পর্যন্ত আধুনিক-জাগতিক শিক্ষায় শিক্ষাগ্রহণ করবে। কোনো কোনো স্থানে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে।”

আল্লামা আরশাদ মাদানী বলেন, আমাদের মতামত আপনাদের সামনে উপস্থাপন করছি এবং আমরা অত্যন্ত দৃঢ় ভাবে নিজেদের মতামতে অটল থাকবো যে, আমরা দারুল উলূম দেওবন্দে আধুনিক (জাগতিক) শিক্ষাকে গ্রহণ করবো। এতে অসুবিধার কিছু নেই।

 

হযরত কাসেম নানুতবীর সিলেবাস

দারুল উলূম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা, হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত কাসেম নানুতবীর সময়ে প্রণীত সিলেবাস প্রসঙ্গে আল্লামা আরশাদ মাদানী বলেন, আমি যখন প্রথমবার দেওবন্দের নাযেমে তালীমাত (শিক্ষাপ্রধান) নিযুক্ত হলাম, তখন দেওবন্দের প্রবীণ নিবাসী ও সাবেক নাযেমে তালীমাত (শিক্ষাপ্রধান) মুনশি আব্দুল আযীয সাহেব আমার কাছে হযরত কাসেম নানুতবীর সময়কার সিলেবাস হস্তান্তর করেছিলেন। বর্তমানে অবশ্য এটা হারিয়ে গেছে।

৯ম বর্ষ থেকে দেওবন্দে ধর্মীয় শিক্ষার শুরু, এর পূর্বে ৮ বছর কেবলি জাগতিক শিক্ষার পাঠদান

“এই সিলেবাসে আমি নিজের চোখে দেখেছি যে, দারুল উলূম দেওবন্দে ছাত্রদের ধর্মীয় বিষয়ে পাঠদানের পূর্বে; ‘মিযান’ (কওমী মাদরাসায় ধর্ম বিষয়ের ১ম শ্রেণী) শুরুর পূর্বে কেবল জাগতিক শিক্ষাভিত্তিক ৮ বছরের পাঠ্যক্রম ছিল। এই ৮ বছরের পাঠ্যক্রমে হিসাববিজ্ঞান, ফার্সী, হিন্দি ও ইংরেজি ভাষাশিক্ষা, ভূগোল, ইউক্লিডীয় গণিত ইত্যাদি জাগতিক বিষয়াবলী ছিল। এই পাঠ্যক্রমের কিছু বিষয় সম্পর্কে আজকাল অনেক মাদরাসা কর্তৃপক্ষ তো কিছু জানেই না।”

“এই ৮ বছরের পাঠ্যক্রম শেষ করার পর একজন ছাত্র ধর্মীয় শিক্ষাগ্রহণ শুরু করতো।”

“পরবর্তীতে কমতে কমতে একসময় এই ৮ বছরের পাঠ্যক্রম ৫ বছরে নেমে আসে। আমি যখন দেওবন্দে যোগ দেই, তখন এই ৮ বছরের পাঠ্যক্রম মাত্র ৩ বছরের ছিল। পরে সেটা আবার ৫ বছরে উন্নীত করা হয়। কিন্তু শুরুতে এই পাঠ্যক্রম যতটা মানসম্পন্ন ছিল, পরে ৫ বছর করা হলেও এর মান পূর্বের মতো আর থাকেনি।”

 

মাদরাসা শিক্ষার্থীদের জাগতিক শিক্ষা প্রদানে দেওবন্দের পরিকল্পনা

‘উম্মুল মাদারিস’ নামে খ্যাত দারুল উলূম দেওবন্দে শিক্ষার্থীদের জাগতিক শিক্ষা অর্জনে কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা সম্পর্কে আল্লামা আরশাদ মাদানী বলেন, আজও আমি বলছি যে, দারুল উলূম দেওবন্দে আমরা প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে আধুনিক-জাগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করবো।

“দশম শ্রেণী পর্যন্ত প্রত্যেক ছাত্রকে পরিপূর্ণ সিলেবাসে পড়ানো হবে এবং পরীক্ষায় (এসএসসি সমমানের ভারতের কেন্দ্রীয় বোর্ড পরীক্ষা) অংশগ্রহণের ব্যবস্থা নেয়া হবে।”

“দশম শ্রেণী পাশ করার পর একজন ছাত্র ‘মিযান’ (কওমী মাদরাসায় ধর্ম বিষয়ের ১ম শ্রেণী) শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হবে। এই শ্রেণী থেকে ধর্মীয় বিষয়াবলী ব্যতিত আর কোনো বিষয়ে পাঠদান করা হবে না।”

 

হিফজুল কুরআনের সাথে আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়

পবিত্র কুরআনে কারীম হিফজ (সম্পূর্ণরূপে মুখস্ত) করা মুসলিম সমাজে একটি বহুল চর্চিত বিষয়। পবিত্র কুরআন হিফজ করতে ইচ্ছুক ছাত্রদের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা ঘোষণা করে আল্লামা আরশাদ মাদানী বলেন, আগামী বছর থেকে হিফজরত ছাত্রদেরকে হিফজের সাথে সাথে জাগতিক শিক্ষার বিষয়গুলো প্রতিদিন ২ ঘন্টা করে পড়ানো হবে।

“এই ছাত্রদেরকে ‘ওপেন স্কুল’ (জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের একটি উদ্যোগ)-এর অধীনে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হবে। এরপর যদি কেউ ইচ্ছুক থাকে তবে ‘মিযান’ (কওমী মাদরাসায় ধর্ম বিষয়ের ১ম শ্রেণী)-এ এসে ভর্তি হবে। এরপর আর কাউকে ধর্মীয় বিষয়াবলীর বাইরে অন্যকিছু পড়ানো হবে না। কারণ, এই স্তরের পাঠ্যক্রম অনেক দীর্ঘ।”

আলোচনার শেষাংশে আল্লামা আরশাদ মাদানী ভারতের জাতীয় শিক্ষানীতি প্রসঙ্গে দেওবন্দের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, ‘দারুল উলুম দেওবন্দের অবস্থান ভারত সরকারের জাতীয় শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে নয়।’

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *