শায়েখ ইব্রাহিম আফ্রিকী এক বে- মেছাল ব্যক্তিত্ব
মাওলানা আমিনুল ইসলাম : একাবিংশ শতাব্দির এ যুগে নিঃস্বার্থ ভাবে উস্তাদের খেদমতে নিজেকে বিলীন করে দিয়েছেন, এরকম মানুষ পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু শায়েখ ইব্রাহিম আফ্রিকী এমন একজন মানুষ, তিনি নিজের উস্তাদ এবং শায়েখের খেদমতে জীবন উৎসর্গ করে এক বিশাল কৃতিত্ব দেখায়েছেন।
বর্তমান যুগে উস্তাদের খেদমত কি জিনিস, এটা যেন আমাদের ছাত্রদের থেকে বিদায় নিতে চলেছে। তবে ইব্রাহিম আফ্রিকী স্বীয় উস্তাদের খেদমতে নিজেকে উজাড় করে দিয়ে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্হাপন করেছেন তিনি। এবং ছাত্রদের শেখায়েছেন, কিভাবে উস্তাদ ও আপন মুর্শিদের খেদমত করতে হয়।
ইব্রাহিম আফ্রিকী সাহেবের বাড়ী সাউথ আফ্রিকায়। লেখা পড়া তাঁর প্রাথমিক অবস্হায় সাউথ আফ্রিকাতে। এরপর দারুল উলুম দেওবন্দে উচ্চতর ইসলামী শিক্ষা সমাপ্ত করেছেন।
সুলুকের লাইনে সর্ব প্রথম তিনি শাইখ জাকারিয়া( রহঃ) এর কাছে বায়াত নেন। এবং তাঁর কাছ থেকে খেলাফত প্রাপ্ত হন।
এদিকে দেওবন্দ থাকাকালিন ফকীহুল উম্মাহ মুফতি মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী এর কাছে বায়াত গ্রহন করেন। পরবর্তিতে মু্ফতি মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী ( রহঃ) থেকেও খেলাফত লাভ করেন।
মুফতী ইব্রাহীম আফ্রিকী সাহেব দেওবন্দ থেকেই নিজের উস্তাদ মুফতী মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী এর খেদমত করতেন। আপন উস্তাদের খেদমত ছাড়া যেন তিনি আর কিছু বুঝতেন না।
প্রথমে যখন তিনি শায়েখ জাকারিয়া ( রহঃ) এর কাছ থেকে খেলাফত লাভ করেন, অনেকের ধারণা ছিল, তিনি নিজ মাতৃভুমিতে ফিরে যাবেন। কিন্তু তিনি যাননি। আপন উস্তাদের খেদমতে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন।
আবার যখন নিজের প্রিয় শায়েখের থেকে ইজাজত পেলেন, তখনও অনেকে মনে করেছে, এবার বুঝি দেশে ফিরবেন। তুবুও নিজের উস্তাদের খেদমত ছেড়ে যান নি।
জবরদস্ত দুই শায়েখের কাছে খেলাফত লাভ করার পরেও তিনি নিজ দেশে না গিয়ে প্রিয় উস্তাদ ফকীহুল উম্মাহ মুফতী মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী এর খেদমতে রয়ে যান। এবং গাঙ্গুহী সাহেবের ইন্তেকাল পর্যন্ত তাঁর খেদমতে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন।
মুফতী ইব্রাহিম আফ্রিকী সাহেবকে আমি দেখেছি বহুবার। তিনি যখন শায়েখ মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী এর খেদমত করতেন, আমরা তাঁর সে সব দৃশ্য খেয়াল করতাম। একদম নিবেদিত প্রাণ ছিলেন তিনি। কোন একটা মুহুর্ত আপন শায়েখের কাছ থেকে সরে যেতেন না।
মালিবাগ জামিয়ায় ১৯৯৫ সনে মুফতি মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী ( রহঃ) যখন ইতিকাফ করে ছিলেন, সে সময়ে অনেক কাছ থেকে ইব্রাহিম আফ্রিকী সাহেবের উস্তাদের খেদমত দেখার সৌভাগ্য হয়ে ছিল আমাদের। এরপর যখন দেওবন্দ গেলাম,সেখানেও দেখলাম তাঁকে।
মুফতী মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী (রহঃ) শেষ বয়সে অন্ধ হয়ে পড়ে ছিলেন। কিছুই দেখতেন না। কিন্তু ইব্রাহিম আফ্রিকী সাহেব ছিলেন তাঁর সব সময়ের সঙ্গী। সর্বাবস্হায় শায়েখকে নিয়ে বেড়াতেন। কখনো হুইল চেয়ার, কখনো হাত ধরে, কখনো তার কাঁধের উপর ভর করায়ে নিয়ে চলতেন। শায়েখের সকল কাজের খেদমতে নিজেকে উজাড় করে দিয়ে ছিলেন তিনি।
তিনি পরিবার পর্যন্ত নিয়ে এসে ছিলেন সুদুর আফ্রিকা থেকে ইন্ডিয়ার জমিনে । আফ্রিকার আরাম- আয়েশ ছেড়ে, উস্তাদকে ভালবেসেছেন সব সময়।
ইব্রাহিম আফ্রিকী সাহেবের সেই কোরবানীর বদৌলতে তিনি এখন অনেক ইজ্জত ওয়ালা। উস্তাদের দুআর বরকতে তাঁর খ্যাতি এখন বিশ্বময়। শায়েখের ইন্তেকালের পরে তিনি এখন তাঁর স্হলাভিষিক্ত।
বিশ্বব্যাপি ইব্রাহিম আফ্রিকী সাহেব সফর করে চলেছেন। হুবহু আপন উস্তাদের মর্যাদা লাভ করেছেন তিনি। ওলামায়ে কেরাম এবং আম- জনতা সকলেই তাঁকে মুফতি মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী এর মত মনে করে। এবং গাঙ্গুহী এর মত ইজ্জত করে সবাই। একদম যেন শায়েখের ফটোকপি বনে গেছেন তিনি। চাল- চলন, কথা- বার্তা, সব কিছুতে আপন শায়েখের প্রতিচ্ছিবি যেন তাঁর মাঝে ভেসে উঠেছে।
মানে উস্তাদের খেদমতের বরকতে সারাজাহানে এখন তিনি সন্মানিত হচ্ছেন। তিনি যেমন এক সময় খেদমত করেছেন, এখন যেন সারা জগতের মানুষ খেদমত করছে তাঁকে।
এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা উল্লেখ না করে পারছিনা। ঘটনাটি মুফতি মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী ( রহঃ) তাঁর কিতাব ” মাওয়ায়েজে ফকীহুল উম্মাহ ” এর মধ্যে পড়ে ছিলাম।
আব্দুল কাদের রায়পুরী( রহঃ) যিনি নাকি হযরত আব্দুর রহীম রায়পুরী ( রহঃ) এর খলিফা ছিলেন। এবং শায়েখের ইন্তেকালের পর তাঁর জা-নশীন হয়ে ছিলেন। একবার তিনি হযরত থানুবী ( রহঃ) এর কাছে গেলেন। সেখানে গিয়ে আব্দুর কাদের রায়পুরী বললেন, হুজুর! আমাকে চিনতে পেরেছেন? আরো বললেন, আপনার কি মনে পড়ে? হযরত আব্দুর রহীম রায়পুরী( রহঃ) এর খানকায় একটা ছেলেকে, যে সব সময় মেহমানদের খেদমতে দস্তারখান নিয়ে ব্যস্ত থাকত মেহনতদের খেদমত করত।
থানুবী( রহঃ) বলেন, জুব্বা পরিহিত একটা ছেলেকে দেখতাম, সব সময় মেহমানদের খেদমতে নিয়োজিত থাকত।
আব্দুল কাদের রায়পুরী বলেন, হ্যাঁ, হযরত, আমি সেই আব্দুল কাদের। হযরত থানুবী ( রহঃ) বলেছিলেন, যে খেদমত করে সে মাখদুম হয়।
মানে এমন একটা সময় আসে, ঐ খেদমতকারী কে সারা জগতের মানুষ খেদমত করতে থাকে। ঠিক ইব্রাহিম আফ্রিকী সাহেব সেই মর্য্যাদা লাভ করেছেন। এক সময় নিজের উস্তাদের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন, এখন সারা জাহানের মাঝে তিনি সন্মানিত। সারা দুনিয়ার মানুষ যেন তাঁর খেদমত করছে।
ব্রাহিম আফ্রিকী সাহেব এখন বাংলাদেশ সফর করছেন। মানুষের ঢল নামছে তাঁকে দেখার জন্য। গত দুই বছর আগে মাহে রমজানে ঢাকাতে ইতিকাফ করে ছিলেন। হাজারো ওলামায়ে কেরামের উপস্হিতি ছিল সেখানে। এভাবে বিশ্ব ব্যাপি তাঁর সফর হচ্ছে।
আল্লাহর কাছে দুআ করি তাঁর সু স্হাস্হের জন্য। আল্লাহ তাঁকে নেক হায়াত দান করুন। আমিন।
লেখক : শিক্ষক